মধুমেহ নিয়ন্ত্রণ যখন অসুবিধা হয়ে যায়, তখন কি হয়? যদি রক্ত শর্করার (Blood • sugar)-এর মাত্রা খুব বেশী বেড়ে যায়, তাহলে রক্ত (Blood) ও প্রস্রাব ইউরিন (Urine) • পরীক্ষা করলে পজিটিভ পাওয়া যায়। অর্থাৎ ওতে শর্করার মাত্রা বেশী পাওয়া যায়।
সেই সময় মধুমেহ রোগাক্রান্ত রোগীর প্রথম আক্রমণ কমান যেসব লক্ষণ দেখা দিয়েছিল সেইসব লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন—
১। রোগী অধিক পিপাসা অনুভব করে।
২। সব সময় ক্লান্ত হয়ে থাকে।
৩। সারা দেহ যেন শিথিল মনে হয়।
৪। খুব দুর্বলতা অনুভব করে।
৫। দেহের ওজন কমে যেতে থাকে।
উপরোক্ত লক্ষণগুলি অবশ্য প্রথমেই দেখা যায় না। কিছু দেরীতে এই সব লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে।
রোগীর খুব গরম বোধ হয় এবং প্রচুর ঘাম বেড়ে যায়, সেই সঙ্গে পিপাসাও বেড়ে যেতে থাকে। এটি একটি প্রধান লক্ষণ বলা যায়। এই রকম হলে তৎক্ষণাৎ যে চিকিৎসক চিকিৎসা করছেন তাঁকে জানাতে হবে। তিনি এর প্রতিকারের জন্য ইনসুলিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত রোগের প্রাবল্য না কমে ততক্ষণ এইভাবেই চিকিৎসা করতে হবে।
এই সময় প্রস্রাব পরীক্ষা করলেই প্রস্রাবে শর্করার মাত্রা বেশী পাওয়া যাবে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজের ইচ্ছানুসারে কোনও সময়ে ঔষধের মাত্রা বাড়ানো বা কমানো চলবে না।
হাইপো প্রতিক্রিয়া এবং মধুমেহ রোগাক্রান্ত ব্যক্তির মূৰ্চ্ছা (Coma)
যদি রক্ত শর্করা (Blood sugar) উচ্চ হওয়ার পরেই অল্প কমে যায়, তাহলে রোগীর মূর্ছিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এই মূৰ্চ্ছাকে চিকিৎসা শাস্ত্রে কোমা (coma) বলা হয়,
এই সময় যে সব লক্ষণ দেখা যায়, তা হলো—
১। রোগী খুব কাঁপতে শুরু করে।
২। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা দেখা দেয়।
৩। পেট খালি বলে বোধ হয়।
৪। দুর্বলতা অনুভব করে।
৫। ঠাণ্ডা ঘাম দিতে থাকে রোগীর সারাদেহে।
৬। রোগীর মুখ হলুদবর্ণ দেখায়।
এই সব অবস্থা দেখা দিলে রোগীর রক্ত শর্করার মাত্রা বাড়ানোর জন্য কার্বোহাইড্রেটস (carbohydrate) যুক্ত খাদ্য পদার্থ অবশ্যই খেতে দিতে হবে। এই সময় রোগীর কিছুই খেতে ইচ্ছা থাকে না। তবু তাকে খাওয়াতে হবে।
যেমন যেমন হাইপো (Hypo) প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে, এবং রক্ত শর্করা কম আসা যাওয়া করতে থাকে, ততই রোগী দুর্বল হলে পড়তে থাকে। রোগীর স্বভাব খুব হিংস্র হয়ে ওঠে। সে সব কথা স্পষ্ট বলতে পারে না। একটা তন্দ্রার মতো ভাব এসে যায় রোগীর। অবশেষে চেতনা হারিয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়ে। এই রোগীর পক্ষে এটি খুবই সঙ্কটপূর্ণ *অবস্থা বলা যায়। কারণ মস্তিষ্কের কোষগুলিতে রক্ত-শর্করা থেকে প্রাপ্ত পদার্থ আসে না। ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলি বঞ্চিত হয়ে পড়ে। কিন্তু এটি মস্তিষ্কের কোষগুলির পক্ষে অত্যাবশ্যকীয় পদার্থ।
দ্বিতীয়তঃ হৃদপিণ্ডের পেশী ও কোষগুলিতেও এর প্রভাব পড়ে। অতএব এই অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রোগী অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মূৰ্চ্ছা থেকে রোগীকে বাঁচানোর চিকিৎসা হলো এই যে, রোগী যদি গিলে খেতে পারে, তাহলে তৎক্ষণাৎ গ্লুকোজ অথবা চিনি ২।৩ চামচ জলে মিশিয়ে খাইয়ে দিতে হবে। তার ফলে রোগীর চেতনা ফিরে আসবে।
যখন রোগীর কিছুটা চেতনা ফিরে আসবে, তখন তাকে দুধের সঙ্গে গ্লুকোজ মিশিয়ে দিতে হবে আর সেই সময় এক আধখানা বিস্কুট খেতে দিতে হবে। এই রকম করলে রোগী ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে।
মূৰ্চ্ছার সময় রোগীকে জোর করে কোনও তরল পদার্থ খেতে দেওয়া বা খাওয়ানো চলবে না। তার ফলে রোগীর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। সামান্য চেতনা এলেই অথবা চেতনা না এলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
যাই হোক না কেন, পরিবারবর্গের সকলকে সব সময় মনে রাখতে হবে, যাতে এই অবস্থার পুনরাবৃত্তি না হয়। এই রোগাক্রান্ত প্রত্যেক রোগীকে সামান্য চিনি এবং ২।৪ খানা বিস্কুট সব সময় নিজের পকেটে রাখতে হবে। কারণ যখনই সে রক্ত শর্করার স্বল্পতা অনুভব করবে বা তার প্রতিক্রিয়া অনুভব করবে, তখনই কিছুটা চিনি ও ২/১ খানা বিস্কুট খাবে।
যেসব রোগী ট্যাবলেট ব্যবহার করে, তাদের অপেক্ষা ইনসুলিন ব্যবহারকারী রোগীদের মধ্যে এই প্রতিক্রিয়া বেশী দেখা যায়। বিশেষ করে খুব কম বয়স্কদের এই প্রতিক্রিয়া বেশী হয়।
শিশুদের খেলা-ধূলা ও দৌড়াদৌড়ির ফলে এই প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এর কারণ হলো মাতা-পিতা অভিভাবকগণ পূর্বে কিছু অনুমান করতে পারেন না, তারপর হঠাৎ এই ঘটনা ঘটে যায় ।এছাড়া যেসব শিশুকে নিয়মিত ইনসুলিন প্রয়োগ করা হয়, তাদের ক্ষেত্রে একটি স্বাভাবিক ভাবে ঘটে যায়।
বর্ষাকালে অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়েরা বর্ষার জন্য বাইরে বেরোতে পারে না, সারাদিন তারা ঘরে বসে থাকে, ঘরোয়া খেলা করে বসে বসে। অথবা বসে টেলিভিশন দেখে, সেই সময় যদি আপনি ছেলেদের প্রস্রাব পরীক্ষা করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, প্রস্রাবের রং কমলালেবুর মতো দেখাচ্ছে। এতে আপনি বুঝতে পারবেন যে, প্রস্রাবে শর্করার মাত্রা বেড়েছে। কারণ সেই সময় তারা অকর্মণ্য হয়ে ঘরে চুপ-চাপ বসে থাকার জন্য অতিরিক্ত শর্করা দেহে কাজে আসছে না।
আবার যেদিন ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করে খেলা করবে, বাগানে গিয়ে দোলনায় দুলবে, সাইকেল নিয়ে চালাবে অর্থাৎ চঞ্চল থাকবে, সেদিন যদি তার প্রস্রাব পরীক্ষা করে দেখেন, তাহলে তাতে শর্করার অভাব দেখতে পাবেন। এই রকম হলে ছেলেমেয়েদের মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়, তার দেহ হলুদ-বর্ণ দেখায়। সে ক্লান্তি অনুভব করে এবং এই সময় খেতে চাইবে।
এই অবস্থা দেখে মাতা-পিতা চিন্তিত হয়ে ওঠেন। তারা ভাবেন যতটা কার্বোহাইড্রেটস তার গ্রহণ করা উচিত, তার চেয়ে চারগুণ অধিক গ্রহণ করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়, কারণ সেই সময় তার শরীরের খাদ্যেরই আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে, এই সময় যদি তাকে কার্বোহাইড্রেটস্ জাতীয় খাদ্য না দেওয়া হয়, তাহলে সে হাইপো প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়ে পড়বে।
এই রোগাক্রান্ত রোগীদের সব সময় সতর্ক থেকে অনিয়মিত ব্যায়াম অথবা অধিক শ্রম প্রভৃতি থেকে বিরত থাকতে হবে। যে কাজে রোগী অভ্যস্ত নয়, সে কাজ করা চলবে না।
ইনসুলিন অথবা ট্যাবলেট ব্যবহারকারী রোগীদের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রোগীকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, বিশ্রাম অবস্থায় থাকাকালীন তাকে কোন্ কোন্ খাদ্য ত্যাগ করতে হবে। আবার যখন সে কিছু কিছু কর্মে ব্যস্ত থাকবে, সেই সময় কোন্ কোন্ খাদ্য বেশী পরিমাণে খেতে হবে।
মধুমেহ রোগাক্রান্ত ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মাতা-পিতার কর্তব্য হলো, রোগাক্রান্ত ছেলেমেয়ের সঙ্গে সবসময় কিছু বিস্কুট, গ্লুকোজ, ট্যাবলেট ইত্যাদি রাখা।
মধুমেহ রোগাক্রান্ত বয়স্ত ব্যক্তি যদি গাড়ি চেপে কোন জায়গায় যান বা কোন দূর পথে যান তাহলে খাবার জন্য, চিনি, গ্লুকোজ ও বিস্কুট অবশ্যই রাখবেন। তা না হলে পথে বিপদ ঘটতে পারে।
ইনসুলিন, বিশেষতঃ বেশীদিন প্রভাব বিস্তারকারী ইনসুলিন ব্যবহারকারী রোগীদের মধ্যেও রাত্রিতে হাইপো প্রতিক্রিয়া সামান্যভাবে দেখা দিতে পারে। এই সব রোগী স্বপ্ন দেখে, যেন সে উঁচু থেকে পড়ে গেল। কখনও আবার ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চীৎকার করে ওঠে। আর সেই সঙ্গে তার ঘুম ভেঙে যায়। সারা দেহ ঘামে ভিজে যায়।
অনেক সময় আবার সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। সেই সময় প্রস্রাব পরীক্ষা করলে তাতে শর্করা পাওয়া যায়না এই অবস্থায় দেখা দিলে বুঝতে হবে রাত্রিতে তার ওপর হাইপো প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। এইজন্য এই রোগাক্রান্ত রোগীর উচিত হলো—নিজের শয্যাপার্শ্বে আধ গেলাস দুধ, চিনি এবং বিস্কুট রেখে শয়ন করা। তাছাড়া শোবার আগে আটার তৈরী রুটি, স্যাণ্ডউইচ অথবা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী কার্বোহাইড্রেট যুক্ত কোনও খাদ্য খেয়ে শয়ন করা। যদি সন্ধ্যার সময় প্রস্রাব পরীক্ষা করে তাতে শর্করার অভাব দেখা দেয়, তাহলে উপরোক্ত নিয়মগুলি মেনে চললে খুব ভাল কাজ দেয়।
যদি এই রোগে আক্রান্ত রোগীর বার বার হাইপো প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তাহলে বুঝতে হবে তার খাদ্য নিয়ন্ত্রণে নিশ্চয়ই গোলমাল আছে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলো তার দৈহিক আবশ্যকতা অনুসারে ইনসুলিনের মাত্রা ঠিক করা। অনেক চিকিৎসককে মধুমেহ রোগাক্রান্ত রোগীকে নিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। এই সব রোগীর রক্ত শর্করার পরিমাণ এক থাকে না। এই সব রোগীর রক্ত শর্করা কখনো খুব উচ্চ আবার কখনো একেবারে নিম্ন হয়। এক একদিন এই সব রোগীর রক্ত শর্করা এক একরকম থাকে, কখনো খুব নিম্ন আবার কখনোও খুব উচ্চ। এদের যে কোনো মুহূর্তে হাইপো প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এদের চিকিৎসাও বেশ সাবধানে করতে হয়।
কয়েকটি বিশেষ কথা
মধুমেহ রোগাক্রান্ত রোগীর নিম্নলিখিত উপদেশগুলি সবসময় মেনে চলতে হবে এবং রোগীকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি সম্পর্কে চিকিৎসক বা পরিবারবর্গ জানিয়ে দেবে। যেমন—
১। রোগীকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, মধুমেহ রোগটি কি এবং এই রোগের কি কি কুপ্রভাব দেখা দিতে পারে।
২। এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে ভালভাবে জানিয়ে দিতে হবে যে, তার খাদ্য কিরূপ হওয়া উচিত। কিভাবে সেই খাদ্য প্রস্তুত করতে হয়। আর নিয়মিতভাবে সেই খাদ্য কিরূপে গ্রহণ করা যায়।
৩। শর্করা অথবা কিটোন সম্বন্ধে জানার জন্য রোগীকে প্রস্রাব পরীক্ষা ও রক্ত পরীক্ষা শিখিয়ে দিতে হবে)
৪৷ নিজেই যাতে ইনসুলিন ইঞ্জেকশান নিতে পারে অথবা নিয়মিতভাবে ট্যাবলেট খেতে পারে রোগীকে শিখিয়ে দিতে হবে।
৫। রোগীকে রোগের সম্পর্কিত লক্ষণ, অসুবিধা ও দৈহিক অন্যান্য প্রতিক্রিয়া কি হয় জানিয়ে দিতে হবে, এবং কিভাবে তা দূর করা যায়, তাও জানাতে হবে।