ডায়াবেটিসের ফলে কি কি রোগ হতে পারে

ছোটোবেলায় ঠাকুরদার কাছে শুনেছিলাম ডায়াবেটিস রোগ সংক্রান্ত ব্যাপারে, পরবর্তীকালে ডায়াবেটিস তাদের শরীরের বহু উপসর্গ সমস্যায় জর্জরিত। দীর্ঘ হাই ব্লাড সুগারে নানান রকম জটিলতা এসে শরীরে বাসা বেঁধেছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তরা কেউ মারা যায় না। বিভিন্ন জটিলতায় শরীরে নানান ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেই তবেই রোগীরা মারা যায়।
শরীরে গ্লুকোজ তৈরী হচ্ছে ও তার বেশীর ভাগ রক্তেই থেকে যাচ্ছে। দেহ কোষে তেমনভাবে কাজে লাগছে না। রক্তে শর্করার মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যায়। ফলে প্রস্রাবের সাথে প্রচুর পরিমাণে সুগার/গ্লুকোজ বের হলে নিস্তার পাওয়া যায়, ফলে রক্ত তার ঘনত্ব বজায় রাখার জন্য কোষ থেকে জল টেনে নেয় ও অত্যধিক জল তেষ্টা পায়। জল বেশী করে খেলে তেষ্টা কমবে; কিন্তু প্রস্রাবে সেই জল পুনরায় বেরিয়ে যাবে। প্রস্রাবে শুধু যে গ্লুকোজ/সুগার বেরিয়ে যায় তা নয়, বেশ কিছু লবণ বা সুগার প্রস্রাবে সাথে দেহের বাইরে বেরিয়ে যায়। রক্তের ঘনত্ব বেশী হলে রক্তনালীর গায়ে কোলেস্টেরল জমার সম্ভাবনা থাকে। রক্ত ও কোষের ঘনত্ব দু-রকম হওয়ার ফলে কোষগুলি ঠিক মতো কাজ করতে পারে না। রক্তনালীগুলি সূক্ষ্ম পর্যায়ে থাকে এবং বিভিন্ন রকম অসুবিধা দেখা যায়। এই কারণে চোখ, কিডনি, মস্তিষ্ক বা ব্রেন, হৃদযন্ত্র ও অন্যান্য সব অঙ্গ-যন্ত্রে এর প্রভাব পড়ে। কোষের বাইরে বা রক্তে শর্করা বেশী থাকার ফলে জীবাণুরা বাড়তি খাদ্য পেয়ে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে কান জীবাণুর ইনফেকশন বা সংক্রমণ বোগ।
দীর্ঘদিন শরীরে ডায়াবেটিস থাকার বা রক্তে শর্করার পরিমাণ মাত্রায় বেশী হলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্তনালীর কিছু পরিবর্তন ঘটে। ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলি ভ্যাস্কুলার চেঞ্জ (Vascular Change)। আর ছোট রক্তনালীতে এই রকম পরিবর্তন হলে আমরা তাকে বলি “মাইক্রো ভ্যাস্কুলার চেঞ্জ” (Micro Vascular Change)। ফলে শরীরের কিডনি, চোখের রেটিনা স্নায়ু বা নার্ভ প্রভৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার বড় বড় রক্তনালীতে দীর্ঘদিন পরিবর্তন হলে তাকে বলা হয় মাইক্রো-ভাস্কুলার চেঞ্জ (Micro Vascular Change)। এই রোগের ফলে ব্রেন বা মস্তিষ্ক, পায়ের বড় বড় শিরা ধর্মনীতে, হৃদযন্ত্রে অসুবিধা বোধ হয়। রক্তে শর্করার ভাগ বেশী থাকলে রক্ত-নালীর দেওয়ালের ভিতরে পরিবর্তন দেখা দেবে ও দেওয়ালের ভিতর দিকে অমসৃণ ও খসখসে হয়ে যায়। ভেতরের দেওয়াল খারাপ হলে ট্রাই গ্লিসার রাড, ক্লোলেস্টেবল নালীর ভিতরে জমা হয়ে রক্ত চলাচলের পথকে সরু করে দেয়। পরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতেও পারে। রক্ত চলাচলের সরু রাস্তাকে ডাক্তাররা বলেন—অ্যাথোরোস ক্লোরোসিস্ (Athorose Clorosise)। ডায়াবেটিস রোগীদের অ্যাথোরোস ক্লোরোসিস্ থাকার সম্ভাবনা বেশী থাকে। ডায়াবেটিস রোগীদের রোগের কি কি জটিলতা তার আলোচনা করা যাক।

কিডনির জটিলতা
আমাদের শরীরে কিডনির কাজ কি সেটা জানা অবশ্যই দরকার। আমাদের শরীরের ভেতরে পিঠের নীচে (কোমরে) দিক ঘেঁষে ডান বা বাম পাশে দুটি কিডনি থাকে। বাংলা ভাষায় এক বলে বৃক্ক। খাদ্য কণা পরিপাক হয়ে কোষে কোষে যখন পৌঁছায়, পরে কোষগুলির ভেতর সেই খাদ্যের সঙ্গে অক্সিজেন মিশে শক্তি উৎপন্ন হয়। এই উৎপন্ন হওয়া শক্তিকে বলে বিপাক। এই বিপাক ক্রিয়ার উৎপন্ন এমন কিছু পদার্থ যেগুলি দেহের মধ্যে থাকলে বিভিন্ন রকম বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সেই বিষাক্ত পদার্থকে কিডনি প্রস্রাবের মধ্যে দিয়ে শরীরের বাইরে বের করে দেয়। কিডনি অনেকটা রক্ত পরিস্কারের ছাঁকনি মতো কাজ করে থাকে। খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম রক্তনালী থাকে কিডনির ভিতরে। রক্তনালীগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকলে, এতে বাধাপ্রাপ্ত হয় রক্তকে ছাঁকনি করার যে প্রক্রিয়া, এবং কিডনি ঠিক সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। এই অসুবিধাকে বলে ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি। রোগীদের কিডনির সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কলা ও কোষগুলিতে খুব কম পরিমাণে ইনসুনিল আসে এই কারণে কোষে শর্করার মাত্রা বাড়তে থাকে। রোগীর ইনসুলিনের অভাবে এই শর্করাকে বৃক্কের কোষগুলি ঠিকঠাক ভাবে কাজে লাগাতে পারে না।
অ্যালবুমিন এক ধরণের প্রোটিন। প্রস্রাবের দ্বারা এই প্রোটিন বেশি মাত্রায় বের হয়ে গেলে রোগীর হাত-পা ফোলে এবং সারা শরীর ফোলা ফোলা লাগে। পায়ের পাতা আঙ্গুল দিয়ে টিপলে কিছুক্ষণের জন্য গর্তের মতো হয়ে থাকে। কিডনির যে রক্ত ছাঁকনি করার ক্ষমতা আর বেশি গেলে তখন রক্তে ইউরিয়া ক্রিথেটিনিন মাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে রোগীর আস্তে আস্তে রেনাল ফেলইয়োর দিকে এগিয়ে যায়। এই অবস্থায় রোগীকে ডায়ালোসিস্ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
কিডনির অন্যতম কাজ হল শরীরের রেচন পদার্থ বাইরে বের করে দেওয়া। 15% থেকে 20% বাধাপ্রাপ্ত হলে তেমন কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু যদি ৪% বাধাপ্রাপ্ত হয়। তখন তাকে বেনাল ফেলইয়োর বলে। এক্ষেত্রে রোগীর কিডনি রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা বদল করতে হয়।
এই সমস্যা থেকে বেঁচে থাকার উপায়
১। রোগী বা তার পরিবারকে প্রথম থেকে সতর্ক হতে হবে।
২। রক্তে শর্করার, ইউরিয়া ও ক্রিয়োটিনিন পরীক্ষা ছয় মাস অন্তর করানো দরকার
ও ছয়মাস অন্তর প্রস্রাবের মাইক্রো অ্যালবুমিন পরীক্ষা করাতে হবে। ৩। তরকারীতে লবণের মাত্রা কম ও কোনোরকম কাঁচা লবণ খাওয়া চলবে না।
 

চোখের জটিল সমস্যা
ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকলে কম বয়স থেকে চোখে ছানি পড়ে। সংক্রমন হয়ে চোখ লাল হয়ে যাওয়া, চোখ দিয়ে জল পড়ে। চোখে পুঁজ হওয়া, সকালবেলায় ঘুম থেকে ওঠার সময় চোখের পাতা আটকে যাওয়া প্রভৃতি উপসর্গ দেখা যায়। ঘন ঘন চশমার পাওয়ার (Power) বেড়ে যাওয়া, অক্ষিপটের (রেটিনা) সমস্যা, এবং চোখের মারাত্মক ব্যাধি গ্লুকোমাতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ডায়াবেটিস হাই ব্লাড সুগারের ফলে চোখের রেটিনার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম রক্তনালী বা রক্তজালকগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় সূক্ষ্ম রক্তনালীগুলি ছিঁড়ে যায় বা এঁকে বেঁকে গিয়ে রক্তরস রক্তনালী থেকে বেরিয়ে এসে রেটিনাতে জমা হতে থাকে। ফলে রেটিনায় জল জমে এবং দৃষ্টি শক্তি একেবারে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
চোখের সমস্যা থেকে বাঁচার উপায়
১। ডায়াবেটিস রোগীদের প্রতি ছয় মাস অন্তর চোখের ডাক্তার দেখাবেন।
২। চোখের পাওয়ার (Power) মাপার সাথে সাথে উৎকৃষ্ট যন্ত্রের সাহায্যে রেটিনার,
পরীক্ষা করানো।
৩। হাই ব্লাড সুগার রোগীদের চোখের ব্যাপারে অত্যধিক সতর্ক থাকা, চোখের দৃষ্টি কম হলে উপেক্ষা না করে চোখের ডাক্তারের কাছে যাবেন।
 

ডায়াবেটিস রোগীদের হৃদরোগের সমস্যা
তথ্যানুযায়ী শতকরা ৬০% থেকে ৭০% রোগীর মৃত্যু হয়েছে হার্টডিজিসে বা ইসকিমিকে। হাই-ব্লাড সুগার রোগীদের মধ্যে রক্তনালী সরু হওয়ায় অ্যাথরোক্লোরাসিসের রোগের সম্ভাবনা বেশী। রক্তনালীর উপরে চাপ বাড়ে, রক্তচাপ বা হাইব্লাডপ্রেসার বাড়ে এবং বিভিন্নরকম জটিলতা দেখা যায়।
হৃৎপিন্ড থেকে আমাদের সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ হয়ে থাকে। এই কাজ চালনার ক্ষেত্রে নিজের পুষ্টি ও অক্সিজেন দরকার অবশ্যয়। করোনারী ধমনী হৃদপিণ্ডে পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। অ্যাথয়োক্লোরোসিসের ফলে করোনারী ধমনী সরু হয়ে যায় ফলে হৃদপেশীতে সঠিকভাবে পুষ্টি ও অক্সিজেন পৌঁছায় না। বিভিন্নরকম জটিলতা দেখা দেয় একেই বলে ইসকিমিক হার্ট ডিজিস্। সাধারণ মানুষের থেকে ডায়াবেটিস রোগীদের ইসকিমিক হার্ট ডিজিস্ হওয়ার সম্ভাবনা দুই থেকে তিন গুণবেশী। এইসব রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা বেশী হলে স্নায়ু বা নার্ভের কাজকর্ম বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ বা যন্ত্রে অসাড়তা দেখা যায়। রোগীদের ঠাণ্ডা গরম, স্পর্শ, ব্যথা প্রভৃতি ঠিকমতো বুঝতে পারে না। হার্ট অ্যাটাকের আগাম লক্ষণ হলো বাঁ হাত ব্যথা ও অসাড়তাবোধ ও বুকে ব্যথা। ডাক্তারী ভাষায় যাকে বলে 'অ্যনজাইনা পেক্টেয়িস্' (Angina Pectoris)। এরকম উপসর্গ দেখা দিলে তৎপর ডাক্তারের পরামর্শ নিলে এতে কিছুটা হলে বিপদ এড়ানো যায়। মধুমেয় রোগীদের বেশীরভাগ ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকে প্যারালিসি বা পক্ষাঘাতে শিকার হন। আবার অনেক ক্ষেত্রে ইসকিমিক হার্ট ডিজিস্ থাকলেও এইসব রোগীরা ‘অ্যাঞ্জিনাপ্রেক্টারিস্’ বা বুকের ব্যথা অনুভব করেন না। এর ফলে কোন উপসর্গ ছাড়ায় হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক হয়। এবং রোগীরা মারা যায়। আমাদের দেহে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ব্যথা-বেদনা স্নায়ুর মারফৎ মস্তিষ্কে পৌঁছালে আমরা সেইব্যথা অনুভব করি। এইসব রোগীদের স্নায়ুগুলি ক্ষতিগ্রস্ত বা অকেজো হওয়ার ফলে বুকের ব্যথার খবর সঠিক সময়ে মস্তিষ্কে পৌঁছায় না।
হৃদযন্ত্রের ডান অলিন্দে একটি ছোট্ট অঞ্চল আছে। এর বৈজ্ঞানিক নাম সাইনো অরিকুলার নোড (Sino-Auricular Node)। এখান থেকেই নির্দিষ্ট ছন্দের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সমস্ত অলিন্দ ও নিলয়ে ছড়িয়ে পড়ে ও হৃদযন্ত্রের সংকোচন প্রসারণ ঘটায়। আর ডায়াবেটিস্ রোগীদের অনেক সময়ে এই অরিকুলার নোড থেকে এই বৈদ্যুতিক সংকেত সময় মতো হৃদপেশির সব অংশে পৌঁছাতে পারে না। আবার হৃদস্পন্দন খুব দ্রুত, খুব
ধীর বা অনিয়মিত হয়ে হার্ট ব্লক হয়ে যেতে পারে।
এই রোগ থেকে বাঁচার উপায়
১। রোগীদের রক্তের ক্লোরেস্টল ও ট্রাই গ্লিসারাইড নিয়মিত পরীক্ষা করা ও যথারীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার।
২। বিশেষ করে বুকের বাম দিকে হলে কখনই অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। অবিলম্বে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ভালো ডাক্তারকে দেখানো উচিত। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে ই.জি.সি. ও কলার ডপলার পরীক্ষা আবশ্যিক।
 

ডায়াবেটিস রোগীর স্নায়ুর জটিলতা
এই ধরণের রোগীদের ২৫% থেকে ৩০% রোগীর স্নায়ু বা নার্ভের সমস্যা দেখা দেয়। দীর্ঘ শর্করার পরিমাণ বেশী থাকায় সূক্ষ্ম স্নায়ু কোষগুলি অক্সিজেন ও পুষ্টি ঠিকমতো পায়। স্নায়ুকোষগুলি বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, স্নায়ুকোষের ওপরে থাকা আবরণী কলা বা মাইলিন আবরণী। ডায়াবেটিস্ রোগীর স্নায়ুর ক্ষতি হলে বেশ কয়েক রকমের অসুবিধা দেখা যেতে পারে।
(১) হাত ও পায়ের প্রাম্ভিক সমস্যাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হলে হাত পা জ্বালা করা, ঝিমঝিম করা, ও কিছুক্ষণ বসে থাকলে হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে এমন উপসর্গ মনে হয়।
(২) মস্তিষ্ক থেকে যে স্নায়ুগুলি দূরে থাকে। যেমন—হাত-পা, এই স্নায়বিক সমস্যাকে বলে ‘পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি' হাত ও পায়ের জোর কমে আসে। হাত দিয়ে কিছু লেখা বা ধরা অসুবিধা হয়। আবার অনেক সময় পায়ের সামনের দিকে মারাত্মক ব্যথা অনুভব হয়।
(৩) বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণ এবং মল-মূত্রের বেগ এগুলি স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই স্বয়ংক্রিয় ডায়াবেটিস্ রোগীদের ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিভিন্ন রকম অসুবিধা দেখা দেয়। যেমন—রোগী শুয়ে থাকলে বা ঘুমোলে রক্তের চাপ ঠিক থাকে। কিন্তু বসে পড়লে বা উঠে দাঁড়ালে রক্তের চাপ হঠাৎ কমে যায়—ফলে মাথা ডায়াবেটিস্ রোগীরা কোষ্ঠবদ্ধতায় ভোগেন। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে পাতলা পায়খানা লেগে থাকে। ড্যান এর ফলে পিত্তথলির নড়াচড়া কমে যায়, ফলে পিত্তথলিতে পাথর হতে থাকে। পিত্তথলিতে ব্যথা হয় যাকে বলে কোলোসিস্টাইটিস। দীর্ঘদিন ব্লাডসুগারে ভুগলে যকৃৎ বা লিভারের কাজ ঠিক মতো হয় না। যারা মদ্যপান করেন তাদের জন্ডিসের সম্ভাবনা বেশী। আর যারা মদ্যপান করেন না তাদের ক্ষেত্রেও নন অ্যালকোহলিক স্টিয়াটোহেপাটোপিস' থেকে জন্ডিস হয়।
প্রতিরোধের উপায়
(১) রোগীর পেটের যত্ন নেওয়া দরকার।
(২) গ্যাস্টোএনন্টোলজিস্ট ডাক্তারের পরামর্শ একান্ত প্রয়োজন।

ত্বকের জটিলতা
ডায়াবেটিস্ রোগীদের স্কিন বা ত্বক প্রবলেম নিয়ে খুবই জটিল সমস্যা। কারণ এইসব রোগীদের রক্ত শর্করার মাত্রা বেশী থাকায় ত্বকে চুলকানি, ঘা, ত্বক ফুলে উঠতে থাকে। কোন ক্ষতে বা কোন জায়গায় ঘা হলে সহজে সারে না। এই রোগীদের রক্তে অত্যধিক শর্করার ফলে ত্বকে সংক্রমণ বা ফাংগাল ইনফেকশন হয়। পুরুষ ও মহিলাদের যৌনাঙ্গে র ত্বকে ইনফেকশন দেখা দেয়। তাছাড়া এইসব রোগীদের চুলকানি, শ্বেতী, ছুলি, ভিটি লোগো, সোরিয়াসিস প্রভৃতি রোগ পেশী হয়ে থাকে। এইসব চর্ম জাতীয় রোগকে ডাক্তারদের ভাষায় ‘ডায়াবেটিস্ ডার্মোপ্যাথি' বলে।
দেহে ত্বক সমস্যা প্রতিরোধের উপায় 
(১) ত্বকের সংক্রমণ বা ফাংগাল ইনফেক্শন রুখতে রোগীকে অবশ্যই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার। নিয়মিত কাচা জামাকাপড়, (বিশেষ করে অর্ন্তবাস যেমন— জাঙ্গিয়া, গেঞ্জী, প্যান্টি, ব্রা) প্রভৃতি কোন রকম ময়লা না থাকে।
(২) ৭ই রোগীর ক্ষেত্রে সবসময় সুতীর জামাকাপড় পরিধান করা উচিত। পোশাক
আশাক হবে খুবই ঢিলেঢালা। কখনোই আঁটোসাটো বা টাইট ফিটিং না হয়। 
(৩) রোগীর দেহ বা ত্বক অত্যাধিক ঘামলে বা তেলতেলে হয়ে থাকলে রোগীকে তেল না মেখে গরমকাল বা শীতকালে ভালো বডি অয়েল বা গোলাপ জল অ্যালকোহল দিয়ে দেহে মালিশ করলে উপকৃত হবেন।

ডায়াবেটিস রোগীর বুকের জটিলতা
রক্তে সুগারের মাত্রা অত্যাধিক থাকলে মানুষের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা একবোরে থাকে না। এইসব রোগীদের বুকের ভেতরের সমস্ত যন্ত্রপাতি সহজেই বিকল হয়ে পড়ে। বয়স বেশি হলে একটুতেই ঠাণ্ডা লেগে বুকে বা শ্বাসনালীতে কফ জমে সংক্রমণ জাতীয় সমস্যা দেখা দেয়। নানান সমস্যা বুকের মধ্যে হাজির হতে পারে যেমন—যক্ষ্মা, ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসে ঘা-ফোঁড়া, লাঙ্ক অ্যাবসেস্, নিউমোনিয়া প্রভৃতি অসুবিধা দেখা দেয়, আবার কম বয়সে যাদের ব্রঙ্কাইটিস্ বা নিউমোনিয়া হয়ে থাকলে বয়সকালে ডায়াবেটিস হলে সেই অসুবিধাগুলি পুনরায় ফিরে আসবে। এমনকি এই রোগীদের বুকে জল জমতে বা হাইড্রোথোরাক্স প্রভৃতি রোগে ভুগতে পারে। •
বুকের জটিলতা সমস্যার প্রতিরোধ
(১) রোগীর শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ বা বুকে ইনফেকশনের বিষয়ে সতর্ক থাকা একান্ত প্রয়োজন। গরম থেকে হঠাৎ ঠাণ্ডায়, গরম থেকে সরাসরি এ.সি. রুমে ঢোকা একেবারে চলবে না।
(২) গ্রীষ্মকালে ফ্রিজের জল খাওয়া চলবে না। গরমে শরীর ঘেমে থাকলে প্রথমে
বাতাসে শরীর ঠাণ্ডা করুণ তারপর জল পান করুন বা স্নান করুন। (৩) এই সমস্ত রোগীদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে শীতকালীন কয়েক মাস গরম জলে বা ঈষৎ উষ্ণ জলে স্নান করায় ভালো।

মানসিক জটিলতা
ডায়াবেটিস্ রোগীরা রোগ থেকে পুরোপুরি নিষ্কৃতি পাওয়ার চিকিৎসা-পদ্ধতি এখন আবিষ্কৃত হয়নি বললেই চলে। রোগীরা সঠিকভাবে নিয়ম মেনে (বিশেষ করে খাওয়া দাওয়া) চললে অনেকটা ভালো থাকা যায়। কোন মানুষের ডায়াবেটিস্ অত্যাধিকভাবে দেখা দিলে সেই রোগী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। জীবনে আর কিছু করার নেই জীবনটা বুঝি শেষ হয়ে গেল। এই রোগ হলে পড়ে মানুষের জীবনে কোন নিজস্ব ব্যক্তিত্ব বঞ্চিত হন! রোগের ক্ষেত্রে কিছু বিধি নিষেধ থাকে—যেমন খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, সব কিছুই মেনে চলতে হয়। এরজন্য অনেকেই মন থেকে মেনে নিতে পারে না। ফলে সুস্থভাবে জীবন-যাপনের সঙ্গে রোগীর মনের বিপরীত স্বত্ত্বাগুলির সঙ্গে লড়াই বেধে যায়। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এক অভাবনীয় ইচ্ছা রয়েছে। মনের মধ্যে থাকে বাধাহীন আনন্দ করার বাসনা। ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে এই দুই বাসনার সাথে শুরু হয় সংঘাত। ফলে রোগীর মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়। আর এই রোগের প্রতিষেধক ওষুধ খেলে তা থেকেও মানসিক অবসাদ আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মানুষের মস্তিষ্কে দুটো ভাগ থাকে।
(১) সেরিব্রাল কর্টেস, (Seribralla Corttage)
(২) লিম্বিক ব্রেন (Limbic Brain)
সেরিব্রাল কর্টেজের কাজ আমাদের বিচার, বুদ্ধি, যুক্তি সবকিছু নিয়ন্ত্রিত করা। এইসব কারণে এর আর এক নাম লজিক্যাল কর্টেজ। লিম্বিক ব্রেনের কাজ আমাদের উচ্ছ্বাস, আবেগ, প্রেম ভালবাসা।
শিশুরা যা কিছু শেখে, যেমন—কথা বলা, হাঁটাচলা, পড়াশুনা প্রভৃতি এসবই সেরিব্রাল কর্টেজে ভরা থাকে। এইসব রোগীদের ক্ষেত্রে যুক্তি-বুদ্ধি সঙ্গে আবেগ উচ্ছাসের সংঘাত লেগে যায়। তার ফলে বিভিন্ন ধরণের অসুবিধা দেখা যায়। এই সেরিব্রাল কর্টেজ ও লিম্বিক ব্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। এরফলে রোগীর অনেক সময় মাথার স্মরণশক্তির লোপ পায়। কোন রোগীর ব্লাডসুগার 350 mg/dl. স্বাভাবিক কারণে ডাক্তারবাবু রোগীকে বিভিন্নরকম বিধিনিষেধ আদেশ দিলেন। আবার রোগীর মস্তিষ্কের লিম্বিক জোন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে—যা নারে, এটা খেলে কি আর হবে? শেষে দেখা গেল রোগীর বাড়িতে আনা রয়েছে কিছু মিষ্টি সেইগুলি সবই ভক্ষণ করে ফেলল। এর ফলে ব্লাড সুগার অত্যাধিক হওয়াতে হাসপাতালে ভর্ত্তি করতে হলো।

মানসিক জটিলতা কমানোর উপায়
(১) রোগীদের অত্যধিক মানসিক চাপ কমাতে হলে নিয়মিত ধ্যান বা বেডিটেনন করানো দরকার। নিয়মিত যোগ-ব্যা য়াম, সকালে-সন্ধ্যেয় হাঁটা ইতাদির ফলে মস্তিষ্কের লিম্বিক জোনের কাজ কিছুটা হলেও হ্রাস পায়।
(২) কার্টিজল ও ধ্যানে অ্যাডরিনালিন (Addrinalin) হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়। এই উভয় হরমোন কম নিঃসরণ হলে রোগীর মানসিক চাপ কমে ও রোগীর ব্লাডসুগারের
মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।

যৌন জটিলতা
রোগীদের রক্তের শর্করার মাত্রা দীর্ঘদিন যাবৎ বেশি থাকলে যৌন বা দাম্পত্য জীবনে তার প্রভাব পড়ে। পুরুষ রোগীদের ক্ষেত্রে যৌন লিঙ্গ চামড়ায় ঢেকে থাকার ফলে চামড়ার (Prepuce) নানান্ ধরণের সংক্রমণ হয়ে থাকে। আবার অনেকক্ষেত্রে চামড়া ফেটে গিয়ে ব্যথা করে, ঘা হয় এবং এর থেকে চুলকায়।
মেয়েদের ক্ষেত্রে যোনির ত্বকে ছত্রাক বা ফাংগাসের সংক্রমণ হয়ে থাকে। এই রোগকে ক্যানডিডিঘাসিস (Candidasis) বলে। যোনি চুলকনি ও জ্বালা করতে থাকে।
পুরুষ যৌন লিঙ্গে তিন ধরণের মাংসপেশী থাকে। আবার এই মাংসপেশীর মধ্যে অসংখ্য শিরা ও উপশিরা থাকে। লিঙ্গ উত্তেজনার সময় এই শিরা উপশিরার মধ্যে দ্রুতবেগে প্রবাহিত হয়। এরফলে লিঙ্গ সোজা ও শক্ত হতে সাহায্য করে। অত্যাধিক ডায়াবেটিসের বা ব্লাডসুগারের ফলে এই শিরা উপশিরাগুলি অকেজো হয়ে পড়ে তারফলে ডায়াবেটিস রোগীদের লিঙ্গ উত্তেজনার সময় সোজা ও শক্ত হয় না। এরফলে যৌনমিলনে অক্ষমতা প্রকাশ পায়। ডায়াবেটিস রোগীদের যৌন-মিলনে অক্ষমতার ফলে মানসিক অবসাদ, মদ্যপানে আগ্রহ, আত্মতুষ্টির অভাব প্রভৃতি আরও বহু মনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
যৌন সমস্যার প্রতিষেধক
(১) ডায়াবেটিস্ রোগের চিকিৎসার সাথে সাথে ডাক্তারবাবুরা রোগীর মানসিক রোগ নিরাময় ‘মেন্টাল কাউন্সিলিং' সু-চিকিৎসা করেন।
(২) আবার অনেকক্ষেত্রে চিকিৎসকরা ভ্যাকুম সাকশন ডিভাইস, পেনিসপাম্প, জাতীয় যান্ত্রিক চিকিৎসা প্রয়োজন বোধ করেন। ইদানিংকালে এক ধরণের অপারেশন চালু হয়েছে যেমন—পেনাইল প্রন্থেসিস্। এই অপারেশন সাধারণ পুরুষদের ক্ষেত্রে হয়। পুরুষদের লিঙ্গের ভেতর বিশেষ ধরনের টিউব বা নল বসিয়ে দেওয়া হয়। যৌন সঙ্গমের সময় ওই টিউব বা নলে ইচ্ছেমতো হাওয়া ভরে যৌন সতেজ করে মিলন কার্য করা যায়। এই মধুর মিলনের ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের মনে তৃপ্তি ও আনন্দ লাভ করেন।