উপকূলের ভাষা : পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা - অতসী নন্দ গোস্বামী

    ভাষা বিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণা নানা ধরনের হতে পারে। 1. Central / Core Linguistics, 2. Peripheral Linguistics বিষয়ক গবেষণা বহির্বিষয়ক গবেষণাতে আমরা মূলতঃ মুখের ভাষার বিষয় আলোচনা করে থাকি। যদিও মান্যতা পায় শহরকেন্দ্রিক ভাষা তবুও অঞ্চলভেদে কিংবা ভৌগোলিক সীমানা ভেদে ভাষার খানিকটা তারতম্য ঘটে থাকে। আলোচিত দুটি জেলাই সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল। তাই উভয়ের কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাষাতাত্ত্বিক সাজুয্য লক্ষিত হয়।
    আমাদের মনে রাখতে হবে, ভাষা ক্রমশ বদলায় যেহেতু ভাষা একটি জীবন্ত বিষয়। দুটি জেলার সব অঞ্চলের ভাষা যে একই রকম তা নয়। ভাষা তার নিজস্ব পথ ধরে ক্রমশ বিবর্তিত হয়ে চলেছে। উপভাষা যখন শিষ্টভাষার সংস্পর্শে আসে, তখন সে শিষ্টভাষার আদর্শে নিজেকে বদলাতে চেষ্টা করে। অন্যেরা শুনে হাসবে, সুতরাং আমার বলাটা অন্যদের মত করি। এক্ষেত্রে কাজ করে এক ধরনের ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স। তবে শিষ্টভাষার মাধ্যমে সংযোগ সাধন করার ফলেও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। যেমন, জনসভায়, ক্লাশঘরে, বেতারে, টিভিতে কথা বলার সময় শিষ্টভাষাকেই মাধ্যম করতে হয়।
স্থান নামঃ 
১।    একটি মাত্র পদ দিয়ে গঠিত – কাঁথি, হেঁড়িয়া, দীঘা, পিছাবনী, 
    এগরা ইত্যাদি।
    ক)    [পূ. মে.]
    খ)    [দ. চ.] – ধামুয়া, হোটর, ন্যাতয়া, শাসন, হোগলা ইত্যাদি।
২।    দুটি পদ দিয়ে গঠিত – রসুলপুর, জুটপুট, মাধাখালি, কালিনগর ইত্যাদি।
    ক)    রাজপুত, সোনারপুর, দাসপাড়া, পায়রাডাঙ্গা ইত্যাদি।
৩।    তিনটি পদ নিয়ে গঠিত – 
    ক)    ছোট উদয়পুর, বাল্য গোবিন্দপুর, ব্রজবল্লভপুর ইত্যাদি।
    খ)    দক্ষিণ বারাসাত, ছোট মোল্লাখালি, 1নং মাঝের গ্রাম ইত্যাদি।
    একাধিক পদ নিয়ে গঠিত গ্রামের ক্ষেত্রে দেখা যাবে, নামগুলির শেষ অংশে যুক্ত হয়েছে 
    কতকগুলি বিশেষ শব্দ। যেমন –
    খালি, ডাঙা, দাঁড়ি, দিয়া, দহ, চক, চর, মহল, তলা, তলী, গাছা, গাছি, গ্রাম, পুর, নগর, 
    বাড়ি, হাট, হাটী, খানা, গঞ্জ, নাভি, বেড়িয়া, সাজী, শরীফ, পুকুর ইত্যাদি শব্দ।
    দুই জেলাতেই দিক নির্দেশক উত্তর বা দক্ষিণ, পূর্ব বা পশ্চিম পূর্বপদ ব্যবহৃত হয়। যেমন 
    – উত্তর বাকনান, পূর্ব পুটিয়ারী, পশ্চিম খটিয়াল ইত্যাদি।
দেববাচক শব্দ –
    ক)    হরিপুর, রাধাপুর, মাধবপুর, ভীমেশ্বরী, কৃষ্ণনগর, পাঁচহরি, মুগবেড়িয়া, 
        বাসুদেববেড়িয়া ইত্যাদি।
    খ)    পঞ্চাননতলা, বিশালাক্ষীতলা, লক্ষ্মীকান্তপুর, হিরনাভি ইত্যাদি।
প্রচলিত হেঁয়ালি বা ধাঁধা থেকেও ভাষার নমুনা সংগ্রহ করা যেতে পারে। যেমন –
    ক)    ১।    বন নু বারিল টিয়া সোনার টপুর মাথায় দিয়া। [ = আনারস ]
        ২।    ঘরের ভিতর ঘর  তার উপর বুস্যা আছে চাঁদ সদাগর। [ = মশারী ]
    খ)    ১।    চান তাহার এককালে বসে ভ্যারেন্ডার ডালে। [ = মাছরাঙা ]
        ২।    বন কি বাদাড়, ফলি কি তলোয়ার, তিন মাথা দশ
            ঠ্যাং দেখেছ কি কোথাও [ = দুই গরু দিয়ে চাষীর লাঙল দেওয়া ]
খেলাধুলোর জগতের নামগুলিও উল্লেখযোগ্যঃ
    বৌবসন্ত / বৌবাসন্তি বা বুড়িবাসন্তি, ঘুঁটিখেলা, একটি বালিশ চাইল, কুমীরডাঙা, ভাতচাবি (সরিষা-নুরপুর),খই দই, ঢেঁকিখেলা, ডাংগুলি, পিট্টু ইত্যাদি।
এছাড়াও এই দুই অঞ্চলে ব্যবহৃত বেশ কিছু বিশিষ্ট অর্থে প্রযুক্ত হয়। যেমন –
    এক ঝোঁক — (বেশ কিছুটা পথ),
    কাঁড়ি — (অনেক),
    খরো — (দ্রুতগামী),
    শেনি শিউনি — (জল ছেঁচবার তেকোনা পাত্র), 
    খেপমারা — (বারবার বয়ে আনা)
    ফকফকে — (হালকা),
    ভ্যাদা — (বোকা),
    বলন দেওয়া — (পাইকারী মাছ বিক্রেতারা খুচরোর থেকে বেশি দেয় ওজনে),
    খচন — (দুর্বাক্য),
    বিলি — (বেড়াল),
    ভুঁকুড় — (ঘুষি) ইত্যাদি।
দ্রাবিড় শব্দের প্রভাবও পাওয়া যায়।
    নোলা — (মালায়ালাম — নোলা, কানাড়ী — লোলে) শব্দে। দক্ষিণ ২৪ পরগণায় ব্যবহৃত ‘নোলাসাদা’ অর্থাৎ হ্যাংলা অর্থে প্রয়োগ হয়।
    ছেলেপুলে — তামিল— পিল্লৈ, ওড়িয়া — পিলা, কিংবা তদ্ভব রূপ ‘পোলা’ (বঙ্গালী) < (পোতলা-র সঙ্গে)
    দুই অঞ্চলের ভাষাতে রাঢ়ী উপভাষার বৈশিষ্ট্যগুলি পাওয়া যাবে। কিন্তু সেগুলি ছাড়াও এর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা Linguistically ভাবা যেতে পারে। একটি হল Segmental feature অন্যটি হল Suprasegmental feature।
    মেয়েরা বিশেষ করে বিশেষ Suprasegmental tone ব্যবহার করে থাকেন। কিছুটা সুরেলা। স্বরের ওঠানামা বা কখনো কোনও স্বরে accent দিয়ে থাকেন। কাউকে ডাকবার সময় এক ধরনের প্লুতস্বর ব্যবহার করেন। যেমন —
“ও কচি, কচি রে-এ-এ-এ”।
আবার উপকূলবর্তী মাঝিরাও পেশাগত কারণে এই Suprasegmental toner ব্যবহার করেন।
স্বরধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য –
(i)    ইয়া > এ ধ্বনিতে পরিণত।
    গড়িয়া > গোড়ে, চলিয়া, চোলে, দিবা > দ্যে, নিয়া > ন্যে [ দ. চ. ]
    ইয়া > অ্যা ধ্বনিতে পরিণত।
    গড়িয়া > গড়্যা, পড়িয়া > পড়্যা, করিয়া > কর্যা্, ভাবিয়া > ভাব্যা [ পূ. মে. ]
(ii)    ই > এ ধ্বনিতে রূপান্তর।
    দিলো > দেলো, ইজ্জত > এজ্জোত [ দ. চ. ]
(iii)    ইও > ও –তে পরিণত [ ই-ধ্বনির লোপ ]
    হোমিওপ্যাথি > হোমোপ্যাথ
    ব্যাঞ্জনধ্বনির ক্ষেত্রেও আমরা নানারকম Transformation লক্ষ্য করব। যেমন – বিপর্যাস, লোপ, রূপান্তর এবং সংযোজন প্রভৃতি।
লোপ —
    শলাকা > শোল, জোয়াল > জোল
রূপান্তর —
    বছর > বচর, দেখা > দেকা, বেঁধে > বিঁদে
বিপর্যাস —
    রিকশা > ইসকা, আন্দাজ > আনজাদ, পিশাচ > পিচেশ ইত্যাদি।
    ডায়মন্ডহারবার সাবডিভিশন ছাড়া মুন্ডা এবং ওঁরাও জাতির লোকেরা বাংলা ও হিন্দি মিশ্রিত এক ধরনের মিশ্রভাষা ব্যবহার করেন। এই ভাষাতে বলে ‘সাদানি’, ‘সাদরি’ বা ‘নাসপুরিয়া’। যেমন—
১।    দাদা লাগেনি কিনি দেবো / এক জোড়া জুতো রে
    ভৌজি লাগোন কিনি দেবো / ওহেই লালা শাড়ি রে
    জেতেই দাম লাগি কেতো / কিনি দেবো শাড়ি রে
    তবে IPA ঠিকমত ব্যবহৃত না হওয়ায় অসুবিধের সৃষ্টি হতে পারে। যেমন - Sari — শাড়ি / সারি দুটোই হতে পারে।
    পরিশেষে একটি কথা কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর সঙ্গে সংযোগ রাখতে মূল ভাষা বদলে যাচ্ছে এবং হারাতে বসেছে। বর্তমানে প্রজন্ম বাংলা ভাষাকেই গ্রহণ করতে চাইছে। এই সময় যথেষ্ট গবেষণার প্রয়োজন।