দেহের কর্মক্ষমতা বজায় রাখার জন্য, দেহ বৃদ্ধির জন্য এবং শক্তি বৃদ্ধির জন্যই আমরা খাদ্য গ্রহণ করি। মানুষের আহারের তিনটি ভাগ। যেমন—১। মাংস, ডিম, মাছ ইত্যাদি প্রোটিন জাতীয় খাদ্য। ২। তেল, ঘি, মাখন ইত্যাদি এবং ৩। কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাদ্য অথবা তরি-তরকারী, আলু, রুটি, ভাত প্রভৃতি থেকে স্টার্চ জাতীয়।
উপরোক্ত তিন প্রকার খাদ্যের মধ্যে যখন শারীরিক কারণে একটিও অব-শোষণ বা উপযোগ সংক্রান্ত কোন দোষ-ত্রুটি দেখা দেয়, তখন শারীরিক ক্রিয়ায় গোলমাল দেখা দেয়। যদি প্রোটিন জাতীয় খাদ্য গ্রহণে বা অবশোষণে শরীর অক্ষণ হলে যে অসুবিধা সৃষ্টি *হয়, তার দ্বারা স্নেহ জাতীয় খাদ্য শোষণ-এর উপর তার প্রভাব পড়ে। আবার স্নেহ জাতীয় খাদ্য অবশোষণে শরীর অক্ষম হলে কার্বোহাইড্রেটের উপর তার প্রভাব পড়ে। আর কার্বোহাইড্রেটের অসামঞ্জস্যতা বা গোলমালের ফলে মধুমেহ রোগ আক্রমণ করে। সেই সঙ্গে অপর দু'টি খাদ্যের উপরেও প্রভাব বিস্তার করে।
মানব দেহে শুধুমাত্র একপ্রকার আহার বা খাদ্য সামগ্রীর ওপর নির্ভর করে না। আর দেহও তাতে কর্মক্ষম থাকে না। শরীরের সাহায্যে আহার বা খাদ্য সামগ্রীকে শারীরিক প্রয়োজনে লাগানোর ক্রিয়াকে বলা হয় মেটাবলিজম (Metabolism)। এর প্রধান কাজ হলো খাদ্যসামগ্রীকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে পরিবর্তন করা বা তাকে বিঘটিত করে শক্তিতে রুপান্তরিত করা। এই ভাবে খাদ্য সামগ্রীর সার পদার্থকে দেহে গ্রহণ করে অসার বস্তুকে জল বা মল ইত্যাদি রূপে অথবা কার্বন-ডাই-অক্সাইড রূপে দেহ থেকে বাইরে বের করে দেওয়া।
আলু ও অন্যান্য তরি-তরকারী বা শাকসবজি, রুটি, শর্করা, মিষ্টি, কেক ইত্যাদি, যাকে আমরা কার্বোহাইড্রেট্স বলি। এই সর্বপ্রকার খাদ্যবস্তু প্রথমে মুখের পাচক রস অর্থাৎ লালা (Saliva) দ্বারা মিশ্রিত হয়ে পাচক সংস্থানে যায়, সেখানে আমাশয় এবং অস্ত্রের পাচক রসে মিশ্রিত হয়ে গ্লুকোজে পরিবর্তিত হয়।গ্লুকোেজ রক্তের সাহায্যে দেহের প্রত্যেক কোষ (cell), অর্থাৎ মস্তিষ্ক থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত পৌঁছায়।
আহার গ্রহণ করার পর ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে রক্তে শর্করা বৃদ্ধি পেয়ে দেহের কোষের দ্বারা নিজের কাজের উপযোগী করে নেয়। পরে আর একবার এতে রাসায়নিক পরিবর্তন হয়। গ্লুকোজকে রক্ত থেকে কোষে স্থানান্তরকরণের জন্য ইনসুলিন নামক বস্তুটি বিশেষ কাজ করে। মানবদেহের কোষগুলির মধ্যে এনজাইম (Enzyme) নামক বস্তুটি বিশিষ্ট ক্রিয়ার দ্বারা রাসায়নিক পরির্তন হয়। এর দ্বারা দেহে শর্করা থেকে শক্তি সঞ্চয় হয়। অথবা দেহে গ্লাইকোজেননের (Glycogen) রূপে সঞ্চিত হতে থাকে।
দেহের কোষগুলিকে শক্তিশালী করার জন্য গ্লুকোজ ইন্ধন রূপে দহন হয়ে জল এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড রূপে পরিত্যক্ত হয়, আর কতকগুলি নালিকা তাকে দেহ থেকে পরিত্যাগ করার জন্য মলদ্বার পর্যন্ত নিয়ে যায়। আবার শ্বাস ত্যাগ দ্বারাও দেহমধ্যস্থ কার্বন ডাই-অক্সাইড দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। গ্লাইকোজেন গ্লুকোজের এটি বিশিষ্ট পরিবর্তিত রূপ। এর প্রয়োজন হয়, তখন, যখন দেহের কোষগুলির শক্তি আব্যশক হয় বা কোষগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে।
দেহের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন কোষগুলিকে ও রক্ত গ্লুকোজকে বিভিন্ন কার্যে প্রযুক্ত করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুসমূহের কোষে কোনও দূষিত পদার্থ সঞ্চিত হতে দেয় না। সেজন্য এটি তাড়াতাড়ি দেহের প্রয়োগে কাজ করে। এই প্রক্রিয়া দেহের অভ্যন্তরে নিরন্তর চলছে। হৃদপিণ্ডের পেশীর কোষেও কিছু সঞ্চিত করে না। অপরদিকে যকৃতে গিয়ে যতোটা রক্ত শর্করা পরিভ্রমণ করে পৌঁছায়, তাকে গ্লাইকোজেনের রূপে অথবা মেদরূপে সঞ্চিত হয়ে যায়।
মেদ অর্থাৎ চর্বি দেহের একটি সঞ্চিত পদার্থ। যখন গ্লুকোজ যকৃতে পৌছায়, বিশিষ্ট এন্জাইম দ্বারা ওতে পুনরায় পরিবর্তন হয়। যার ফলে চর্বিযুক্ত অ্যাসিডের রূপ ধারণ করে। রাসায়নিক দৃষ্টিকোণ থেকে একে ট্রিগ্লিসিরাইড (Triglyceride) বলা হয়। এটি আবার রক্তের সঙ্গে সারা দেহে পরিভ্রমণ করে, অপর স্থান, যথা—পেট, ত্বকের নিম্নভাগে, বুকে, জানুদ্বয়ে, নিতম্বে চর্বিরূপে সঞ্চিত হতে থাকে।
এইরূপে যে ব্যক্তি বেশী খাদ্য গ্রহণ করে, অথবা নিজের শরীরের কোষগুলির প্রয়োজনের অধিক কার্বোহাইড্রেট্স জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করে, সেই ব্যক্তি মোটা হতে থাকে। এইরূপে যখন শরীরকে কার্বোহাইড্রেটস-এ শক্তিতে বঞ্চিত রাখা যায়, অথবা শরীরের অধিক শক্তির আবশ্যকতা হয়। তা যদি খাদ্যের সাহায্যে প্রাপ্ত না হয়, তাহলে চর্বি গলে যেতে শুরু করে ও দেহের মেটাবলিজম্ চক্রান্ত বিপরীত হয়ে যায়। তখন মেদ একটি অ্যাসিকে পরিণত হয়ে যায়। এই অ্যাসিডকে বলা হয় কিটোন (Ketone)। যকৃত এই কিটোনকে পুনরায় গ্লুকোজে অবশোষণ করতে থাকে। এই রকম হলে বা কোনও রোগাক্রমণ করলে দেহের চর্বি এবং ওজন কমে যেতে থাকে, ফলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে।
এখন জানা দরকার মধুমেহ বা ডায়াবেটিস কি? এবং কি করে হয়? একটা কথা এখানে স্মরণ রাখা দরকার যে, সুস্থ মানুষের দেহে উপরিলিখিত রাসায়নিক প্রক্রিয়া সর্বদাই চলতে থাকে। অল্প খাদ্য গ্রহণ বা উপবাস করে থাকলে শরীর বেশী সময় সুস্থ থাকে না। মানুষ যত লম্বা চওড়া হোক না কেন, কয়েক সপ্তাহ খাদ্য গ্রহণ না করে উপবাস থাকলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। সেইরকম আবার অল্প সময়ের জন্যে অধিক শক্তির প্রয়োজনে এবং কম ভোজন করলে, দেহের সঞ্চিত মেদ খরচ হতে থাকে। ফলে রক্তে শর্করা স্তর স্থির থাকে। যাতে মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের পেশীসমূহ ঠিক কাজ করে। গলে যাওয়া চর্বি বা খরচ হওয়া চর্বি রক্তপ্রবাহ কিটোন রূপে বিদ্যমান থাকে।
গর্ভবর্তী নারীর প্রস্রাবে প্রসবকালীন কিটোন এ্যাসিটোন (Kitone Acetone) রূপে প্রকাশ পায়।এই লক্ষণ দেখা দিলে বুঝা যায় যে নারী সন্তান ভূমিষ্ঠ করার শক্তি লাভ করেছে।