ইনসুলিন যার দেহে কম আছে এইরূপ মধুমেহ রোগীর মেটাবলিজম্ (Metabolism) চক্র সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ হয় না এবং রক্তের শর্করা দেহস্থ কোষগুলিতে সঞ্চারিত হয় না। এর আগেই বলেছি যকৃতে গ্লুকোজের কিটোন মেদ-এর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে একমাত্র ইনসুলিন। এইজন্যই ইনসুলিনের বিশেষ আবশ্যক।
অতএব মানবদেহে প্রয়োজনের কম ইনসুলিন উৎপন্ন হলে দেহস্থিত কোষগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। দেহস্থিত চর্বি গলে যেতে শুরু করে, দেহের ওজন কমে যায় ও সেই সময় কিটোসিসের (Ketosis) পরিস্থিতে দেখা দেয়। রক্তে অনুপযোগী শর্করা (sugar) কিটোস ও মেদযুক্ত অ্যাসিড খুব বেড়ে যেতে থাকে।
ইনসুলিনের প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো কার্বেহাইড্রেটসকে শক্তিতে রুপান্তরিত করা এবং দেহের মেদযুক্ত অ্যাসিডকে, যা খাদ্যরূপে গ্রহণ করি, তাকে দেহোপযোগী করে তোমায় সাহায্য করা। দেহে কোনও রকম অসুবিধা দেখা দিলে বা দেহ অসুস্থ হয়ে পড়লে, দেহস্থিত সঞ্চিত প্রোটিনকে শক্তিতে রূপান্তরিত করার জন্য গলে যেতে থাকে। তার জন্য চর্বি কমতে থাকে। দেহের স্থূলতা কমে গিয়ে দেহ কৃশ হতে থাকে। এই রকম ইনসুলিনের কাজে কোন গোলমাল দেখা দিলে সারা দেহের মেটাবলিজম্ ক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটে।
সুস্থ ব্যক্তির অগ্নাশয় দ্বারা ইনসুলিন ক্ষারণ সাধারণত: খারাপ নয়। আহার গ্রহণের পর ৩০ থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যে এবং ক্ষুধার্ত অর্থাৎ খালি পেটে থাকা কালীন উপস্থিত শর্করার (fasting blood sugar) মাত্রা ১৫০ মি. গ্রা. প্রতি ১০০ মি. লি. রক্ত পর্যন্ত বেড়ে যায়। এই বেড়ে যাওয়া রক্ত শর্করা (Blood sugar) অগ্ন্যাশয়কে জানিয়ে দেয় যে, ইনসুলিনের আরও বেশী আবশ্যকতা আছে।
এইভাবে অগ্ন্যাশয়ের আইলেট কোষ বেশী পরিমাণে ইনসুলিন ক্ষরিত করে শর্করার স্তরকে কমিয়ে আনে। রক্ত-শর্করা স্তরে সমানতা এনে আইলেট কোষ বিশ্রাম পায় এবং ইনসুলিন ক্ষরণ ও তার ব্যয় হওয়াটাও কম হয়ে যায়। যদি রক্তে শর্করার স্তর ১৭০ মি. গ্রা. প্রতি ১০০ মি. লি. থেকে বেশী বেড়ে যায়, তাহলে অগ্ন্যাশয় ও অন্যান্য পরিপাক যন্ত্রের কোন এই শক্তিশালী বস্তু সহজে পরিপাক করতে পারে না। তখন ঐ পদার্থ মূত্র দ্বারা দেহ থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করে। একে গ্লাইকোসুরিয়া (Glycosuria) বলে। এটিই হলো অধিকাংশ ব্যক্তির মধুমেহ বা ডায়াবেটিস হবার প্রারম্ভিক লক্ষণ।
অনেক ক্ষেত্রে আবার বেশী মিষ্টদ্রব্য ভোজন বা গুরুপাক খাদ্য খাবার পর গ্লাইকোসুরিয়া অথবা শর্করা মেহ প্রকাশ পায়। এর কারণ হলো, তার অগ্ন্যাশয়-এর কোষ থেকে পুন: অবশোষণ (Re-absorption) এর সীমা কমে যায়। এক্ষেত্রে কিন্তু শর্করা বৃদ্ধিজনিত মধুমেহ বলা যাবে না। কারণ ঐ ব্যক্তির ইনসুলিন স্রাব সামান্য হতে থাকে, কিন্তু যকৃৎ বা অপরাপর পরিপাক যন্ত্রের কোষগুলি ঠিক কাজ না করার জন্য এটি হয়। অনেক গর্ভবর্তী মহিলার প্রসব হবার পূর্বে প্রস্রাব পরীক্ষা করে দেখলে, তার প্রস্রাবেও শর্করা পাওয়া যায়। কিন্তু তার কারণ মধুমেহ নয়, পরিপাক যন্ত্র, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয় প্রভৃতির কাজে গোলমাল হবার জন্যেই এটি হয়। কাজেই একে মধুমেহ বললে ভুল করা হবে।
মধুমেহ রোগীর ইনসুলিন কমে যাবার কারণ হলো রক্ত-শর্করা (Blood sugar) বৃদ্ধি পাওয়া। যার ফলে মানবদেহের কোষগুলি জীবন শক্তিদায়ী ইন্ধন থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। সেই সময় দেহ অভ্যন্তরে স্থিত চর্বি দেহের কাজে লাগতে থাকে। আর অপর দিকে শর্করা প্রসাবের সঙ্গে বেরিয়ে যেতে থাকে। এখানে আশ্চর্যের বিষয় হলো, একজন সুস্থ মানুষ থেকে, একজন মধুমেহ রোগাক্রান্ত ব্যক্তির ইনসুলিন কম উৎপাদন হয় না।
এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে যে, একজন মধুমেহ রোগাক্রান্ত ব্যক্তির যতটা পরিমাণ ইনসুলিনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, ঠিক ততটা ইনসুলিন উৎপাদন হয় না। কিন্তু একজন সুস্থ মানুষের পক্ষে সেটাই যথেষ্ট। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, একজন মধুমেহ রোগাক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে একজন সুস্থ ব্যক্তি অপেক্ষা ইনসুলিন স্তর বেশী থাকে। কিন্তু মধুমেহ রোগীর রক্তে কি জন্য ইনসুলিন বেশী উৎপন্ন হয়? এর উত্তরে অনেকে বলবেন, ইনসুলিন অধিক উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও এই রোগ হয় কেন?
এর উত্তর হলো, মধুমেহ রোগাক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে অধিক পরিমাণে ইনসুলিন উৎপন্ন হলেও, তার প্রয়োজনের অপেক্ষা কম। এটাই রোগের বৈশিষ্ট্য। প্রয়োজন অপেক্ষা কম হয় কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, মধুমেহ রোগাক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত নালিকায় ইনসুলিন বিরোধী অথবা ইনসুলিনের ক্রিয়া নষ্টকারী কোনও রাসায়নিক ক্রিয়া চলতে থাকে। আবার এই উত্তরটি যদি নিশ্চিতভাবে মেনে নেওয়া হয় তাহলে জিজ্ঞাস্য হলো, এই রোগীর ইনসুলিন কেন অধিক উৎপন্ন হয়?
ইনসুলিন অধিক উৎপন্ন করার ফলে এই রোগীর অগ্ন্যাশয় শ্রান্ত হয়ে পড়ে। তার ফলে শেষ পর্যন্ত আর বেশী ইনসুলিন অর্থাৎ এই রোগীর প্রয়োজনীয় ইনসুলিন উৎপাদন হয় না, * ফলে রোগীর অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে দাঁড়ায়। ইনসুলিনের প্রভাব কমিয়ে দেওয়া বা শেষ করে দেয় কোন পদার্থ? এটা আজও সঠিক জানা যায়নি।
একটা কথা স্পষ্ট বলা যায় যে, মধুমেহ রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের অত্যন্ত বেশী ইনসুলিনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে আর বিশেষ করে খাদ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন হয়। যাতে মেটাবলিজম ক্রিয়ার ওপর অধিক চাপ সৃষ্টি না হয়। আজকাল অনেক ট্যাবলেট বেরিয়েছে যা খেলে রক্ত শর্করা (Blood sugar) স্তর কম হয় এবং অক্ষম অগ্ন্যাশয়কে পুনরায় সতেজ করে তোলে।
কিন্তু এই ঔষধ অধিক বয়স্ক লোকদের ব্যবহার করা যায়। আরও একটা কথা, ইনসুলিন ট্যাবলেট আকারে পাওয়া যায় না। আর খাওয়াও যায় না মুখে। আসলে ইনসুলিন হলো একটি প্রোটিন জাতীয় পদার্থ। যদি এই ঔষুধ মুখে খাওয়া যায়, তাহলে গলে গিয়ে পাকস্থলীতে যাবে, আর সেখানকার নিঃসৃত পাচক রস এর প্রভাব নষ্ট করে দেবে। এইজন্য ইনসুলিন ইঞ্জেকশান দ্বারা দেহে প্রবেশ করানো হয়।
তাড়াতাড়ি বা দেরীতে অথবা বেশীদিন পর্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী বিভিন্ন প্রকার ইনসুলিন পশুদের মাধ্যমে তৈরী করা হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। আজ থেকে বহুদিন আগে সর্বপ্রথম ক্যানাডিয়ান ডাক্তার বেটিং ও বেন্ট দ্বারা পশুর অগ্ন্যাশয়ের রস থেকে তৈরী করেছিলেন। অনেকে আবার পশুর অগ্ন্যাশয়কে সুইট ব্রেড (Sweet bread) বলে থাকে। এটি জীবিত পশুর শারীরিক প্রক্রিয়ার অনুকূল।
আধুনিক পরীক্ষণ দ্বারা জানা গেছে যে, জীবাণুর সংবর্ধন দ্বারাও ইনসুলিন তৈরী করা যায়। ইনসুলিন হলো বিশুদ্ধ প্রোটিন। এতে কোনও কৃত্রিমতা নেই আর কৃত্রিমভাবেও এটি তৈরী করা যায় না। এজন্য মধুমেহ রোগাক্রান্ত প্রত্যেক রোগীর নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিদিন ইনসুলিন ইঞ্জেকশান নিতে হয়।