গ্রন্থ সমালোচনা - শিপ্রা মুখার্জী

    অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত লিসেন টু দ্য ফ্লেমস বইটি সমগ্র ভারতের থেকে সংগৃহিত দলিত সাহিত্যের একটি ইংরাজী সংকলন। গত পাঁচ দশকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষা সাহিত্যে দলিত সাহিত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছে। ক্রমে এই সাহিত্য ভাষা সাহিত্যের অপেক্ষাকৃত ছোট গণ্ডী অতিক্রম করে অনুবাদ সাহিত্যে গৃহীত হয়েছে, এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশের মানুষের কাছে পৌঁছেছে, এবং ভারতবর্ষের গণ্ডী অতিক্রম করে পা রেখেছে বৃহত্তর পৃথিবীতে। লিসেন টু দ্য ফ্লেমস এই অনুবাদ সাহিত্যের অন্তর্ভূক্ত।
    যদিও ভাষা সাহিত্যে দলিত লেখার প্রকাশ ঘটে ১৯৬০-এর দশকে, ইংরাজী অনুবাদে দলিত সাহিত্যের প্রথম বই অর্জুন ডাংলের সম্পাদিত গ্রন্থ পয়জন্ড ব্রেড। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় এই বই। কিন্তু বাংলার থেকে আহৃত কোনো দলিত সাহিত্যের খবর আমরা তাতে পাইনি। বস্তুত গত আড়াই দশকের যে অনুবাদ সাহিত্যের উপর ভর করে দলিত সাহিত্যের জয়যাত্রা তাতে বাংলায় লেখা কোনো দলিত সাহিত্যের হদিশ পাওয়া যায়নি। দেবেশ রায়ের সম্পাদিত দলিত বইটি প্রকাশিত হল ২০০১ সালে, কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলা দলিত সাহিত্যের কোনো উল্লেখ এই বইটিতেও ছিল না। একাডেমিক সাহিত্যের মূলধারায় প্রথম বাংলা দলিত লেখার উল্লেখ আমরা পাই ২০০৭ সালে মীনাক্ষী মুখার্জীর মুখবন্ধসহ মনোরঞ্জন ব্যাপারীর এক রচনায় যা প্রকাশিত হল ই পি ডব্লিউ (ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি) পত্রিকায়। ‘ইজ দেয়ার দলিত রাইটিং ইন বাংলা ?’ — ‘বাংলায় দলিত লেখা আছে কি ?’ এই রচনায় বাঙলার বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী সমাজ প্রথম খোঁজ পেল বিভিন্ন দলিত প্রকাশকদের — চতুর্থ দুনিয়া, অদল বদল এবং ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থা। এর পরে অক্সফোর্ড থেকে দলিত সাহিত্যের উপর আরো কিছু বই বেরোলেও তাতেও বাঙলার কোনো উপস্থিতি ছিল না। বাংলা দলিত সাহিত্যের প্রথম ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশিত হয় ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান থেকে ২০১২ সালে। যদিও বাংলা দলিত সাহিত্যে এটি একটি মাইলস্টোন, কিন্তু বইটির গল্প চয়নে ও অনুবাদের দক্ষতায় কিছু খামতি থাকাতে বইটি তার যথাযথ মর্যাদা পায়নি। লিসেন টু দ্য ফ্লেমস বইটি সেই ফাঁক ভরাট করল।
    মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট, কেরালা, উড়িষ্যা, আসাম, পাঞ্জাব, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত লেখাগুলি সযত্নে পরিবেশিত হয়েছে এই গ্রন্থে। সাহিত্যের মূলস্রোতে অপরিচিতির কথা মাথায় রেখে সম্পাদকেরা প্রত্যেকটি কবিতা বা গল্পের আগে একটি ছোট ভূমিকা রেখেছেন। তাতে সম্পাদক-রচিত লেখক পরিচিতির সাথে রাখা হয়েছে লেখকের নিজ-মুখে বলা বা লেখা কিছু কথা, যার থেকে তাঁর মনের আভাস পায় পাঠক, ক্ষণিকের জন্য হলেও এক ঝলক দেখতে পায় লেখকের পৃথিবী। গুজরাটের কবি জয়ন্ত পারমারের লেখায় উঠে আসে তাঁর উর্দু ভাষা-চয়নের ব্যাখ্যা। আহমেদাবাদের মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় থাকার সুবাদে তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে উর্দুর সাহচর্যে। অসুস্থ ছেলেকে মা হাত ধরে নিয়ে গেছে মৌলবির কাছে চিকিৎসার জন্য। উড়িষ্যার সঞ্জয় কুমার বাগের কথায় ধরা পড়ে পুকুর পাড়ে জলের জন্য অপেক্ষারত তাঁর পরিবারের গ্লানি। বাঙলার সুশীল মণ্ডলের কথায় জানতে পারি সুন্দরবনের বাঘের পেটে যাওয়া তাঁর বন্ধুদের কথা। দিল্লীর লেখক সেওয়াজ সিং ‘বেচয়ন’-এর কথায় জানতে পারি তাকে এবং তাঁর বোনকে ইটভাঁটার কন্ট্রাকটরের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার গল্প।
    এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে এই লেখক পরিচিতির দরকার কি। সাহিত্য সমালোচনায় আমাদের দৃষ্টি যদি মূল লেখাটির উপরে নিবদ্ধ না রেখে লেখকের জীবনী বা তাঁর পারিপার্শ্বিক প্রসঙ্গের উপর রাখা হয়, তাতে সাহিত্যের অনুষঙ্গকে অহেতুক গুরুত্ব আরোপ করা হয় না কি ? অনেক ক্ষেত্রে এই ব্যাপকতর ক্ষেত্রের প্রবেশ অনুচিত বলেও গণ্য হয়েছে। কলেজ বা ইউনিভার্সিটির পাঠ্য পুস্তক হিসাবে পরিকল্পিত এই বইটির সমর্থনে একটি প্রাথমিক যুক্তি হল এই যে মুখবন্ধের গুরুত্ব ছাত্রছাত্রীদের কাছে যথেষ্ট। তবে বইটির পরিকল্পনার সমর্থনে তার থেকেও বেশী জোরালো যুক্তি দিতে পারবে আধুনিক সমালোচনার প্রথা, যেখানে সাহিত্যের নান্দনিক উপলব্ধির সাথে একাকার হয়ে গেছে সাহিত্যের রাজনৈতিক অবস্থান।
    সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে প্রতিটি লেখক রাজনীতি লেখেন। প্রতিটি লেখকের অবচেতনে শ্রেণীচেতনা আছে, সাম্প্রদায়িক পরিচয় আছে, আমি অপরের বিভাজন আছে। বহু যুগ ধরে আমরা পাঠকেরা উচ্চ শ্রেণী ও উচ্চ জাতের সৃষ্ট সাহিত্য পড়ে এসেছি। একমাত্রিক না হলেও সেই সাহিত্য বহুকণ্ঠী ছিল না। অনুন্নত শ্রেণী বা অবনমিত জাতের মানুষের কথা বলতে হলে, উচ্চ শ্রেণী ও উচ্চ জাতের লেখককেই তা বলতে হত। ফলতঃ এই স্বরগুলি অবদমিত ও সাহিত্যের পাতায় অধরাই রয়ে গেছে। এর পরিণাম কিছু ভ্রান্ত ধারণা যা আমরা সত্য বলে চিনেছি। কবি জয়ন্ত পারমারের উর্দুভাষায় লেখার সহজ কারণে, বা হিন্দু (?) মায়ের মৌলবীর উপর ভরসায় তাই ধাক্কা খায় আমাদের সরল কাঠামোগুলি। অথচ সমাজের অন্ত্যজশ্রেণীর মানুষের মধ্যে এই পারস্পরিক সম্পর্ক বহুদিনের। পশ্চিমবঙ্গের কিছুটা প্রান্তিক অবস্থানের কারণে হয়ত এই অতিসরলীকরণ এখানে কিছুটা কম, তবে ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় এই অতিসরলীকৃত ধারণাই সত্য বলে গৃহীত। সুতরাং এই সাহিত্যের পাঠক হতে গেলে আমাদের নিজেদেরকে আরেকবার শিক্ষিত করতে হবে, নিজেদের পুরানো ধ্যানধারণাগুলিকে আরেকবার নাড়াচাড়া করে বাইরের খোলা বাতাসে এনে ফেলতে হবে। নতুন জ্ঞানের আলোয় তাদেরকে আরেকবার যাচাই করতে হবে। হয়ত এই উদ্দেশ্যেই প্রতিটি লেখার পরে সম্পাদকেরা কিছু চিন্তার অভিমুখের সঙ্কেত দিয়েছেন। সেগুলো হয়ত শুধুই ছাত্রছাত্রীদের জন্য নয়। 
    আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজে একটা ধারণা প্রচলিত আছে, দলিত সাহিত্য অর্থাৎ দুঃখ দুর্দশা ও যন্ত্রণার সাহিত্য। সেই নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে এই গ্রন্থের লেখাগুলিতে উঠে এসেছে নানান আবেগ ও অনুভূতি। সেখানে যন্ত্রণা যেমন আছে, তেমনই আছে বেপরোয়া তেজ, লড়াইয়ের আহ্বান ও বিজয়ীর উল্লাস। সুকীর্থরাণীর কবিতায় ধ্বনিত হয় অবজ্ঞার হাসি। তাঁর শরীর যার থেকে ভেসে আসে হাল্কা মাংসের গন্ধ, তাঁর বাড়ি যেখানে ঝোলে চামড়া ছাড়ানো নগ্ন হাড়, তাঁদের রাস্তা যেখানে ঘুরে বেড়ায় অশিষ্ট অকর্মণ্য যুবক, —সমাজ ভাবে এই সবকিছু সে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে লক্ষ যোজন দূরে। সদর্পে কবি জানায়, তারাই সমাজের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে। এই বইটিতে প্রেমের গল্প আছে, লড়াই জয়ের গল্প আছে, নিজের পরিজনদের পেছনে ফেলে রেখে উচ্চবিত্ত সমাজে ওঠার তাড়নার গল্প আছে। তবে এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে এই প্রেম, লড়াই, বিত্তলাভের প্রত্যেকটি গল্পই একটু অন্যরকম। আজাগিয়া পেরিয়াভনের লেখা গল্পটি প্রেমের। এই প্রেমের নায়ক যে বুড়ো চিন্নাকুঝান্ডাই সে ঢাক তৈরি করে মোষের চামড়া ছাড়িয়ে, ধুয়ে, ভিজিয়ে নরম করে, পরিষ্কার করে, শুকিয়ে। গোটা গল্প জুড়ে লেখক শুধু বুড়োর প্রেমের কথা নয়, তাঁর ঢাক বানানোর লুপ্তপ্রায় কারিগরিও সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই প্রেমের নান্দনিক রূপটি ধরতে সাধারণ পাঠককে কিছু পুরানো ধ্যানধারণা ঝেড়ে ফেলতে হয়। ভব্যতা-অভ্যবতার যে বিভাজন, শ্লীলতা-অশ্লীলতার যে সংজ্ঞা, নান্দনিক-অনান্দনিকের যে দ্বন্দ্ব — তা নিয়ে আবার ভাবতে হয়। আমাদের ‘সভ্য’ কানে গানের কিছু কথা পীড়া দেয়, চেনা প্রেমের রেখাগুলো যেন আরো গাঢ় দাগের বলে মনে হয়, চরিত্রগুলির শরীরী উপস্থিতি যেন আরো তীব্রতার সাথে উঠে আসে বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে। বেশ কয়েকটি গল্পে ফিরে ফিরে এসেছে এই ভিন্ন সংস্কৃতি। পেরিয়াভন বলেন, দলিতাদের আমি ভিক্টিম রূপে দেখতে রাজী নই। তাঁদের নিজস্ব শক্তি আছে, সংস্কৃতি আছে, এবং তাঁর প্রতিফলন তাঁদের সাহিত্যে থাকা উচিত।
    তিনটি মূল ভাগে বিভক্ত এই বইটি — কবিতা, ফিকশন-গদ্য ও নাটক এই ভাগের অন্তর্ভূক্ত, ও নন-ফিকশন-আত্মজীবনী, জীবনী ও রচনা এই তৃতীয় ভাগের অন্তর্ভূক্ত। নন-ফিকশন অংশটিতে আধিপত্য পেয়েছে লড়াইয়ের আখ্যান। জাত ও শ্রেণীর ভেদাভেদের লড়াই, যা কেরলের আয়ানকালীর জীবনীতে কার্যত যুদ্ধের আকারই নিয়েছে। এই অংশের অন্তর্ভুক্ত শ্রীলক্ষ্মণের নীরব প্রেমের গল্পও সেই লড়াইয়ের গল্প।
    সব লেখাতেই কমবেশি থাকলেও, বাংলা লেখাগুলিতে এযন স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে জাত ও শ্রেণীর পরিচয়ের ভয়াবহ সংযোগ। বাঙলার লেখক অনিল ঘড়াইয়ের ‘আগুনবুড়ী’ কবিতায় ও সুশীল মণ্ডলের ‘সুন্দরবন’ লেখাতে নিদারুণ দারিদ্র্যের ছবি। দলিত সাহিত্যে পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়ার কারণের কিছুটা বোঝার চেষ্টা করেন অচিন্ত্য বিশ্বাস তার নাটকে, — একটি কথোপকথনের মাধ্যমে লেখক অনাবৃত করেন এই ভ্রান্ত ধারণা যে পশ্চিমবঙ্গে জাতপাতের ভেদাভেদ নেই। বাম রাজনীতি স্বীকার করতে নারাজ শ্রেণী বৈষম্যের সাথে সাথে জাতের বৈষম্যের উপস্থিতি। তবে, এটাও ঠিক যে এই বইটির প্রত্যেক লেখাতেই মিলে গেছে জাত ও শ্রেণী পরিচয়। জাতের পাহাড় ডিঙিয়ে, শিক্ষার হাত ধরে চাকরীর চেষ্টা ও গরিবির থেকে মুক্তিলাভের আশা। আবার জাত ও শ্রেণীর এই সংযোগের উল্টো ছবিও আছে। পল চিরাক্কোরেডের এবং আয়াপ্পানের লেখায় ফুটে উঠেছে জাত ও শ্রেণী পরিচয় থেকে মুক্তি পেয়ে নিজের সংস্কৃতি ও পরিচিতি বেষ্টনীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার যন্ত্রণা। জাত-চিহ্নিত নাম পাল্টে নতুন জীবন গড়তে সক্ষম হচ্ছেন দলিত, কিন্তু বিনিময়ে ছিন্নমূল হয়ে হারাচ্ছেন তাঁর প্রিয়জনদের। দারিদ্রের বন্ধুর পথের বাস্তব ছবি ঠিক এতটা রূঢ় ভাবে আগে দেখা যায় নি বলে মনে হয়।
    বিভিন্ন ভাষা সাহিত্য থেকে জোগাড় করে নিছক অনুবাদ করে বানানো হয়নি এই বইটি। সতর্কতা ও মনোযোগের সাথে বাছা হয়েছে লেখা, যত্নের সাথে করা হয়েছে অনুবাদ। বহু অনুবাদ সংকলনে যেরকম হয়, — বিভিন্ন লেখা কিন্তু সবাই এক ভাষায় লিখছে, — অমল লিখছে না তৃপ্তি লিখছে বোঝার উপায় নেই, — এই সংকলনে তা হয়নি। বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ করেছেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইন্দ্রনীল আচার্য। সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ অনুবাদ। নাম-না-জানা লেখকের সাথে আছে আম্বেদকর বা বামার মতন নামকরা লেখকের লেখা। বেশীর ভাগ লেখাই আত্মকথা-ধর্মী। এই রকম অভিজ্ঞতার বিবৃতি দিয়েই নির্মাণ হয় আধুনিক সাহিত্যের টেস্টিমোনিও বা উইটনেস লিট্রেচার। সাক্ষ্য সাহিত্য। কোনও বিশেষ ঘটনা বা মুহূর্তের থেকে উদ্ভূত অভিজ্ঞতা শব্দ-বাক্যে ব্যক্ত করে। উত্তরকালে যা ঐতিহাসিক দলিলের স্বীকৃতি পায়। এ বই বিদ্বজ্জন সমাজে উপস্থাপন করার যে অ্যাকাডেমিক ভাবনা ও শৃঙ্খলা, তা দেখে সম্পাদকের প্রতি সম্ভ্রম জাগে। ত্রুটি একটিই, বিষটির উপর কোনো গ্রন্থপঞ্জি আর নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়নি। ভবিষ্যৎ সংস্করণে এটি যোগ করলে হয়।
    উত্তরপ্রদেশের বাঙ্কা গ্রামে চন্দ্র ভান প্রসাদ ২০১১ সালে একটি দেবীর মন্দির স্থাপন করেন। দেবীর নাম ইংরাজী শিক্ষার দেবী। এই দেবীকে তিনি দলিত জাগরণের দেবী বলে স্বীকার করেন। দেবীর এক হাতে একটি কলম, এবং অন্য হাতে স্বাধীন ভারতের সংবিধান, যা দলিত মানুষদের দিয়েছে মানুষের সম্মান। ইংরাজদের আধিপত্যকে ঘৃণার চোখে দেখতে পারেননি বেশির ভাগ দলিত। ভারতবর্ষে ইংরাজ ও ইংরাজী ভাষার প্রবেশে জাতপাতের লৌহবন্ধন আলগা হয়েছিল। ঔপনিবেশিক ইতিহাসের এই ভিন্নতা বইটির কিছু গল্পেও প্রকাশ পেয়েছে। অথচ এই ইংরাজী-প্রেমে অনুকরণ বা নকলনবিশের ছাপ নেই। দলিত সমাজের এই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষাপ্রাপ্ত লেখকের আধুনিক ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে দুমড়ে মুচড়ে নিজেদের মতন করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। ভারতবাসীদের ঘাড়ে চেপে বসে থাকা দুশো বছেরর সাহেবের ভুত ভাগাতে হয়ত এঁরাই পারবেন। তাই গুনিনের ছেলে তামিল কবি রাজকুমার কবিতায় তাঁর নিজের শিকড়ের কথা বলে। তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে তাঁর সমাজের মিথ, লোকাচার, যাদু, দেশজ বিশ্বাসের আধার। আধুনিক কবিতায় প্রকাশ পায় তাঁর প্রাচীন সম্প্রদায়ের অহংকার। বহুদিনের পুঞ্জীভূত ক্রোধে সে ছুঁড়ে দেয় তার অভিশাপ, অপর জাতের যে মানুষ হাতে নিয়ে পড়বে তার এই তালপাতার পাণ্ডুলিপি দগ্ধ হবে সে। ব্রহ্মতেজে নিক্ষেপ করা যে ব্রহ্মশাপ, কোনো ভাবেই তাঁর থেকে দুর্বল বলে মনে হয় না রাজকুমারের এই অভিসম্পাত।