মানুষ পরিবেশ বদলাচ্ছে। পরিবেশ মানুষকে। আমার দেশে প্রান্তিক মানুষেরা জীবিকার টানে জীবন-বোঝা বয়ে চলেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। দিনের সিংহভাগ সময় কষ্ট করে কাজ করতে হয় দুমুঠো খাবারের জন্য। অনেকটা মাটি খুঁড়তে হয় তেষ্টার জল পাওয়ার জন্য। লড়াই তাদের জীবনসঙ্গী।
একটি ঘটনার কথা স্মৃতি যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করে থাকে তবে মনে পড়ে।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রনীল আচার্যের আয়োজনে আমি সৌভাগ্যবশতঃ ওঁদের দলের সঙ্গে পুরুলিয়া গিয়েছিলাম। সুযোগ হয়েছিল অন্ত্যেবাসীদের জানার। শৌভেন্দ্র শেখর হাঁসদা-র দুটি অনবদ্য বই তাঁর আগে পড়া ছিল। ‘The Adivasi will Not Dance’ এবং ‘The Mysterious Ailment of Rupi Baskey’ – অবহেলা, বঞ্চনা, শোষণ সাঁওতালদের কি দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে রেখেছে। তাদের পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিয়ে একটি গোষ্ঠীকে কিভাবে ধ্ৱংস করছে তার যথার্থ ছবি এখানে স্পষ্ট এবং প্রকট। হাঁসদার গ্রন্থ ঝাড়খণ্ড, সাঁওতাল পরগণা, ছত্তিশগড়ের মানুষদের জীবনযন্ত্রণার এক অনন্য রেখারূপ।
এক চিরকালীন অসহায়তা, অজ্ঞতা, প্রায় বিলুপ্ত গরিমার কথা উৎসুক পাঠককে এখানে মুগ্ধ করে রাখবে। অমূল্য মানব-সম্পদ অপচয়ের বেদনা স্পর্শ করবে সবাইকে। ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি তাদের প্রতিবেশী হয়েও ওদের কাছে পৌঁছাতে পারেননি। লেখার প্রসাদ গুণে হাঁসদাকে সহজে বোঝা যায়। অবজ্ঞা করা কঠিন তাঁর সাহসী কন্ঠস্বরকে। তাঁর লেখার মধ্যে এক তীব্র ভালোবাসা, গভীর স্বাজাত্যবোধ কাজ করছে। অনেকদিন পরে তাঁর মতো এক শক্তিশালী লেখক পাওয়া গেল। একথা অনস্বীকার্য Everything worth doing takes time. He, of course, keeps in mind why he is writing a book and for who and what for. At least, he just likes to drive home his home truth to every reader. He is in this alone and follows his core values। তাঁর কালির আঁচড়ে কালেরই কাহিনি। প্রতিটি গল্পই স্বয়ংসম্পূর্ণ। উপন্যাসটি সাঁওতাল মানুষদের জীবনচরিত।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রী আচার্য কিছু গবেষক, সাংবাদিক নিয়ে ব্রতী হয়েছেন খেড়িয়া শবর, মুন্ডা, গারোদের শিকড় বাকড়ের খোঁজে। ছুটে যান বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ড, বিহার, মেদিনীপুর, ছত্তিশগড়ে। প্রান্তিক মানুষদের মুখের ভাষা, শিল্প, সংস্কৃতির খবর সংগ্রহের জন্য। তাঁদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের খবরও তাঁরা রাখেন। মহাশ্বেতা দেবী যেমন তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়তে যাচ্ছে কিনা, গোয়ালের ছাগর গরুর রোগ হয়েছে কিনা, ঘরের কর্তারা কম মদ খাচ্ছে কিনা, জেলে বিনা বিচারে দিন কাটাচ্ছে কিনা, ওদের গাছ গাছড়ার খবর, ডাইনি বলে আর কাউকে পিটিয়ে মারা হল কিনা, তাঁদের হেঁসেলের খবরও রাখতেন। ছুঁতে চেয়েছেন চেট্টি, মুন্ডা, ওঁরাও, টুডুদের। তিনি যেন ব্যক্তি নন নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন। ঠিক তেমনি এঁরাও পড়াশোনার জায়গাকে মঞ্চ করে তুলেছেন এইসব প্রান্তিক মানুষেরা যাঁরা ভারতবর্ষেরই আপনজন।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গবেষকদের সঙ্গে কাজ করে বুঝলাম কোড়া ও সাঁওতালি ভাষায় প্রচুর মিল আছে। কোড়া শব্দমালার সঙ্গে বাংলা বর্ণমালার ও শব্দের বেশ কিছু মিল পাওয়া যায়। নানা ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে এক অটুট বন্ধনও তৈরি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। এবং তা সম্ভব অঞ্চলভিত্তিক কর্মশালার মধ্য দিয়ে। তাছাড়া শিক্ষামূলক ভ্রমণ, বিনোদনমূলক কর্মসূচী, বাৎসরিক ক্রীড়া ও মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নিয়মিত স্বাস্থ্য সচেতনতা শিবির, ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার ও দাতব্য চিকিৎসার আয়োজনের উপর নির্ভর। পারস্পরিক সমন্বয়ের সুযোগ বা দরজা খোলা থাকলে আমাদের শিক্ষাপাঠ সার্বিক হবে। দেখা সৃজনমূলক হলে স্মৃতি নির্ভরতা থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখা যাবে। বিভিন্নতাকে সম্মান করা এবং সহিষ্ণুতাকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধির মাধ্যমে অর্জন করা চাই।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের লেখাপড়ার বিষয় হবে ঃ চারপাশের পশুপাখি, গাছ, জলাশয়, জলের উদ্ভিদ আর ডাঙার উদ্ভিদ, সাপের কামড় থেকে সাবধানতা, নানারকম গাছের রোগ, রোগ সারাতে গাছ, গাছের রোগ মারার ওষুধ, নানারকম হাতের কাজ ও জীবিকা, নানা ধরনের লোকগান, নাচ, যাত্রাপালা, আদিবাসী নাচ, মেচ ও রাভাদের নাচ, মুখোশ নাচ, অঞ্চলভিত্তিক উৎসব নবান্ন, তালনবমী, টুসু প্রভৃতি।
এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার বিদ্যালয়ের বাচ্চাটি কী সত্যি অমনোযোগী না কি অপুষ্টিতে ভুগছে ? পুষ্টিকর খাদ্য কী ও অপরিচ্ছন্নতা ও অপুষ্টিজাত সমস্যা কী কী তা ওদের জানানো খুবই প্রয়োজন। ভালো কথা, নানাভাবে নানা উদ্যোগে কাজ চলছে এদের কষ্ট লাঘবের জন্য। কিন্তু সবাই যে এই কল্যাণ কর্মের শুভদৃষ্টি পাচ্ছেন তা নয়।
পুরুলিয়ার শবরদের গ্রামে গিয়ে দেখেছিলাম তাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা নির্বাক স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে। তাদের ছেলেমেয়েরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না বলে ওরা ঘরবন্দি। প্রতিবেশী গ্রামের ছেলেমেয়েরা স্কুল পড়তে যাচ্ছে। তাই ওরা সাইকেল বা বই-এর ব্যাগ পায় না। সাঁওতালি ভাষার বই নিয়ে যখন বইমেলা হয় কজন কেনেন সেই বই ? এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও সবাই সমান আগ্রহী নয় এইসব বই সংগ্রহে। যাঁরা গ্রাম ছেড়ে বাইরে পড়াশোনা করছেন তাঁরা দূর থেকে দেখেন বা সযত্নে বর্জন করেন আঞ্চলিক উৎসব, যাত্রাগান। সেই দুঃখময় অভিজ্ঞতা হয়েছে। ওরা যদি পড়শিদের সঙ্গে জীবনচর্চায় একাত্ম হয়ে তাদের সঙ্গে একযোগে কাজ করে আরও ভালোভাবে জীবন ধারণের ধারণা দিতেন তবে উভয়েরই মঙ্গল হত। ওঁদের সারস্বত সমাজের মানসিক দিগ্বলয়ের মধ্যে এই অন্তেবাসী মানুষেরা কি ঠিক খাপ খান না ? অথচ প্রগতির দায়দায়িত্ব তো সবাইকেই নিতে হবে। আমি মনে করি বিকাশ তখনই সম্ভব যখন গ্রামগোষ্ঠী তাঁদের অন্তরে উপলব্ধি করতে পারবেন যে তাঁদের উন্নতির দায়িত্ব তাঁদের নিজেদের কাঁধে।