কবিরাজী চিকিৎসা

কবিরাজী মতে অর্থাৎ আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এই রোগটিকে বলা হয় মধুমেহ বা বহুমূত্র। এই শাস্ত্রেও বলা হয়েছে, মানব দেহে শর্করা জাতীয় বস্তু দেহে শোষিত না হয়ে রক্তে মিশে গিয়ে রক্তে শর্করা বৃদ্ধি করে। তার ফলে দেহস্থ শর্করা প্রস্রাবের সঙ্গে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়।
রোগী অধিক পিপাসা এবং ক্ষুধা অনুভব করে। শরীর দুর্বল ও ক্ষীণ হতে থাকে। দেহে হঠাৎ ফোঁড়া বা ব্রণ হয়। দেহে কোনও ক্ষত হলে সহজে শুকাতে চায় না। ঠোঁট শুষ্ক ও দেহে চামড়া খসখসে হয়ে যায়। রোগী যেখানে প্রস্রাব করে, যেখানে পিঁপড়ে হয়।
এই রোগ আক্রমণ করলে, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে নিম্নলিখিতভাবে চিকিৎসা করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
(১) তেলাকুচোর পাতা ও মূলের রস খেতে দিতে হবে। মাত্রা—পাতা এবং মূল থেঁতো করে রসটা হেঁকে নিয়ে সকালে ৩ চা-চামচ এবং বৈকালে ৩ চা-চামচ স্বল্প গরম করে খেতে দিতে হবে এক সপ্তাহ। তার ফলে রক্তে
শর্করা কমে যাবে। 
(২) জয়ন্তী পাতার রস এই রোগে উপকারী ঔষধ।
মাত্রা—জয়ন্তী পাতা থেঁতো করে ছেঁকে নিয়ে ৩ থেকে ৪ চা-চামচ গরম করে ঠাণ্ডা হলে আধ কাপ দুধে মিশিয়ে প্রত্যহ একবার খেতে দিতে হবে।
(৩) জয়ন্তী পাতা চূর্ণ করে ছেঁকে নিয়ে ৪ থেকে ৫ গ্রাম চূর্ণ যবের আটার সঙ্গে মিশিয়ে ২/৩ খানা রুটি তৈরী করে রোগীকে খেতে দিলেও বহুমূত্র রোগে খুবই উপকার দর্শে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যায়।
(৪) আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বহুমূত্র রোগকে প্রমেহ রোগের ধারা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যাঁদের রসবহ স্রোত বিকারগ্রস্থ তাঁরাই বহুমূত্র রোগের শিকার হয়ে পড়েন। যাই হোক, এই রোগ হলে, রোগীকে ভাত খাওয়া বন্ধ করতে হবে। যবের আটার রুটি, যবের মণ্ড এদের খেতে দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
(৫) যাদের বার বার প্রস্রাব হয়, এমন কি এক ঘণ্টার মধ্যেই ২/৩ বার প্রস্রাব হয়ে যায়, একে ডাক্তারী শাস্ত্রে এক ধরনের ডায়াবেটিস বলা হয়েছে। তবে এতে প্রস্রাবে শর্করা থাকে না। এই রোগকে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সোমরোগ বলে।
-এই রোগ হলে পলাশ পাতার রস অত্যন্ত উপকারী ঔষধ। পলাশ পাতা থেঁতো করে রসটা ছেঁকে নিয়ে সকালে এক চা-চামচ এবং বৈকালে এক চা-চামচ ৮/১০ চা-চামচ জলের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে উপকার হয়।
(৬) বহুমূত্র ও মধুমেহ এই দুটি রোগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যায়। দুটি রোগের ক্ষেত্রেই রোগী দুর্বল হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে রোগীকে লঘুপাচ্য ও বলকারক খাদ্য দিতে হয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এইসব রোগীর দুর্বলতা নিবারণের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা অবলম্বন করতে বলেছেন। এতে ঔষধ ও পথ্য দুটোই হবে।
মোটা হৈমন্তিক ধান বা মেটে ধান এক কাপ নিয়ে ১ কিলো জলে সিদ্ধ করতে হবে। জল কমে গিয়ে ১ কাপ থেকে দেড় কাপ অবশিষ্ট থাকতে নামিয়ে ছেঁকে নিয়ে, তার অর্ধেক সকালে অর্ধেক বিকেলে খেতে দিলে রোগীর দুর্বলতাও কমবে এবং রোগেরও অনেক উপশম হবে।
(৭) কলার মচার রস খেলে বহুমূত্র রোগ উপশম হয়। মাত্রা—কলার মোচা থেঁতো করে রসটা হেঁকে নিয়ে, সেই রস ২ থেকে ৩ চা-চামচ ১০ ফোঁটা খাঁটি মধুসহ সকালে একবার ও বৈকালে একবার খেতে দিলে বার বার প্রস্রাবে ও প্রস্রাবে শর্করার মাত্রা কমে যায়।
(৮) বহুমূত্র রোগ ধরা পড়লে নিম্নলিখিত ঔষধ খেতে দিতে হবে।
কর্পূর - ১০ থেকে ১৫ মিগ্রা.
জৈত্রী- ১০ থেকে ১৫ মিগ্রা.
আফিম-১০ থেকে ১৫ মিগ্রা.
উপরোক্ত ঔষধগুলি একসঙ্গে মিশিয়ে প্রত্যহ দুপুরে একবার করে খেতে দিতে হবে। রোগের প্রাবল্য বেশী হলে, দু'বার খেতে দিতে হবে। অর্থাৎ সকালে একবার ও বৈকালে একবার খেতে দিলে উপকার হয়।
(৯) রক্ত শর্করা অর্থাৎ ডাক্তারী শাস্ত্রে যাকে blood sugar বলে, সেই রোগ হলে, নিমপাতা ব্যবহারে খুব উপকার দর্শে।
মাত্রা- নিমপাতা-১০টি গোলমরিচ ৫টি

উপরোক্ত দু'টি দ্রব্য নিয়ে সকালে খালিপেটে চিবিয়ে খেলে কয়েকদিনের মধ্যে রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যাবে।
(১০) রক্ত শর্করা রোগীকে নিম্নলিখিত ঔষধ প্রয়োগ করলে উপকার হয়।
তুলসীপাতার রস ২ চা-চামচ।
কাঁচা হলুদের রস ২ চা-চামচ।
আখের গুড় ১ চা-চামচ।
উপরোক্ত দ্রবগুলি একসঙ্গে মিশিয়ে সারাদিনে ১ থেকে ২বার খেতে দিলে রক্ত শর্করা আরোগ্য হয়, এবং রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে দেয়।
(১১) গনিয়ারী গাছের পাতা ব্যবহারে রক্ত শর্করা রোগ উপশম হয়। মাত্রা—গণিয়ারী গাছের পাতা চূর্ণ করে ছেঁকে নিয়ে ১ গ্রাম মাত্রায় সেই চূর্ণ সকালে একবার ও বৈকালে একবার একমাস ব্যবহার করলে রক্ত শর্করা Blood Sugar উপশম হয়।
(১২) জামের বীজ চূর্ণ ব্যবহারে মধুমেহ রোগ উপশম হয়। . মাত্রা—জামের বীজ রৌদ্রে শুকনো করে চূর্ণ করে ছেঁকে নিয়ে শিশিতে রাখুন। প্রতিদিন সেই চূর্ণ আধ চা-চামচ মাত্রায় সকালে খেলে মধুমেহ আরোগ্য হয়। 
(১৩) তেঁতুলের বীজ বা বীজের অঙ্কুর খেতে দিলে বহুমূত্র আরোগ্য হয়।
বি. দ্র. যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তারা এটি ব্যবহার করবেন না। মাত্রা—৪/৫ গ্রাম তেঁতুলের বীজ চূর্ণ করে ছেঁকে নিয়ে, (ওপরের শক্ত খোসা বাদ দেবেন) জলে বার্লির মতো সিদ্ধ করে একবার করে খেতে দিলে, বহুমুত্র রোগ আরোগ্য হয়।
(১৪) তেঁতুল বীজের অঙ্কুর ২/৩ গ্রাম বেটে জল মিশিয়ে একবার করে খেতে দিলে বহুমূত্র রোগ আরোগ্য হয়।
(১৫) অড়হর পাতার রস খেতে দিলে বহুমূত্র বা মধুমেহ রোগ উপশম হয়। মাত্রা—অড়হর পাতার রস ৪/৫ চা চমচ নিয়ে স্বল্প গরম করে সারাদিনে দুবার করে খেতে দিলে উপকার হয়। অথবা—
(১৬) অড়হর গাছের মূল ৮ থেকে ১০ গ্রাম থেঁতো করে ২ কাপ জলে সেদ্ধ করে, আধ কাপ অবশিষ্ট থাকতে নামিয়ে সারাদিনে একবার করে খেতে দিলে এই রোগে
উপকার হয়।
(১৭) গাব গাছের ছলের রস খেতে দিলেও মধুমেহ রোগ আরোগ্য হয়। মাত্রা—৮/১০ গ্রাম গাব গাছের ছাল থেঁতো করে ছেঁকে নিয়ে অল্প গরম করে সকালে ৪/৫ চা-চামচ, বিকালে ৪/৫ চা-চামচ খেতে দিলে উপকার হয়।
মাত্রা—আমের নতুন কচিপাতা শুকনো করে গুঁড়িয়ে ছেঁকে নিয়ে ১ চা-চামচ মাত্রায় সকালে একবার বৈকালে একবার খেতে দিলে উপকার হয়।
(১৮) কালো জামের বীজ চূর্ণ করে হেঁকে নিয়ে, এক কাপ জলে ৩/৪টি কচি ট্যাঁড়স সেদ্ধ করে আধ কাপ অবশিষ্ট থাকতে নামিয়ে, জলটা ছেঁকে নিয়ে তার সঙ্গে জাম বীজ চূর্ণ ১ চা-চামচ মিশিয়ে প্রত্যহ একবার করে কিছুদিন খেলে রক্ত শর্করা রোগ আরোগ্য হয়।
এলোপ্যাথিক চিকিৎসা শাস্ত্রে রক্ত শর্করাকে Blood Sugar বলা হলেও ওটি প্রকৃত পক্ষে চিনি নয়। এটি রসবহ স্রোত দূষিত হলেই সৃষ্টি হয়। মানবদেহে রসস্রোতে যে পিত্ত ধাতু আছে, সেটাই ঘনীভূত হয়ে এই চিনির আকার ধারণ করে।
এই কারণের জন্য রক্ত শর্করা রোগীর আগের রস খাওয়া নিষিদ্ধ নয় বলে আয়ুর্বেদের মত। তাছাড়া আখের রস মিষ্ট স্বাদযুক্ত হলেও তাতে এইসব রোগে কোনও ক্ষতি হয় না। কারণ আখের রস শীতবীর্য, তবে তার ক্রিয়াকারিত্বকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য একটু উষ্ণগুণধর্মযুত গোলমরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে খেতে হয়। রক্ত শর্করা রোগীর জন্য এই ধরনের একটি ঔষধের কথা বলা হলো।
(১৯) আখের রস ২৫ থেকে ৩০ মিলিলিটার, তার সঙ্গে আধ গ্রাম বা সিকি চা-চামচ মরিচের গুড়ো মিশিয়ে প্রত্যহ একবার খেতে দিলে রক্ত-শর্করা রোগে খুবই উপকার
হয়। 
(২০) বেলপাতা ৪/৫টি নিয়ে থেঁতো করে সেই রস একটু খাঁটি মধু মিশিয়ে খেতে দিলে
উপকার হয়।
(২১) বার বার প্রস্রাব হয়, অথচ তাতে শর্করা থাকে না। একে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলা হয় সোম রোগ। এই রোগ হলে গড়গড়ে গাছের মূল চূর্ণ করে ছেঁকে নিয়ে ১ চা-চামচ মাত্রায় মধুসহ
সকাল ও সন্ধ্যায় খেতে দিলে, সোম রোগ আরোগ্য হয়।
(২২) চাকুন্দের মূল চাল ধোওয়া জলসহ বেটে গরম করে প্রত্যহ একবার সেবনে বহুমুত্র রোগ আরোগ্য হয়।
(২৩) কচি তালগাছের মূল ৩ গ্রাম। কচি খেজুরের মূল ৩ গ্রাম।
উপরোক্ত দুটি দ্রব্য বেটে পাকা কাঠালী কলার সঙ্গে চটকে দুধের সঙ্গে সকালে খেলে বহুমূত্র আরোগ্য হয়।
(২৪) আমলকীর রস ৩/৪ চা-চামচ।
চিনি ১ চা-চমচ।
মধু ১ চা-চামচ।
উপরোক্ত দ্রব্যগুলি একত্রে মিশিয়ে একটি পাকা কাঠালী কলার সঙ্গে চটকে গরম করে প্রাতঃকালে খেলে সোমরোগ আরোগ্য হয়।.
(২৬) আমলকীর রস ৩/৪ চা-চামচ ও খাঁটি মধু ১ চা-চামচ একসঙ্গে মিশিয়ে প্রতিদিন প্রাতঃকালে খেলে বহুমূত্র রোগ আরোগ্য হয়।
(২৭) ক্রিমিকুষ্মাণ্ড চূর্ণ এক চা-চামচ।
শতাবরী চূর্ণ এক চা-চামচ।
উপরোক্ত দ্রব্য দুটি একটি পাকা কাঠালী কলার সঙ্গে মেখে খেলে এবং তার সঙ্গে কিঞ্চিৎ দুধ খেলে বা সব একত্রে মিশিয়ে প্রত্যহ প্রাতঃকালে খেলে বহুমুত্র রোগ আরোগ্য হয়। 
(২৮) রাখাল শশার মূল বেটে এক চা-চামচ পরিমাণ নিয়ে বাসি জলের সঙ্গে প্রাতঃকালে
খেলে শর্করা রোগ অর্থাৎ blood sugar রোগ আরোগ্য হয়।
বহুমূত্র রোগে কবিরাজী নিম্নলিখিত ঔষধগুলি অবস্থাভেদে খেতে দিলে উপকার হয়। ব্যবস্থাপত্র ঔষধের সঙ্গেই থাকে।
(ক) কল্যাদি ঘৃত (খ) বৃহৎ ধাত্রী ঘৃত (গ) সোমনাথ রস (ঘ) বৃহৎ সোমনাথ রস (ঙ) সোমেশ্বর রস।
• চিকিৎসার পূর্ব চিকিৎসকের পরমর্শ বাঞ্ছনীয়