সম্পাদকীয়- ইন্দ্রনীল আচার্য

    সংখ্যাগুরুর মহািবশ্বে সংখ্যালঘুর সংস্কৃতির বিপদের কথা বলতে গিয়ে প্রখ্যাত উত্তর আধুনিক সমালোচক জাঁ ফ্রাঁসোয়ালিওটার্ড বলেছেন,
    Nothing is more difficult than the struggles of  minorities who want to remain minorities, who want to be recognised as such. It does not live some place where the politics of the great does not live; it lives on the same surface, but in a different way.
    এই পর্যবেক্ষণটি একবিংশ শতকের ভাষা রাজনীতির আবহে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সংখ্যাগুরু ভাষার দাপটে সংখ্যালঘু ভাষা সংস্কৃিতর পরম্পরা হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রখ্যাত ভাষা আন্দোলন কর্মী অধ্যাপক গনেশ দেবীর কথায় এই বিস্মরণের প্রক্রিয়াটিকে 'cultural 
amnesia' অভিধায় সূচিত করা হয়। সংস্কৃতায়ণের প্রক্রিয়া একদিকে দেশীয় ভাষা সংস্কৃিতর বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক শক্তি এর যাবতীয় পশ্চিমী ধ্যানধারণার জোয়ারে আঞ্চলিক ভাষা সাহিত্যকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল।
    1961 সালের আদমসুমারিতে মোট মাতৃভাষার সংখ্যা ছিল 1652টি। এর মধ্যে বেশ কয়েকশ ভাষার কোনো অস্তিত্ব এখন পাওয়া যায় না। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতবর্ষের মোট ভাষার প্রায় এক পঞ্চমাংশ হারিয়ে গিয়েছিল। এই শতকেরই শেষ অর্ধে আমরা অবশিষ্ট ভাষাগুলির এক তৃতীয়াংশ হারিয়ে ফেলি। এইভাবে যদি ভাষা হারিয়ে ফেলার প্রবণতা চালু থাকে তাহলে দেখা যাবে আগামী পঞ্চাশ বছরে আমরা আদিবাসী ও যাযাবর গোষ্ঠীগুলির ভাষা  একেবারে হারিয়ে ফেলব। িবপুল সংখ্যক ভাষার অপমৃত্যু ঘটবে। এইভাবে ভাষার জগতে এক মাৎস্যন্যায় সৃষ্টি হয়েছে যেখানে রাজনৈতিক প্রভাবপুষ্ট ভাষাগুলি আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষের ভাষাগুলিকে নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে। ভাষাবিদরা এইসব শক্তিশালী ভাষাগুলিএক 'killer languages' নামে অভিহিত করেছেন।
    1961 সালের আদমসুমারিতে যেখানে 1652টি মাতৃভাষার উল্লেখ করা হয়েছিল সেখানে 2001 সালের জনগণনায় ভাষার সংখ্যা হয় মাত্র 122টি। এই অস্বাভাবিক হ্রাসের অনেক কারণ ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল একটি বিশেষ সরকারী নীতি। এখানে বলা হয়েছিল যদি কোনো ভাষাগোষ্ঠীর মোট সদস্য সংখ্যা দশ হাজার বা তার বেশী হয় একমাত্র সেক্ষেত্রেই এই গোষ্ঠীকে ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হবে। অন্যথায় ভাষাগুলিকে গণনার আওতায় আনা হবে না। অন্য একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল জাতীয় স্তরে হিন্দী ও ইংরেজির ক্রমবর্ধমান প্রভাব। এই দুই ভাষা বহু ছোট ছোট ভাষার অপমৃত্যুর জন্য দায়ী।
    এবার কিছু তথ্য পরিসংখ্যানের আলোচনায় আসা যাক। 310টি ভাষার মৃত্যু আসন্ন। এর মধ্যে 263টি ভাষা পাঁচের কম মানুষ ব্যবহার করেন আর 47টি ভাষা এক হাজারের কম মানুষ ব্যবহার করেন। এই 310টি ভাষা 1961-এর জনগণনায় জীবিত ছিল। বিশ্বের সব ভাষাবৈচিত্র্য সম্পন্ন দেশগুলির মধ্যে ভারত নবম স্থানে রয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভাষা বৈচিত্র্য রক্ষা করা বিশেষ জরুরী। আন্দামান ও নিকোবরের বিভিন্ন বিপন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে নিরন্তর গবেষণা চালিয়েছেন দিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপিকা অন্বিতা আব্বি। তাঁর গবেষণার ফসল 2006 সালে একটি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। বইটির শীর্ষক 'Endangered
Languages of the Andaman Islands'। এই গবেষণা গ্রন্থে তাঁর বিশেষ নজর ছিল বৃহৎ আন্দামানীয় ভাষা পরিবারের সদস্য বো ভাষার সংরক্ষণের বিষয়ে। দুর্ভাগ্যবশতঃ 2010-এর জানুয়ারী মাসে এই ভাষা সম্প্রদায়ের শেষ ভাষা ব্যবহারকারী মহিলা বোয়া সিনিয়র পচাঁশি বছর বয়সে মারা যান। তিনি বিবাহ করেন নি আর তাঁর পরে ভাষা ব্যবহার করার কেউ ছিল না। পরিণামে এই ভাষার অস্তিত্ব লোপ পায়। পশ্চিমবঙ্গেও এই ধরনের বেশ কিছু বিপন্ন ভাষা রয়েছে। টাইমস্ অফ্ ইন্ডিয়া ও হিন্দুস্থান টাইমস্-এর প্রতিবেদন অনুসারে উত্তরবঙ্গে নয়টি ভাষা সংকটজনকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এগুলি হল — থারু, হাজং, জলদা, কয়া, ধুলিয়া, রাউতিয়া, শবর, অসুর ও মগর। দশম ভাষা তুন্ডু একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধুমাত্র তুন্ডু নামক জায়গাটি এখনো রয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভাষা ব্যবহারকারীদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। ভাষার অপমৃত্যু ঠেকানোর জন্য গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।
    'জনজাতি দর্পণ' পত্রিকার বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিপন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির আলোচনাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথম সংখ্যায় এই ভাষাগুলির মধ্য থেকে কিছু ভাষায় রচিত সাহিত্য, কবি ও লেখকদের সাক্ষাৎকার ও ভাষা গবেষণার কিছু দিককে উন্মোচিত করা প্রবন্ধ সংকলন করা হয়েছে। খেড়িয়া শবর, কুড়মালি ও মাহালি ভাষার বর্তমান স্থিতি নিয়ে আলোচনা রয়েছে। আবার সংবিধানের অষ্টম তফশীলভুক্ত ভাষা সাঁওতালিতে রচিত কবিতা, গান প্রথম সংখ্যায় ঠাঁই পেয়েছে। আদিবাসী ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে সাঁওতালির জায়গা পাকা হলেও বহির্বিশ্বের ভাষা ব্যবহারের নিরিখে তা যথেষ্ট দুর্বল। বিশেষতঃ ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের সাঁওতাল নারী পুরুষের শহুএর জীবনে সাঁওতালি ভাষার ব্যবহার নেই বললেই চলে। অপ্রয়োজনের ফলে এই ভাষাও এক ধরনের সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
    এই পত্রিকার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল দলিত জনজাতির ভাষা ও সাহিত্যের আলোচনা। আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি যেমন সংখ্যাগুরু রাজনীতির শিকার ঠিক তেমনভাবে দলিত ভাষা ও সংস্কৃিতও অবহেলা ও উপেক্ষায় দীর্ণ হয়ে আজ অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এই ভাষায় ব্যবহৃত বাংলার গ্রামীণ আঞ্চলিক রূপ আজ নাগরিক সভ্যতার বৃেত্ত অচল, উপহাসের বস্তু। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠিত বাংলা ভাষারীতির প্রয়োগ এমন এক সার্বজনীন চেহারা নিয়েছে যেখানে স্থানীয় রীতিঋদ্ধ, অর্গলমুক্ত, গ্রামীণ বাংলা রূপ ব্রাত্য ও সমালোচিত। অনিল ঘড়াই, নলিনী বেরা, অচিন্ত্য বিশ্বাসদের হাত ধরে এই দলিত ভাষা ও সংস্কৃতি বহু পথ পাড়ি দিয়েছে। তার নিজস্ব চরিত্রকে বাংলা সাহিত্য জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। স্বীকৃিত অর্জনের এই িনরন্তর সংগ্রামের কিছু নমুনা এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় পাঠককুলের অবগতির জন্য পেশ করা হল। বিশেষতঃ অনিল ঘড়াইয়ের অকাল প্রয়াণে দলিত ভাষা ও সাহিত্য আন্দোলনে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা স্মরণ করে প্রয়াত লেখকের সাহিত্যকীর্তির কিছু নমুনা পেশ করা হয়েছে। তাঁর একটি গল্পের ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশ করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী অ-বাঙালী পাঠককুলের কথা মাথায় রেখে ইংরাজী অনুবাদটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে এই সািহত্যের প্রচার ও প্রসার এই অনুবাদের পরম লক্ষ্য।
    পরিশেষে বলা প্রয়োজন 'জনজাতি দর্পণ' প্রথম সংখ্যা মূলতঃ একভাষিক হলেও ভবিষ্যতে এই পত্রিকাকে ত্রিভাষিক (বাংলা, ইংরাজী, হিন্দী) করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। এই ত্রিভাষিকতা দেশকালের গণ্ডি অতিক্রম করে সাম্প্রতিককালে সমগ্র বিশ্বে বিপন্ন সংখ্যালঘু ভাষা ও সংস্কৃিতর অবস্থান পর্যালোচনা করার প্রয়াস গ্রহণ করবে। একই সঙ্গে  দেশে বিদেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা কেন্দ্রগুলিতে আদিবাসী ও দলিত ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে যেসব গবেষণা প্রকল্প চালু রয়েছে তাদের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করবে। এই যাবতীয় সেমিনার, কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপের বিষয়ে পাঠকদের অবহিত করবে। একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিপন্ন ভাষাগুলিতে চর্চারত লেখক ও গবেষকদের মতামত ও সাক্ষাৎকারের নমুনাও আগামী সংখ্যাগুলিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস চালু থাকবে।
    এই পত্রিকার প্রকাশলগ্নে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমাদের ঋণ স্বীকার করা একান্ত প্রয়োজন। নলেজ ব্যাঙ্ক পাবলিশার্স ও ডিস্ট্রিবিউটর্স এই পত্রিকার প্রকাশক। এর কর্ণধার হিসেবে শ্রীমতী শ্রাবণী গুপ্তকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। একই সঙ্গে এই প্রকাশনা সংস্থার প্রধান চালিকাশক্তি শ্রী সুকুমার গুপ্ত, শ্রী সমর কুমার আঢ্য ও শ্রী সঞ্জীব মণ্ডলকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই। একটি বিশেষ ধারার পত্রিকা প্রকাশের জন্য তাঁরা যে সাহস ও উৎসাহ যুগিয়েছেন তা বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে। একই সঙ্গে এই পত্রিকার মুদ্রণ ও অন্যান্য কারিগরী সহায়তায় যে সমস্ত ব্যক্তিবর্গ নিয়োজিত থেকেছেন তাঁদের সবাইকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। আমার সহকর্মী হিসেবে তথ্য ও সাক্ষাৎকার সংগ্রহের কঠিন কাজ যাঁরা সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন তাঁদের সবাইকে উষ্ণ অভিবাদন জানাই। প্রথম সংখ্যার লেখকদের জন্যও রইল অকুণ্ঠ প্রশংসা ও শ্রদ্ধা। এঁদের সবার শুভেচ্ছা ও সহযোগিতায় 'জনজাতি দর্পণ' আগামী দিনে আরো অনেক পথ পাড়ি দেবে এই আশা রাখি। মুদ্রণ প্রমাদ ও অন্য কোনো ত্রুটির জন্য পাঠককুলের কাছে আগাম মার্জনা চেয়ে নিলাম। ভবিষ্যতে আপনাদের সুচিন্তিত মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।
    The Editor is also greatly indebted to the UGC Innovative Research Project currently being implemented at Vidyasagar University.