ডায়াবেটিস মেলিটাস রোগের প্ৰকাশ লক্ষণ

ডায়াবেটিস রোগাক্রান্ত ব্যক্তির শরীর দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। মত্রাধিক্য, অধিক পিপাসা ও ক্ষুধা এই রোগে চিরাচরিত লক্ষণ বলা যায়। তবে সব ক্ষেত্রে কিন্তু এইসব লক্ষণ দেখা যায় না। তরুণ বয়স্কদের ক্ষেত্রে এবং রোগ গুরুতরভাবে আক্রমণ করলে উপরোক্ত লক্ষণগুলি অল্পবিস্তর থাকবে।
এখানে একটা কথা বলে রাখা বিশেষ প্রয়োজন যে, ডায়াবেটিস রোগ একশ্রেণীর নয়। একে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, এবং তাদের লক্ষণও পৃথক পৃথক। এই শ্রেণীগুলির নাম হলো—১। প্রাক্-ডায়াবেটিস। ২। প্রচ্ছন্ন ডায়াবেটিস, ৩। গ্লুকোজ সহনে দুর্বলতা, ৪। কেমিক্যাল ডায়াবেটিস, ৫। ক্লিনিক্যাল ডায়াবেটিস।
১। প্রাক্-ডায়াবেটিস — একে ডায়াবেটিস প্রবণতাও বলা হয় এবং ইংরাজীতে বলা হয়—প্রিডায়াবেটিক স্টেট (Prediabatic state)। এক্ষেত্রে কতকগুলি পূর্বলক্ষণ দেখা যায়। যেমন—
(ক) যমজ সন্তানদের মধ্যে একজনের ডায়াবেটিস।
(খ) বাবা ও মায়ের উভয়েরই এই রোগ।
(গ) মা অথবা বাবা, যে কোনও একজনের ডায়াবেটিস।
(ঘ) নারীরা অধিক হৃষ্টপুষ্ট ও বেশী ওজনের সন্তান প্রসব করে। 
২। প্রচ্ছন্ন ডায়াবেটিস—ইংরাজীতে একে বলা হয় লেটেন্ট ডায়াবেটিস (Latent diabetes)। কিছু লোকের শারীরিক কোন প্রয়োজন সময়, কিংবা বিপাক ক্রিয়ার ওপর অধিক চাপ পড়লে—হাইপারগ্লাইসিমিয়া ও গ্লাইকোসুরিয়া দেখা যায়। আবার জরুরী অবস্থা কেটে গেলে কিংবা চাপ কমে গেলে আর হাইপারগ্লাইসিমিয়া থাকে না। তখন গ্লুকোজ সহন পরীক্ষা করলে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এইসব রোগীকে প্রচ্ছন্ন ডায়াবেটিস রোগী বলা হয়। সাধারণতঃ অধিক জীবাণু সংক্রমণ, বড় রকমের অপারেশন বা গর্ভাবস্থায় স্ত্রীলোকদের হতে দেখা যায়। ইংরাজীতে এই রোগকে স্ট্রেস ডায়াবিটিস বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস (Stress diabetes of Gestational diabetes) বলে।
৩। গ্লুকোজ সহনে দুর্বলতা—কিছু লোকের অভুক্ত অবস্থায় গ্লুকোজ পরীক্ষা করলে তা স্বাভাবিক দেখা যায়। কিন্তু গ্লুকোজ গ্রহণের পরে পরীক্ষা করলে দেখা যায় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ১২০-১৮০ মিলিগ্রাম। এইসব ব্যক্তিদের গ্লুকোজ সহনে দুর্বল ব্যক্তি বলা হয়। ডায়াবেটিস মেলিটাস রোগী বলে এদের বলা না গেলেও, এইসব ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ২।৩ জনের ডায়াবেটিস মেলিটাস রোগাক্রান্ত হয়।
৪। কেমিক্যাল ডায়াবেটিস—বাংলায় একে উপদ্রবহীন ডায়াবেটিস বলা হয়। কারণ এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তির দৈহিক উপদ্রব দেখা যায় না। এদের শারীরিক কোনও অসুস্থতা থাকে না বটে, কিন্তু হাইপারগ্লাইসিমিয়া ও গ্লাইকোসুরিয়া থাকে। গ্লুকোজ পরীক্ষায় ডায়াবেটিস মেলিটাস সূচক ফল দেখা যায়। এই সব ব্যক্তির রক্ত এবং প্রস্রাব পরীক্ষা করলে ডায়াবেটিস রোগ ধরা পড়ে। পরীক্ষা না করলে এরা যে এই রোগাক্রান্ত, তা বোঝা যায় না।
৫। ক্লিনিক্যাল ডায়াবেটিস—এতে ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলি প্রকাশ পায় বলে একে প্রকট ডায়াবেটিস বলা হয়।
এই সব রোগীদের মধ্যে লক্ষণগুলি বেশী কম প্রকাশ পায়। তবে এদের রোগের গুরুত্ব এবং অগ্রগতি এক রকম নয়। কোনও কোনও রোগীর রোগ আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত শারীরিক অবনতি হতে থাকে। সেই সময় যদি ইনসুলিন চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে ক্রমে ক্রমে মারাত্মক উপসর্গগুলি দেখা যায়। আবার কোনও কোনও রোগীর শরীর সামান্য খারাপ হয়। এদের ইনসুলিন চিকিৎসা না করলেও মারাত্মক উপসর্গ দ্রুতকালে আসেনা। বয়স, ইনসুলিনের প্রয়োজনীয়তা ও মারাত্মক উপসর্গ প্রভৃতির প্রবণতা অনুযায়ী এই ডায়াবেটিসকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এর একটি হলো—প্রথম শ্রেণী বা টাইপ ওয়ান (Type 1) এবং দ্বিতীয় শ্রেণী বা টাইপ টু (Tipe 2)।
প্রথম শ্রেণী(Type 1) — এটি হলো ইনসুলিন নির্ভরশীল ডায়াবেটিস মেলিটাস। এই শ্রেণীর রোগ অল্প বয়সে প্রকাশ পায়। এতে বংশগত প্রভাব থাকে খুব বেশী। আমাদের দেহাভ্যন্তরস্থ প্যাংক্রিয়াস আইলেটের বিটা কোষ থেকে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়। কিন্তু এই রোগ আক্রমণ করলে, ইনসুলিন নিঃসরণের মাত্রা বেশ কমে যায়। অর্থাৎ প্রয়োজন অনুযায়ী ইনসুলিন নিঃসরণ হয় না। তার ফলে এই সব রোগীর চিকিৎসায় বাইরের ইনসুলিন প্রয়োজন হয়। দ্বিতীয় শ্রেণী—এই শ্রেণীর রোগ ৪০ বৎসর বয়স্কদের ঊর্ধ্ব বয়স্ক এবং স্থূলাকায় ব্যক্তিদের বেশী হতে দেখা যায়। এই শ্রেণীতেও বংশগত প্রভাব বেশী দেখা যায়। এতে রোগের উপদ্রব খুব তীব্র হয় না। এদের দেহাভ্যন্তরে ইনসুলিন নিঃসরণ অব্যাহত থাকে। কিন্তু তার মাত্রা কমে যায়। ফলে প্রয়োজনের অপেক্ষা কম হয়। সেজন্য সব সময় এদের ইনসুলিন চিকিৎসা করা যায় না। মাঝে মধ্যে প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
৬। আনুষঙ্গিক ডায়াবিটিস—এই সব রোগীর হাইপারগ্লাইসিমিয়া ও গ্লাইকোসুরিয়া থাকে। এই রোগ প্যাংক্রিয়াসের গোলমালে আক্রমণ করে। ফলে প্যাংক্রিয়াস সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেজন্য একে প্যাংক্রিয়াটিক ডায়াবিটিসও বলা হয়।
আবার এণ্ডোক্রিন গ্রন্থির হরমোনের কার্বোহাইড্রেট-এর গোলমালে ইনসুলিনের বিপরীত ক্রিয়া হয়ে থাকে। এতে যে রোগ হয় তার মধ্যে আবার কোনও রোগে অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণ হলে যদি পরীক্ষায় হাইপারগ্লাইসিমিয়া থাকে, একে এণ্ডোক্রিম ডায়াবেটিস বলা হয়।
অধিকাংশ ডায়াবেটিস কতকগুলি লক্ষণ দেখে সন্দেহ করা হয়। যেমন বিনা কারণে দৈহিক অবসাদ, ওজন কমে যাওয়া, ফোঁড়া, খোস-পাঁচড়া হওয়া, কার্বাঙ্কল, সামান্য ক্ষত হলেই জীবাণু দূষণ। ক্ষত আরোগ্য হতে বিলম্ব, মেয়েদের যোনিদ্বারে চুলকানি প্রভৃতি প্রাথমিক লক্ষণ বলে ধরা হয়। অনেক ক্ষেত্রে আবার প্রাথমিক উপসর্গ থাকে না, রোগ প্রচ্ছন্নভাবে বৃদ্ধি পেয়ে গুরুতরভাবে উপসর্গ দেখা যায়।

ডায়াবেটিস মেলিটাস রোগের বিভিন্ন পরীক্ষা
মূত্র পরীক্ষা— ডায়াবেটিস সন্দেহ হলে মূত্র পরীক্ষা করা একান্ত দরকার। তাহলেই রোগটি ধরা পড়ে। ডায়াবেটিস রোগীর সব সময়েই প্রস্রাবে গ্লুকোজ থাকবে। রোগ যদি তীব্র না হয়, তাহলে সকালে খালিপেটে প্রস্রাবে অনেক সময় গ্লুকোজ থাকে না।
এইজন্য রোগটি ডায়াবেটিস কিনা সঠিক সিদ্ধান্তে আসার জন্য পরীক্ষা করতে হলে, রোগীকে প্রথমে ২০০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট খাদ্যযুক্ত খাদ্য খাইয়ে ২ থেকে ৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্রাব পরীক্ষা করে দেখা দরকার। যদি প্রস্রাবে গ্লুকোজ পাওয়া যায়, তাহলে গ্লুকোজের পরিমাণ নির্ধারণ করা দরকার। আহারের পরে মূত্রে শতকরা ১% বা তার বেশী গ্লুকোজ থাকলে ডায়াবিটিস বলে জানতে হবে। এর কম হলে অন্য কোনও রোগ বলে জানতে হবে। আহারের পরে প্রস্রাবে গ্লুকোজ না থাকলে সেটা ডায়াবেটিস রোগ নয় বলে জানতে হবে।
রক্ত পরীক্ষা— এই রোগে বিশেষ পরীক্ষা হলো রক্ত পরীক্ষা। অনাহারী অবস্থায় প্রতি ১০০ মিঃ লিঃ রক্তে ১২০ মিঃ গ্রাঃ-এর ওপর গ্লুকোজ থাকলে ডায়াবেটিস বলে জানতে হবে। রোগ যদি মৃদু হয় তাহলে, অনাহারী অবস্থায় পরীক্ষা করলে গ্লুকোজ স্বাভাবিক থাকতে পারে। এজন্য গ্লুকোজ সহন পরীক্ষা অর্থাৎ জিটিটি করে দেখতে হবে। এই রোগ সম্বন্ধে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে হলে রোগীকে কিছু না খাইয়ে ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাইয়ে ২ ঘণ্টা পরে রক্ত পরীক্ষা করলেই নিঃসন্দেহ হওয়া যায়।
যাদের বংশগতভাবে এই রোগ আছে কিংবা রোগীর পূর্ব ইতিহাসে ডায়াবেটিস রোগের কিছু সূত্র পাওয়া যায়, তাদের পক্ষেও স্থির সিদ্ধান্তে আসতে হলে গ্লুকোজ সহন পরীক্ষা করে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
পরীক্ষা দ্বারা রোগ সঠিক ধরা পড়লে সেটা কোন্ শ্রেণীর ডায়াবেটিস স্থির করতে হয়। তারপর শ্রেণী অনুযায়ী রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়। প্রথম শ্রেণীর ডায়াবিটিস খুব তীব্র হয় এবং এতে মারাত্মক উপসর্গ ও কোমার আশঙ্কা থাকে। এজন্য শ্রেণী অনুযায়ী শারারিক পরীক্ষা করতে হয়।
শ্রেণী বিভাগ—বংশগত এই রোগের ইতিহাস থেকে রোগের শ্রেণীবিভাগ হয়। দ্রুত দৈহিক ওজন হ্রাস পায়। অতিরিক্ত জলপিপাসা, বহুমত্র প্রভৃতি গুরুতর রোগের লক্ষণ। বিস্তৃত শোথ নেফ্রোপ্যাথির লক্ষণ।