জনজাতির ভাষা : স্বাতন্ত্র্যের সঙ্কট ও অস্তিত্বের অনুমোদন - নীলাদ্রিশেখর দাশ

    উপভাষাবিজ্ঞান, নৃতাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞান, কিংবা সমাজভাষা-বিজ্ঞানেরআলোচনায় প্রায়ই বিভিন্ন জনজাতির ও গোষ্ঠীর ভাষা সাহিত্য ও জীবনচর্চার ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। এই গোষ্ঠীগুলিকে সামনে রেখে পৃথিবীর বহু দেশেই ভাষাসংক্রান্ত নানা উপাদান সংগ্রহ করার চেষ্টা হয়েছে ও হচ্ছে। বিশেষ করে এঁদের কথ্য ভাষার নমুনা, গান, ছড়া, গল্পকাহিনী, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার অডিও ভিডিও ক্লিপিংস সংগ্রহ করে রাখার একটা প্রচেষ্টা সার্বিকভাবে সমস্ত পৃথিবী জুড়েই শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, পশ্চিমবাংলায় বসবাসকারী জনজাতি গোষ্ঠীর ভাষার নমুনা সার্থকভাবে সংগ্রহ করে রাখার কোনো সার্বিক প্রচেষ্টা এখনও হয়নি যদিও ইদানীংকালে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে কিছু প্রচেষ্টা এখন চোখে পড়েছ। এই প্রেক্ষিতেআমরা মূলত নিচের কয়েকটি বিষয় খুব সংক্ষেপেআলোচনা করে বুঝে নেবার চেষ্টা করবো।
    প্রথম প্রশ্ন - পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে এই সমস্ত জনজাতি ও উপজাতিদের ভাষা ও ভাষাসংক্রান্ত তথ্য ও নমুনা সংগ্রহ করে রাখার প্রয়োজনীয়তা কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে এই বহুমাত্রিক জনজাতিদের ভাষা, সাধারণ জনজীবন, সংস্কৃতি, জীবনধারা, মৌখিক সাহিত্য, জ্ঞান, ধ্যানধারণা, বিশ্বাস ও অন্যান্য উপাদান কেবল এঁদের কাজেই এগুিলর ব্যবহারিক গুরুত্ব রয়েছে।আমাদের যুক্তিতে যে কোনো জনসমাজের বা ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা চর্চা সাধারণত দুভাবে প্রতিভাত হয়।
প্রথমত, দৃশ্যমান ভাষিক ব্যবহার যা উদ্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের প্রতিদিনের ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। দ্বিতীয়ত, ভাষা ব্যবহারকারীর অন্তনির্হিত ভাষাজ্ঞান যাকে কাজে লাগিয়ে একজন ভাষা ব্যবহারকারী তাঁর চার পাশের ঘটমান জীবন ও ঘটনা প্রবাহকে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কথা বা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেন। সংগৃহীত ভাষিক নমুনার প্রধান উদ্দেশ্য হলো এই দুই বৈশিষ্ট্যকে তাদেরআপন স্বাতন্ত্র্যেআমাদের সামনে তুলে ধরা। সাধারণ ভাষার বর্ণনার লক্ষ্য থেকে এই লক্ষ্য কিন্তু একেবারেইআলাদা। কারণ, সাধারণ ভাষাসংক্রান্ত বর্ণনা যখন কোনো ভাষার গঠন ও তার উপাদানের প্রয়োগ ও ব্যবহার সম্পর্কিতআলোচনা িনয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন জনজাতির ভাষিক উপাদান সেই গোষ্ঠীর অন্তনির্হিত ভাষাজ্ঞােনর সীমানা ছাড়িয়ে তাত্ত্বিকআলোচনার পর্ব পেরিয়ে গোষ্ঠীর ধ্যান-ধারণার বিমূর্ত উপাদান, তার বিবাদ ও বিভাজন, তার প্রয়োগ ও প্রয়োজনীয়তা বোঝার চেষ্টা করে। ফলে জনজাতির ভাষা থেকেআমাদের বুঝে িনতে অসুবিধা হয় না তাঁদের জীবন ও জীবিকা, সংস্কৃতি ও সংস্কার, বিজ্ঞান ও বিশ্বাস, বোধ ও বৌদ্ধিকতা। মোট কথা জনজাতিদের ভাষা নমুনা থেেক তাঁদের জীবনের যে পূর্ণাঙ্গ ছবিআমরা পাই তা অন্য কোনোভাবে পাওয়া সম্ভব নয়।
    এখন হিসেব করে দেখতে হবে এই জনজাতির ভাষার নমুনা কীভাবে সংগ্রহ করা যাবে এবং এই ধরনের নমুনায় কী কী উপাদান থাকা বাঞ্ছনীয়।আমার বিচারে জনজাতির ভাষা নমুনায় দু ধরনের ভাষিক উপাদান স্থান পেতে পারে ঃ কথ্য ভাষার নমুনা ও লোককাহিনীর উপাদান। কথ্য নমুনায় কল্পনামূলক রচনা ও তথ্যমূলক রচনার উপাদান সমানভাবে থাকা জরুরী। কল্পনামূলক রচনার মধ্যে থাকতে পারে পুরাণ ও স্মৃিতকথা, লোকগাথা, গল্প, ছড়া, গান, পাঁচালি, কবিতা, রূপকথা, প্রবাদ, প্রবচন ইত্যাদি। অন্যদিকে তথ্যমূলক অংশে থাকবে কাজকর্ম, চাষবাস, হিসাবপত্র, ইতিহাস, ধর্ম ও বিশ্বাস, প্রকৃতি ও পরিবেশ, পেশা ও নেশা, রাজনীতি ও সমাজনীতি, নিয়মকানুন, সাংসারিক জ্ঞান বিজ্ঞান, প্রায়োগিক তথ্য ও উপাদান, সমাজ ও সংস্কৃতির রীতিনীতি, নিয়মকানুন, প্রথা, লোকাচার, লৌকিকতা, উৎসব অনুষ্ঠানের বিবরণ, লোকবিজ্ঞান ও খেলাধূলা, গাছপালা, প্রাণী ও পরিবেশ, শরীর স্বাস্থ্য, রোগ চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ক নানান ভাষিক তথ্য ও সংবাদ। মোট কথা এই ভাষা নমুনায় ধরা থাকবে জনজাতিদের জীবনের দৈনন্দিনআলাপচারিতা ও কথোপকথনের নানা ধরনের নমুনার অংশ। তাঁদের সমাজ জীবনের নানা ক্ষেত্র থেকে তুলেআনা কথ্য ভাষার এই সমস্ত নমুনা তাঁদের জীবনের সামগ্রিক ছবিটি সঠিকভাবে ও সার্বিকভাবে তুলে ধরতে পারবে। ফলে এঁদের কথ্য ভাষার যে স্বরূপ ও চরিত্র তার স্পষ্ট ধারণাআমরা এই সমস্ত নমুনা বিশ্লেষণ করে পাবো। এইভাবে যদি জনজাতিদের ভাষার নমুনা সংগ্রহ করে এবংআধুনিক ভাষা প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সেগুলিকে সঠিকভাবে প্রক্রিয়াকরণ ওবিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে এই সমস্ত ভাষাগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতিসংক্রান্ত এমন অনেক তথ্য ও প্রমাণ পাওয়া যাবে, যা এখনোআমাদের কাছে নেই। কাজটি কঠিন, সন্দেহ নেই। কিন্তু এঁদেরকে সঠিকভাবে জানতে হলে ও বুঝতে হলে এবং এঁদেরকে মান্য জনজীবনের মূল স্রোতেআনতে গেলে এছাড়া তো অন্য কোনো পথও নেই।
    এই ধরনের বহুমাত্রিক কাজ কোনো ব্যক্তির একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এর জন্য দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা চাই, বহুব্যক্তির যৌথ উদ্যোগ চাই, প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা চাই, সরকারী সাহায্য চাই, যথেষ্ট অর্থের সংস্থান চাই, দক্ষ লোকভাষাবিজ্ঞানী চাই, এবং ভাষা প্রযুক্তির সফল ও সুযোগ্য ব্যবহার চাই। সবার সামগ্রিক যোগদানের মাধ্যমে এই ধরনের কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যেতে পারে। ভাষা নিয়ে গবেষণায় নিবেদিত এমন কোনো বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠান সরকারি বা বেসরকারি সহায়তায় এই কাজ সম্পন্ন করতেই পারে। এবং এই কাজ যদি করা সম্ভব হয়, তাহলেআমাদের ভাষিক জীবনের একটি অবহেলিত ক্ষেত্রকে তার প্রাপ্য সম্মান দিয়ে নতুনভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতে পারে।
    জনজাতির ভাষা নিয়েআলোচনা করতে বসলেআমাদের খুব স্পষ্টভাবে মনে রাখতে হবে যে জনজাতির ভাষারআলোচনা কোনোবিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য সম্পর্কিত শাখা ছাড়াও সাধারণ সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে এই বিষয়ে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই অন্যগুলিকে বাদ দিয়ে শুধু ভাষারআলোচনা কখনোই সম্পূর্ণ হতে পারে না। এই অন্তর্বিভাগীয় বিষয়ের পাঠ ও পর্যালোচনার সাফল্য নির্ভর করবে কীভাবেআমরা সমস্ত পুঞ্জীভূত তথ্যগুলিকে ধারাবাহিকভাবে নথীভুক্ত করে, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে সকলের সামনে উপস্থাপন করতে পারছি, তার উপর।আমরা স্পষ্টই বুঝি যে জনজাতির ভাষারআলোচনা মূলত জড়িয়ে থাকে কীভাবে লোকজাতিদের জীবন, ইতিহাস ও সংস্কৃতি সেই ভাষার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, তার উপর। তাই জনজাতির বর্ণিল ভাষিক চালচিত্রে শুধু জনজাতির মৌখিক সাহিত্য নয়, ধরা পড়ে তাঁদের ইতিহাস ও বর্তমান, মনস্তত্ত্ব ও মানসিকতা, ধর্ম ও বিশ্বাস, সমাজ ও সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও পরিবেশ, নাচ ও গান, ছড়া ও কবিতা, নাটক ও কাহিনী, রূপকথা ও উপকথা, ভূত ও প্রেত, পরী ও রাক্ষস, পুরাণ ও কল্পনা, রাজনীতি ও সমাজনীতি, প্রথা ও রীতিনীতি, প্রেম ও ভালোবাসা, সংসার ও সামাজিকতা, লোকাচার ও লৌিককতা, উৎসব ও অনুষ্ঠান, কৌতুক ও হেঁয়ালি, প্রতিবাদ ্য প্রতিরোধ, বিজ্ঞান ও বিশ্বাস, খেলাধূলা ওআমোদ, ব্যবসা ও বাণিজ্য, শিকার ও সন্ধান, চাষবাস ও পশুচারণ, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, বিচার ও বিবেচনা, রান্নাবান্না ও খাদ্যাভাস - এক কথায় প্রায় সমস্ত কিছুই। স্বাভাবিকভাবেই এই বহুমাত্রিক জীবনের বিকাশ ও বিস্তার যে ভাষার মাধ্যমে ঘটেছে সেই ভাষারআলোচনা ও বহুমাত্রিক ও বহুমুখী হতে বাধ্য। সেই ভাষাকে বুঝতে হলে, সেই ভাষা সম্পর্কেআলোচনা করে কোনো মতামত দিতে গেলে, অবশ্যই হাতে গোনা দু একটা উদাহরণ দিয়ে কাজ চালােনা যাবে না। এর জন্য চাই বিশালআকারের এক বা একাধিক ভাষা নমুনার সংগ্রহ যা বিশ্লেষণ করে জনজাতি সম্প্রদায়ের জনজীবনের সামগ্রিক ছবি পাওয়া যেতে পারে।
    এবারে দেখা যাক, ভাষা প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জনজাতিদের ভাষা থেকে তথ্য ও সংবাদ তুলে এনে কীভাবেআমাদের ভাষাচর্চার কর্মযজ্ঞে বৈচিত্র্য ও পূর্ণতাআনা যেতে পারে।আমাদের মনে রাখতে হবে যে ভাষা নমুনার বিস্তৃতি ও বৈচিত্র্য যদি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়, তাহলে জনজাতিদের সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাষার সমস্ত রকম ব্যবহারের প্রকৃত স্বরূপটি সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব হতে পারে।আমাদেরআরও মনে রাখতে হবে যে এই সমস্ত জনজাতিদের ভাষার বহু সম্পদ লোকসংস্কৃতির অন্যান্য সম্পদের মতো কালের কবলে পড়ে চিরকালের মতো হারিয়ে যাবার একটা প্রবণতা রয়েছে। অনাদরে, অব্যবহারে অবহেলিত হয়ে জনজাতিদের ভাষার অনেক গান, ছড়া, পুরাণকাহিনী, গল্প, হেঁয়ালি, রূপকথা, উপকথা, প্রবাদ ইত্যাদি হারিয়ে গেছে বা যেতে বসেছে। এই সমস্ত সম্পদ যদি পুরোপুরি হারিয়ে যায়, তাহলে সেগুলিকে ফিরে পাবারআর কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। তাই যা এখনও রয়েছে তাকে যথােযাগ্য মর্যাদায় সংগ্রহ করে জনজাতিদের ভাষার একটি মহাফেজখানা তৈরি করা একান্ত জরুরি। ভাষা প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এই সমস্ত সম্পদগুলিকে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে যদি ধরে রাখা সম্ভব হয়, তাহলে পরবর্তীকালে এগুলিকে নানাভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। জনজাতিদের ভাষার সম্পদ শুধু ইতিহাসের বিষয়বস্তু নয়, বর্তমান জনগোষ্ঠীকে নতুনআঙ্গিকে গড়ে তোলার কাজেও এগুলিকে ব্যবহার করার দরকার পড়ে। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে গড়ে তোলা জনজাতির ভাষার মহাফেজখানা এক্ষেত্রে এক অত্যাবশ্যকীয় ও অপরিহার্য সামাজিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
    তবে একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়আমাদের বুঝে নিতে হবে। জনজাতিদের ভাষার শুধুমাত্র কল্পনামূলক রচনা ও ভাষিক উপাদান বিচার করে এঁদের বহুবর্ণিল জীবনের সামগ্রিক ছবি পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে না এঁদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতির পূর্ণ ছবি। এর জন্য চাই এই সমস্ত জনজাতিদের ভাষা নমুনার বহুমাত্রিক বিচার ও বিশ্লেষণ। এ কাজ অবশ্য শুধু ভাষাবিজ্ঞানীদেরআলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। একাজে সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার বিশেষজ্ঞদেরও সমানভাবে দরকার। সমাজবিজ্ঞানীরা জনজাতিদের ভাষা নমুনা বিশ্লেষণ করে সহজেই জেনে নিতে পারবেন এঁদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরণ কেমন, ব্যবসার হিসাবপত্র কীভাবে রাখা হয়, এঁদের সামাজিক জীবন কোন ধারায় কোন গতিপথে বয়ে চলে, কীভাবে এঁদের সমাজে দ্বন্দ্বমূলক অস্তিত্বের ইতিহাস রচিত হয়, কীভাবে ধর্ম ও বিশ্বাস এঁদের সামাজিক ওআত্মীক জীবনকে সুপথে বা বিপথে পরিচালিত করে, কীভাবে প্রকৃিত ও পরিবেশ এঁদের জীবনের এক অত্যাবশ্যক অংশ হিসাবে বিরাজ করে, কীভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশের দ্বারা এঁদের জীবনআবর্তিত হয়, কীভাবে রাজনীতি, সমাজনীতি এঁদের সমাজের গতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করে, কীভাবে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতি এঁদের জীবনকে নানা িনয়ম-কানুনের শক্ত নিগড়ে বেঁধে রাখে, কীভাবে লোকাচার ও লৌকিকতা এঁদের জীবনেআনন্দের বাতাস বয়েআনে, কীভাবে উৎসব, অনুষ্ঠান ও খেলাধুলা এঁদের একঘেয়ে জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে, কীভােবআধুনিকবিজ্ঞানের অনুপস্থিতির কারণে এঁদের জীবন কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের যাঁতা কলে পড়ে প্রতিদিন পিষ্ট হয়, কীভাবে এঁদের চাষ-অাবাদ সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চলে আসা প্রচলিত পদ্ধতির ঘেরাটোপে পড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মার খায়, কীভাবে এঁদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা জড়িবুটি ও ঝাড়ফুঁকের মন্ত্রগুপ্তিতে অকাল মৃত্যুর পশরা সাজায়, কীভাবে সমাজের তথাকথিত এগিয়ে থাকা মানুষদের কথার ফাঁদে পড়ে এঁদের জীবন ও যৌবন প্রতারিত হয়, কীভাবে অশিক্ষার অন্ধকারে এঁদের জীবনেরআশা-অাকাঙ্ক্ষার চাঁদ হতাশার মেঘে ডুবে যায়, ইত্যাদি। এই ধরনের নানা প্রান্তীয় ও কেন্দ্রীয়আলোচনার অন্যতম প্রধান উপাদান হল জনজাতিদের ব্যবহৃত িনত্যদিনের ভাষা ও ভাষিক উপাদান। এগুলি ছাড়া সমাজবিজ্ঞান, প্রত্নবিজ্ঞান বা নৃবিজ্ঞানেরআলোচনা খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
    সাধারণ ভাষাবিজ্ঞানেরআলোচনার ক্ষেত্রেও জনজাতিদের ভাষার নমুনার প্রয়োজনআছে, বিশেষ করে যদি মান্য ভাষা বা উপভাষার সঙ্গে এই ভাষাগুলির চরিত্রগত মিল ও গরমিলের চেহারাটা জানতে চাই। শুধু শব্দভাণ্ডার নয়, পার্থক্যের প্রমাণ পাওয়া যাবে জনজাতিদের ভাষার ব্যবহৃত বিশেষ শব্দ, শব্দবন্ধ, বাগধারা, প্রবাদ ও প্রবচনের ব্যবহার থেকে যা মান্য বা উপভাষায় উপস্থিত নেই বা রক্ষিত হয়নি। এই ধরনের ভাষার নমুনার মধ্যে ধরা পড়ে বহু প্রাচীন শব্দ, জাতিগত শব্দ, যন্ত্রপাতি ও জিনিষপত্রের নাম, পুরানো শব্দমালা, বিশেষার্থক শব্দ, প্রায় শব্দবন্ধ, ভুলে যাওয়া বাক্যাংশ ও বাগধারা, প্রাচীন প্রবাদ, অপ্রচলিত প্রবচন এবং এই ধরনের নানা ভাষিক সম্পদই তখন খুব মূল্যবান উপাদান হিসাবে সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণা ও বিশ্লেষণের কাজে লাগে। অর্থাৎ, জনজাতিদের ভাষা তার স্বাধীন গঠন ও স্বতন্ত্র বিষয়বস্তুর নিরিখে এমন অনেক তথ্য ও সংবাদ সরবরাহ করতে পারে বা বর্ণনামূলক, ঐতিহাসিক, তুলনামূলক, সমাজভাষাবিজ্ঞানের ও নৃভাষাবিজ্ঞানের কাজে খুবই দরকারী বলে স্বীকৃত হতে পারে।
    অনুমানের ভরসায় অনেকেই দাবি করে থাকেন যে জনজাতিদের ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিগুলি উচ্চারণের দিক থেকে মান্য ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিগুলির থেকে অনেকটাইআলাদা।আবার কেউ কেউ দুই ভাষার জন্য ভিন্ন ধ্বনিতালিকাও হাজির করে থাকেন। কখনও কখনও এমনও চোখে পড়েছে যেখানে বলা হয়েছে মান্য ভাষার ধ্বনিগুলি উচ্চারণ বিকৃতির কবলে পড়েই জনজাতির ভাষায় ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। প্রমাণ হিসাবে ধ্বনি পরিবর্তনের বিভিন্ন সূত্র ও পদ্ধতির কথা (যেমন, স্বরসঙ্গতি, স্বরলোপ, স্বরযোগ, বর্ণলোপ ইত্যাদি) উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত দক্ষতার মাপকাঠিতে কেউ পাঁচ, কেউ সাত, কেউ বা তার কিছু বেশি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এই সমস্ত আলোচনার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক গুরুত্ব সসম্মানে স্বীকার করে নেওয়ার পরেও যেপ্রশ্ন করতে চাইছি তা হলো ঃ শুধুমাত্র এমন কয়েকটি ধ্বনি বা শব্দগত ফারাকের নিরিখে কি একটি ভাষাকে অন্য একটি ভাষা থেকেআলাদা করে চিহ্নিত করা যায় ? কিংবা এই ধরনের গুটিকয়েক অনুমান নির্ভর প্রমাণের জোরে কি বলা যায় যে একটি ভাষা অন্য একটি ভাষা থেকে নির্গত হয়েছে ? এই প্রশ্নগুলো তোলার পিছনের কারণটি হল এই, প্রতিটি ভাষায় এমন কিছু ভাষিক বৈশিষ্ট্যআছে যা কিছু বিচ্ছিন্ন উদাহরণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। করতে হলে ভাষার অনেক গভীরে যেতে হয়, অনেক নমুনা পরখ করে দেখতে হয়, অনেক তথ্য ও প্রমাণ জড়ো করতে হয়, অনেক দিক থেকে বিচার ও বিশ্লেষণ করতে হয়। বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক ভাষার মধ্যে তুলনামূলকআলোচনাও সঠিকভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয় না।
    জনজাতিদের ভাষার ব্যাকরণ কি মান্য ভাষার ব্যাকরণের সমগোত্রীয় ? নািক এঁদের মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখা টানা সম্ভব ? এই প্রশ্ন অনেকেই করে থাকেন,আমরাও করছি। সাধারণ অভিজ্ঞতায় বলা যায় যে, জনজাতিদের ভাষার ব্যাকরণ মান্য ভাষার ব্যাকরণের থেকেআলাদা। এই যুক্তি মানতে গেলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। কেউ কি বিস্তৃত ভাষিক নমুনা বিচার ও বিশ্লেষণ করে দেখেছেন এই দুই ভাষার মধ্যেআদৌ কোনো ফারাকআছে কিনা। এবং থেকে থাকলে কতটা পার্থক্য রয়েছে, কোথায় রয়েছে, কীভাবে রয়েছে, কেন রয়েছে — এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরওআমাদের চাই। মূল বক্তব্য হল, এই সমস্ত প্রাসঙ্গিক উত্তর তখনই দেওয়া সম্ভব যখন মান্য ভাষা ও জনজাতিদের ভাষারবিস্তৃত বহুমাত্রিক ভাষিক নমুনাআপনার হাতের কাছে মজুদ থাকবে এবং সেই সমস্ত নমুনা বিশ্লেষণ করে এবং সেখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রমাণ মজুদ থাকবে এবং সেই সমস্ত নমুনা বিশ্লেষণ করে এবং সেখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করে আপনার যুক্তির ধার ও ভার বাড়িয়ে আপনার বক্তব্য সাজাতে পারবেন। তার আগে সমস্ত ভাষার ব্যাকরণ নিয়ে যাই বলা হোক না কেন তার মূল্য খুবই কম, কারণ সেগুলি আংশিক অবলোকন ও খণ্ডিত বিশ্লেষণের ফলাফল মাত্র। এখানেও দেখা যাচ্ছে তুলনামূলক ব্যাকরণ চর্চার মানচিত্রেও জনজাতিদের ভাষার নমুনার একটা দরকারি ব্যবহারিক মূল্য রয়েছে।
    জনজাতিদের ভাষার শব্দভাণ্ডার নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই এই ভাষার সঙ্গে মান্য ভাষার কিছু মৌলিক পার্থক্য চোখে পড়বে। দুই ভাষার শব্দ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত শব্দের গঠন উচ্চারণ ও অর্থের পার্থক্য প্রথমেই ধরা পড়বে। কেউ হয়তো বলবেন, বিভক্তযুক্ত শব্দ গঠন করতে গিয়ে জনজাতিদের ভাষায় এমন কিছু বিভক্তি ব্যবহৃত হয়, যা মান্য ভাষায় ব্যবহার করা হয় না। যুক্তির খাতিরে যদি ধরেই নেওয়া যে মান্য ভাষার শব্দ ভাণ্ডার জনজাতির ভাষার শব্দ ভাণ্ডার বা বিভক্তির তালিকা থেকে আলাদা, তাহলেও কিছু প্রশ্ন উঠে আসতে পারে, যেমন, এই বৈশিষ্ট্যগুলি কীভাবে জানা গেল, কানে শুনে নাকি শব্দের নমুনা বিশ্লেষণ করে। এই সমস্ত শব্দের নমুনা কোথা কীভাবে পাওয়া গেল, কোন পরিমাণে পাওয়া গেল, সেই সমস্ত নমুনার প্রামাণ্যতা কতখানি ইত্যাদি। এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর তো আমাদের তৈরি রাখতেই হবে। এই সঙ্গে আরও কিছু প্রশ্ন আসতে পারে, যেমন, এই বৈশিষ্ট্যগুলিই একমাত্র, এর বাইরে কি আর কিছু নেই ? জনজাতির ভাষায় শুধু কি শব্দগত ফারাক রয়েছে, বাক্যগত কোনো পার্থক্য কি নেই, কিংবা শব্দার্থগত বা ব্যবহারগত ফারাক কি নেই ? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেহেতু কথ্য ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলিকে উল্লেখ করা হয়, লেখার ক্ষেত্রে দুই ভাষায় কী কী ফারাক রয়েছে, তা হামেশাই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ জনজাতিদের ভাষার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো লিপির সংস্থান নেই। অর্থাৎ, জনজাতিদের ভাষায় বলার জন্য ধ্বনিমালা আছে, কিন্তু লেখার জন্য বর্ণমালা নেই।
    এখান থেকেই শুরু হতে পারে আর একটি নতুন প্রকল্প। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জনজাতিদের ভাষায় যেহেতু কোনো বর্ণমালা নেই, ফলে সেই সমস্ত ভাষা লেখার কোনো উপায় নেই, যদি না অন্য ভাষার লিপি দিয়ে কাজ চালানো হয়। যদি এই ভাষাগুলির জন্য লিপি বা বর্ণমালা তৈরি করার দরকার পড়ে, তাহলে অবশ্যই এই সমস্ত ভাষার ধ্বনিমালার বিস্তারিত সংবাদ আমাদের দরকার পড়বে। তার জন্য চাই এই ভাষাগুলির বহুমাত্রিক ভাষিক নমুনা, যা বিশ্লেষণ করেই ধ্বনিমালা নির্ধারিত হবে এবং ধ্বনিমালার উপর নির্ভর করেই বর্ণমালা তৈরি করা যাবে। আশা করি, এখানে আবার নতুন করে বলার দরকার পড়বে না যে জনজাতিদের ভাষাগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বর্ণমালা তৈরি করা ও লিখন রীতি চালু করা অত্যন্ত জরুরি দুটি কাজ এবং সেই কাজের জন্য বিস্তৃত ভাষিক নমুনা বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন। 
    জনজাতিদের ভাষা নমুনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হতে পারে এই ভাষাগুলির বিষয়াভিধান তৈরি করার ক্ষেত্রে। এই ধরনের অভিধান এই ভাষাগুলির জন্য এখনও তৈরি করা হয়নি। কিন্তু এমন অভিধানের মূল্য ভাষা ও ভাষাগোষ্ঠীর জানার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সাধারণ অভিধানের থেকে এই ধরনের অভিধান চরিত্রগতভাবে একেবারেই আলাদা, কারণ এই ধরনের অভিধানের শব্দের সম্ভার ও শব্দ সম্পর্কিত তথ্যের বদলে থাকে জনজাতিদের জীবন সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ও প্রমাণ এঁদের প্রাত্যহিক জীবন ও সমাজ জীবনের সঙ্গে যে সমস্ত জিনিস ও বিষয় একান্তভাবে জড়িয়ে আছে সেগুলির সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ এখানে লিপিবদ্ধ করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন রীতিনীতি, প্রথা, গাছপালা, দেবদেবী, নাচগান, কাহিনী ইত্যাদি বিষয়ে যাবতীয় তথ্য ও সংবাদ এখানে ধরে রাখা হয়। এই ধরনের অভিধানে প্রতিটি অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের প্রচলিত নাম, উৎপত্তি, ব্যবহার, জনজীবনের সঙ্গে সেগুলির সম্পর্ক, নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যের ইত্যাদি এই সমস্ত অভিধানে নথিভুক্ত হয়। যেমন ধরা যাক, জনজাতিদের গানবাজনা। কবে, কোথায়, কীভাবে এই সমস্ত গানের সৃষ্টি, সেই গানগুলি কে কবে প্রথম গেয়েছেন, কোথায় গেয়েছেন, গানগুলির বিষয়বস্তু কী, কী তাদের বৈশিষ্ট্য, এগুলির গায়নরীতি কেমন, কোন ধরনের বাদ্যযন্ত্র এই সমস্ত গানের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়, সমবেত গান নাকি ব্যক্তিগত গান, গোষ্ঠীজীবনের গান নাকি ব্যক্তিজীবনের গান, এই সমস্ত গানের বিবর্তনের ধারাটি কেমন, গায়কদের জীবনযাত্রার পদ্ধতি কেমন, অন্য গানের প্রভাব এই গানে রয়েছে কিনা, এই সমস্ত গান অন্য গানকে প্রভাবিত করেছে কিনা, ইত্যাদি নানা বিষয় এই ধরনের অভিধানের মধ্যে সংক্ষিপ্ত আকারে ধরে রাখা সম্ভব হতে পারে।
    একইভাবে বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবীর নাম, কীভাবে তাঁদের উৎপত্তি, বিবর্তন ও বিকাশ হয়েছে, কোন স্থানে কী নামে তাঁদের পরিচিতি, কী কী তাঁদের ক্ষমতা ও মাহাত্ম্য, কোন উপলক্ষে কীভাবে তাঁদের পুজো করা হয়, কারা তাঁদের পুজো করেন, পুজো করার রীতিপদ্ধতি কেমন, ইত্যাদি তথ্য এই ধরনের অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করে রাখা যাবে, যাতে ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে যে কেউ এই বিষয়ে বিস্তারিত না হোক, সংক্ষিপ্ত তথ্য হাতের কাছে পেতে পারেন। জনজাতিদের ভাষা, সমাজ, সাহিত্য, জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি নিয়ে যাঁরা নিবিড় চর্চা ও গবেষণা করছেন, এই ধরনের অভিধান তাঁদের খুব বেশি করে কাজে লাগবে। এছাড়াও এই সমস্ত ভাষার শব্দভাণ্ডার, বিশেষার্থক শব্দের ব্যবহার, সাধারণ ভাষা ও জনজাতির ভাষার মধ্যে পার্থক্য ইত্যাদি পরিমাপের জন্য এই ধরনের অভিধানের ব্যবহারিক প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য।
    জনজাতিদের ভাষার নমুনা প্রকাশনার জগতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। ভাষা নমুনা থেকে সংগৃহীত গান, ছড়া, কবিতা, লোককাহিনী, লোককথা, উপকথা, রূপকথা ইত্যাদি আলাদা করে বেছে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের উপকথা সংকলন, লোককথার সংকলন, পুরাণকাহিনীর সংকলন, অভিধান ইত্যাদি প্রকাশ করা যেতেই পারে। এমন কি সমাজ বিজ্ঞানের নানা বিষয়ের যেমন, লোকাচার, রীতিনীতি, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, চাষবাস, বনজ সম্পদের ব্যবহার, গাছগাছড়ার ওষধিগুণ ইত্যাদি বিষয়ের উপরেও বইপত্র প্রকাশ করা যেতে পারে যা উৎসাহী পাঠকদের সংগ্রহে স্থান পেতে পারে।
    অনুমান করা যেতেই পারে জনজাতিদের ভাষা নমুনার প্রধান ব্যবহারকারীরা হবেন সেই সমস্ত ভাষাবিজ্ঞানী যাঁরা ভাষার তথ্য ও প্রমাণের আলোকে জনজাতিদের ভাষাকে বিচার ও বিশ্লেষণ করবেন। এঁদের দলেই থাকবেন জনজাতি ভাষার অভিধান নির্মাণকারীরা, যাঁদের কাছে এই ভাষা নমুনা এক অতি প্রয়োজনীয় রত্নভাণ্ডার যেখান থেকে তাঁরা সমস্ত প্রকার শব্দ, সেগুলির ব্যবহার, উচ্চারণ বৈচিত্র্য ও ব্যবহার বিধি জেনে নিয়ে অভিধানে ব্যবহার করতে পারবেন। একইভাবে যাঁরা জনজাতির ভাষার গান, গল্প, ছড়া, প্রবাদ, বাগধারা ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করার কথা ভাবছেন, তাঁরাও এই ভাষা নমুনা ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় তথ্যের যোগান পেয়ে যাবেন।
    এঁদের পরে থাকবেন সমাজবিজ্ঞানীরা যাঁরা ভাষার জনজাতির ভাষার নিরিখে এঁদের সমাজ ও জীবনযাত্রার মানচিত্র তৈরি করার কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন। একই পথের যাত্রী হতে পারেন নৃতত্ত্বের আলোচক বা অন্যান্যরা যাঁরা ভাষার আলোকে জনজাতি জীবনের বাইরের আর ভেতরের রূপটিকে চিনে নেবার চেষ্টা করবেন। তুলনামূলক সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে এই ধরনের নমুনার মূল্য ও প্রাসঙ্গিকতা অসীম, কারণ এখান থেকেই তাঁরা বুঝে নিতে পারবেন দুই বা তার বেশি জনজাতি কীভাবে একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গেছে, কিংবা বাইরে আলাদা বলে দাবি করলেও ভাষা ব্যবহারে ও জীবনযাত্রার মূলত একই স্রোতের সঙ্গী।
    প্রকাশকরাও এই কর্মযজ্ঞে সমানভাবে অংশ নিয়ে লাভবান হতে পারবেন। জনজাতিদের গান, গল্প, প্রবাদ প্রবচন, ইতিহাস, লোককাহিনী, সমাজকাহিনী, প্রথা, রূপকথা, উপকথা ও পুরাণকাহিনীর সংকলন প্রকাশ করে একই সাথে সমাজ সেবা ও নিজেদের ব্যবসার উন্নতি ঘটাতে পারবেন। এই ধরনের বইপত্রের উদ্দিষ্ট ক্রেতা কোনো কালেই কম ছিল না। এখন তো আরো বেড়েছে। সব শেষে রয়েছেন অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, অধ্যাপক, গবেষক, জনজাতি ভাষাপ্রেমী মানুষজন যাঁদের কাছে এই সমস্ত ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা নমুনা এক অতি দরকারি তথ্যের গন্ধমাদন যেখান থেকে সচেতন রসিক খুঁজে নিতে পারবেন তাঁর সাধের বিশল্যকরণী।
    মৃতপ্রায় উপভাষা ও জনজাতিদের ভাষা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য ভারত সরকারের যে জাতীয় কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং যে পদ্ধতি অবলম্বন করে মৃতপ্রায় ভাষাগুলিকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে, সেই কর্মযজ্ঞের মধ্যে যদি পশ্চিমবাংলার জনজাতিদের ভাষাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে এগুলিকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের কাজ শুরু করা যায়, তাহলে হয়তো এঁদের অকালমৃত্যু আটকানো সম্ভব হতে পারে।