ইনসুলিনের অভাব প্রকৃত বা আপেক্ষিক হলে হাইপারগ্লাইসিমিয়া হয়। রক্তে গ্লুকোজ ১৮০ মিঃ গ্রঃ/১০০ মিঃ লিঃ অতিক্রম করলে প্রস্রাবে গ্লুকোজ নিঃসরণ হয়। আবার হাইপারগ্লাইসিমিয়া রক্তে কিছু জৈব-রাসায়নিক এবং ভৌত-রাসায়নিক পরিবর্তন সৃষ্টি করে বটে কিন্তু সরাসরি দৈহিক কোন অসুবিধা সৃষ্টি করে না। এর ফলে ডায়াবেটিস রোগীর জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। অনকে ডায়াবেটিস রোগীর অন্য কোনও উপসর্গ না থাকলেও কার্বাঙ্কল, ফোঁড়া ইত্যাদি প্রায়ই হতে দেখা যায়।
প্রস্রাবে গ্লুকোজ অধিক নিঃসরণের জন্য বহুমূত্র দেখা যায়। পিপাসা বৃদ্ধি পায়। প্রসাবের দ্বারে জীবাণু বা ছত্রাক সংক্রমণের ভয় থাকে। অনেক সময় ক্ষত সৃষ্টি হয়। স্ত্রীলোকের এটি বেশী হতে দেখা যায়।
দেহে ইনসুলিনের অভাবে দেহকোষগুলি গ্লুকোজ বিপাক করে শক্তি উৎপাদন করতে না পারায় কতকগুলি প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যেমন—–অধিক ক্ষুধা পায়। ফলে রোগী অধিক . খাদ্য গ্রহণ করে। এজন্য অধিক গ্লুকোজ বাইরে থেকে দেহে আসে। দেহ মধ্যস্থিত গ্লুকোজ উৎপাদন বেড়ে যায়, শরীর ক্ষয় হতে থাকে। দুর্বলতা দেখা দেয়। গ্লুকোজের আধিক্য থাকা সত্ত্বেও দেহকোষগুলি তা গ্রহণ করতে পারে না এবং তার সদ্ব্যবহার করতেও পারে না। সেজন্য অধিক গ্লুকোজ আহরণ করেও অভাব থেকে যায়।
গ্লুকোজ বিপাকের স্বাভাবিক বিক্রিয়ার ফলে ফ্যাট বিপাক অসম্পূর্ণ থাকে, এবং কিটোন জাতীয় কিছু মধ্যবর্তী উপজাত পদার্থ জমে যায়। এরই নাম কিটোসিস। কিটোন যৌগগুলি দেহে অ্যাসিড বাড়িয়ে দেয়, এতে যে বিষক্রিয়া হয়, তার পরিণামে সংজ্ঞালোপ অর্থাৎ কোমা (Coma) হয়। এই যৌগগুলিই অ্যাসিটোন আকারে প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যেতে থাকে।
ইনসুলিন অভাবে এই রোগ যদি অল্প বয়সে প্রকাশ পায়, তাহলে কিটোসিস হবার আশঙ্কা থাকে। ইনসুলিন চিকিৎসা আবিষ্কারের পূর্বে এই ধরনের রোগীর ৬ মাসের মধ্যেই কোমা হ’তো এবং মৃত্যু হতো।
মধ্যবয়স্ক এবং স্থূলকায় লোকের এই রোগ হয় ইনসুলিনের আপেক্ষিক অভাবে। সাধারণতঃ এদের কিটোসিসের ভয় থাকে না। তবে এদের ফোঁড়া বিষাক্ত ব্রণ, কার্যাঙ্কল, সেলুলাইটিস, টিউবারকলেসিস প্রভৃতি রোগ হয়।
ডায়াবেটিস রোগ বেশীদিন স্থায়ী হলে রক্তবাহী ধমনী ও উপধমনীতে যে রোগ হয়। তার নাম অ্যাথিরোস্ক্লেরোসিস্। আবার উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান প্রভৃতি কারণেও এই রোগ হয়ে থাকে।
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির কৈশিক নালীতে অর্থাৎ ক্যাপিলারী ভেসেলস্ (Capillary vessels)-এ বিকৃতি দেখা দেয়। এর নাম ক্যাপিলারী অ্যাজিওপ্যাথি। এই রোগে চক্ষু ও কিডনী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আবার অ্যাথিরোস্ক্লেরোসিনের আক্রমণে হৃৎপিণ্ড, স্নায়ুতন্ত্র ও দেহের নিম্নাংশের প্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ডায়াবেটিস রোগের উপসর্গ
এই রোগে সাধারণতঃ তিন রকম উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন—(১) জীবাণু সংক্রমণ। (২) বিপাকীয় বিকৃতি। (৩) রক্তনালীর অবক্ষয়।
(১) জীবাণু সংক্রমণ জনিত উপসর্গ —: এই উপসর্গ থেকে দেহে বিষাক্ত ব্রণ, ফোঁড়া,
পাঁচড়া এবং কার্বাঞ্চল হতে থাকে বার বার। ফুসফুসের বিকৃতি ঘটিয়ে—ফুসফুসে ফোঁড়া, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা প্রভৃতি দেখা দেয়। কিনী আক্রমিত হয়ে কিড্নীর রোগ দেখা দেয়।
(২) বিপাকীয় বিকৃতি উপসর্গগুলি রক্তের অধিক গ্লুকোজ বৃদ্ধি পেয়ে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পায়, তার ফলে সংজ্ঞাহীনতা বা কোমা হয়। ইনসুলিন ব্যবহার না করার ফলে শেষ পর্যন্ত এই অবস্থা দেখা দেয়। এই অবস্থায় আসার আগে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়, যেমন—অত্যন্ত পিপাসা, অস্থিরতা বোধ, পেটে বেদনা, বমি বা বমনেচ্ছা, মানসিক অবসাদ। এই অবস্থা দেখা গেলে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কারণ কোমা যাতে না আসে, তার ব্যবস্থা তৎক্ষণাৎ করা প্রয়োজন। ডায়াবেটিস রোগে কোমা হলে মারাত্মক উপসর্গ।
(৩) রক্তনালীর অবক্ষয়ের কারণ উপসর্গ — এতে কিড্নি আক্রমিত হয়ে সেটা অচল হয়ে পড়ে। এরপর চক্ষু আক্রমিত হয়ে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে থাকে। স্নায়ু আক্রমিত হয়ে অকেজো করে তোলে।
ডায়াবেটিস রোগীর সমস্যা এই রোগে সব থেকে সমস্যা দেখা দেয় মেয়েদের ক্ষেত্রে। কারণ গর্ভবতী স্ত্রীলোকের কার্বোহাইড্রেট বিপাকের ওপর খুব বেশী চাপ সৃষ্টি হয়। সেই সময় গ্লুকোজ সহনশক্তি কমে যায় বা দুর্বল হয়ে যায়। অনেকের গ্লাইকোসুরিয়া হতে পারে। একে বলা হয় জেস্টেসনাল ডায়াবেটিস। তবে এটা সব ক্ষেত্রেই হয় না। যাদের বংশগত ডায়াবেটিস আছে, কিংবা প্রচ্ছন্ন অবস্থায় ডায়াবেটিস আছে, সেইসব স্ত্রীলোকের এটা বেশী হয়।
যাদের ডায়াবেটিস রোগ আছে, তারা গর্ভবতী হলে রোগ বৃদ্ধি পায় এবং তার ফলে কিটোসিসেব ভয় থাকে। এইরকম স্থলে অত্যন্ত সাবধানে এবং চিকিৎসাধীনে থাকতে হয়।, চিকিৎসার সাহায্যে হাইপারগ্লাইসিমিয়া আয়ত্তে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। এই ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে গর্ভিনী ও গর্ভস্থ সন্তানের সম্পূর্ণ বিপদের সম্ভাবনা। অপর পক্ষে হাইপোগ্লাইসিমিয়াও অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে ইনসুলিন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে গর্ভাবস্থায় ইনসুলিন ব্যবহার কম, আবার কখনও বেশী ব্যবহার করতে হয়। এজন্য বার বার রক্ত পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
যাদের ডায়াবেটিসের কোনও লক্ষণ প্রকাশ পায় না, অথচ এই রোগ প্রচ্ছন্নভাবে দেহে বিদ্যমান, এইসব স্ত্রীলোকের গর্ভপাত হবার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে আবার গর্ভপাত না হলেও মৃত সন্তান প্রসব করে। তাছাড়া যদি চিকিৎসা না করা হয়, তাহলেও এদের সন্তান স্বল্পায়ু হয়।
বর্তমানে এই ভয়টা অবশ্য অনেক কমেছে। বর্তমানে উন্নত ধরনের চিকিৎসার ফলে এবং ইনসুলিন চিকিৎসার ফলে হাইপারগ্লাইসিমিয়া আয়ত্তে রাখা সম্ভব হচ্ছে। ফলে গর্ভবতী স্ত্রীলোকের এবং তার গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু হার অনেক কমে গেছে। তবে প্রসূতিকে গোড়া থেকেই চিকিৎসাধীনে থাকতে হবে।
যে সব স্ত্রীলোক দীর্ঘদিন এই রোগে ভুগছেন অর্থাৎ ১৫-২০ বছরেরও বেশীদিন এই রোগে আক্রান্ত, তারা গর্ভবতী হলে বিপদের আশঙ্কা খুব বেশী। এসব ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির দ্বারা যাতে চিরদিনের মতো গর্ভবর্তী না হয়, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
ডায়াবেটিস রোগিনীর সদ্যজাত শিশুর ওজন বেশী হয়। যাদের প্রচ্ছন্ন বা গুপ্ত ডায়াবেটিস আছে, তাদের ক্ষেত্রেও এটি হয়। যদি কোনও স্ত্রীলোকের ডায়াবেটিস রোগের কোন রকম লক্ষণই প্রকাশ না পায়, অথচ তার সন্তানের ওজন অস্বাভাবিক হয়, তাহলে তৎক্ষণাৎ সেই স্ত্রীলোককে পরীক্ষা করে চিকিৎসা করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে তার ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলি দেখা দেবে এবং মারাত্মক হয়ে দাঁড়াবে। অল্প বয়সে এই রোগ হলে চিকিৎসা করা সমস্যার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এই সব বয়সে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন, খাদ্য সংযম এবং নিয়মিত সময়ে খাওয়া, লেখা পড়া, খেলা-ধুলা প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ খুবই সমস্যামূলক হয়ে দাঁড়ায়। শিশুদের আকস্মিক দৈহিক শ্রম, মানসিক উত্তেজনা, ভাবাবেগ প্রভৃতি বেশী হয়। এজন্য ইনসুলিন ব্যবহারে তাদের হাইপোগ্লাইসিমিয়া হবার আশঙ্কা খুব বেশী থাকে।
তাছাড়া রোগের গুরুত্ব, চিকিৎসার বিধি-নিষেধ এবং অন্যান্য নিয়ম পালনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন থাকা শিশুদের কাছে আশা করা যায় না। এজন্য চিকিৎসক, শিক্ষক, অভিভাবক প্রভৃতি সকলেরই বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। তাদের আহার পথ্য, অন্যান্য বিধিনিষেধ সম্বন্ধে বুঝিয়ে দিতে হবে। রোগেরগুরুত্ব সম্বন্ধে বুঝিয়ে বলতে হবে। চিকিৎসা, ঔষধ ও পথ্য সম্পর্কে অবহেলা করলে শেষ পরিণতিতে নানারকম সংক্রামক রোগ কিটোসিস ও কোমার কথাও তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে।
ডায়াবেটিস রোগী বা রোগিনীর যদি কোনও সময় অপারেশন করার জরুরী দরকার হয়ে পড়ে, তাহলে পরীক্ষা করে দেখতে হবে রোগের অবস্থা কি রকম। রোগ সম্পূর্ণ আয়ত্তে আছে কিনা। হাইপারগ্লাইসিমিয়া সব সময় নিয়ন্ত্রিত রাখতে হয়। তা না হলে ক্ষত সারতে খুব দেরী হয়। জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীর অপারেশন সময় উপযুক্ত মাত্রার গ্লুকোজ ও ইনসুলিন শিরায় সেলাইনের মত বিন্দু বিন্দু দিতে হয়। অপারেশন নির্বিঘ্নে হয়ে যাবার পর ৪/৫ দিন পর্যন্ত বার বার রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। রক্ত পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী উপযুক্ত খাদ্য এবং ইনসুলিন প্রয়োগ করতে হয়।
এইসব রোগীদের উপযুক্ত পরীক্ষা না করে অপারেশন করলে বা অন্য কোনও কারণে রক্তপাত হলে, আকস্মিক দুর্ঘটনায় পড়লে সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। তা না হলে কিটোসিস ও কোমা হতে পারে।
ডায়াবেটিস রোগীর ভবিষ্যৎ বর্তমান যুগে উন্নত ধরনের চিকিৎসার দ্বারা ডায়াবেটিস রোগকে নিয়ন্ত্রিত করে রোগীকে মোটামুটি সুস্থ ও দীর্ঘায়ু রাখা হচ্ছে। এজন্য অবশ্য রোগীকে সতর্ক থাকতে হবে। আহার, পথ্য, ইনসুলিন, ইঞ্জেকশন ও অন্যান্য ওষুধ নিয়মিত ব্যবহার করতে হবে।
এই সঙ্গে প্রস্রাব ও রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদি করাতে হবে। রোগের তীব্রতা ও স্বল্পতা অনুযায়ী সব বাধা-নিষেধ মেনে চলতে হবে। এইভাবে চললে ডায়ারেটিস রোগী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। আগেই বলা হয়েছে ডায়াবেটিস রোগ কয়েক প্রকার। অতএব এই রোগের প্রকারভেদ অনেক রোগীর কমবেশী হাইপারগ্লাইসিমিয়া বা গ্লাইকোসুরিয়া থাকা সত্বেও এবং নিয়মমাফিক চিকিৎসা না করেও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে।
আবার প্রকারভেদে কিছু কিছু রোগীর দ্রুত অবনতি হয়। তখন চিকিৎসা করেও রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কারও আবার একটা অঙ্গ অসাড়, পঙ্গু, অকর্মণ্য, দৃষ্টিহীনতা, হৃদরোগ আক্রমণ করে। এবার মানদেহে শর্করা কিভাবে দেহোপযোগী হয়, পরবর্তী অধ্যায়ে তার আলোচনা করা হলো!