প্রকাশিত গ্রন্থের দুনিয়া - জয় দাস

হিমালয় সংলগ্ন উত্তরবঙ্গের লোকনাট্যঃ লোকনাট্যের আরেকদিক
    — জয় দাস
    সাহিত্য বাস্তব বহির্ভূত নয়। সাহিত্য আঙ্গিকগুলির মধ্যে একমাত্র নাটকই হল দ্বিমুখী। একমুখ তার লেখনী, আর একমুখ তার অভিনয়। নাটকের আবেদন সরাসরি। আর সেই নাটক যদি আমাদের চেনা ভৌগোলিক পরিবেশের কাঁচামাটি ছুঁয়ে থাকে, ছুঁয়ে থাকে সোঁদা গন্ধ, ছুঁয়ে থাকে আঞ্চলিক ভাষা, পেশা, মিথ, সংস্কার — তবে সে নাটকের আবেদন আরও প্রত্যক্ষ ও সরাসরি। নাটক আর নাট্য অল্প হলেও আলাদা, নাট্য হল Performance বা Performative Art আর নাটক হল তার Text বা সাহিত্য। প্রাত্যহিক আধুনিক হতে হতে আমরা হারিয়ে ফেলি নিজের আঞ্চলিক পরিচয়, কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যারা উল্টো স্রোতে ভাসেন, ড. দীপককুমার রায় এমনি একজন মানুষ। তাঁর ‘হিমালয় সংলগ্ন উত্তরবঙ্গের লোকনাট্য’ গ্রন্থটিতে তিনি তুলে ধরেন হিমালয় সংলগ্ন দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার জেলার লোকনাট্যের কথা। তিনি ভুল করেন নি দেখতে যে উত্তরবঙ্গ ‘মিনি ভারতবর্ষ’ এখানে দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য বেশি। তিনি ‘গমীরা’, ‘হুলি’, ‘মুখাখেলা’, ‘পাঁচালী’ প্রভৃতি লোকনাট্যের সাথে আমাদের পরিচয় করান। হিমালয় সংলগ্ন উত্তরবঙ্গের সংক্ষিপ্ত তথ্যবহুল ইতিহাস জানান, পালাগান, পাঁচালীগুলির উৎপত্তির কাহিনিগুলি জানান, লোকনাট্যগুলির উপস্থাপনের মঞ্চভাবনাগুলি অঙ্কন ও ছকের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে বুঝিয়ে দেন, এক-একটি নাট্যে কী কী বাদ্য ব্যবহৃত হয় — তাও তিনি উপযুক্ত ক্ষেত্রসমীক্ষা ও তথ্যপ্রমাণ সহযোগে আমাদের জানান। এরই সাথে ‘হিমালয় সংলগ্ন উত্তরবঙ্গের লোকনাট্য’ গ্রন্থে আমরা পাই কিছু লোকনাট্যের মুদ্রিত রূপ। গ্রন্থটির কম্পোজও প্রায় নির্ভুল বানান আমাদের নজর কাড়ে। প্রচ্ছদে উপরে হিমালয় ও নীচে লোকনাট্যে ব্যবহৃত মুখোশ — যেন গ্রন্থবয়ানের সংক্ষিপ্তসার। দীপক বাবুর ‘হিমালয় সংলগ্ন উত্তরবঙ্গের লোকনাট্য’ গ্রন্থটি একদিকে লোকনাট্যের ইতিহাসকে সমৃদ্ধশালী করে তেমনি অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করবার নতুন রাস্তাও দেখায়।
হিমালয় সংলগ্ন উত্তরবঙ্গের লোকনাট্য — দীপককুমার রায়
টেরাকোটা, বিষ্ণুপুর। বাঁকুড়া
মূল্য – ২০০ টাকা



মনীষী পঞ্চানন ও অসমঃ অনালোচিত অধ্যায় — জয় দাস
    রাজবংশী সমাজের প্রাণপুরুষ হলেন রায়সাহেব পঞ্চানন বর্মা (১৮৬৬-১৯৩৫)। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন পণ্ডিত ও কর্মবীর। তিনি রাজবংশী সমাজকে ক্ষত্রিয় আন্দোলন ও ক্ষত্রিয় সমিতির মাধ্যমে সংঘবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। শুধুমাত্র রাজবংশীদের মধ্যেই নয় তাঁর এই আন্দোলন ‘উত্তরবঙ্গ এবং অসমের বিশেষত অবিভক্ত গোয়ালপাড়া জেলা, কাছাড় উপত্যকা এবং মেঘালয়ের তুরা অঞ্চলে বিভিন্ন জাতি-জনজাতির মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল’। এই বিষয়টি দেখাতে চেষ্টা করেছেন ড. দীপক কুমার রায় তাঁর ‘মনীষী পঞ্চানন ও অসম’ গ্রন্থটির মাধ্যমে। অসমে ক্ষত্রিয় আন্দোলন ও পঞ্চানন বর্মা কতটা জনপ্রিয় তা তিনি প্রামান্য তথ্য সাজিয়ে উপস্থাপন করেন, কোনো গল্পকথার ফানুসে নয়। তাঁর নৈব্যিক্তক উপস্থাপনে ধরা পড়ে অসমে পঞ্চানন বর্মা’র মতবাদের বিরোধিতা, ক্ষত্রিয় সমিতির বহুবিভাজনের কথা এবং ক্ষত্রিয় সমিতির গ্রহণ-বর্জনের দিকটিও। অসমের বিভিন্ন মনীষীদের সাথে মনীষী পঞ্চানন বর্মার সম্পর্কের কথাও ড. দীপক কুমার রায় নির্ভুল তথ্যপ্রামান্যের সাহায্যে উপস্থাপন করেন। পরিশিষ্ট অংশেও আমরা পাই একটি ঐতিহাসিক স্মারকলিপি। শাখানদী যেমন মূলনদীকে সমৃদ্ধ করে তেমন করেই ‘মনীষী পঞ্চানন ও অসম’ গ্রন্থটি পঞ্চানন ও তাঁর ক্ষত্রিয় আন্দোলন লেখার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে। পেপার ব্যাকে গ্রন্থটির প্রচ্ছদ ও কম্পোজ প্রশংসনীয়। ভূমিকাতেই অসমিয়া ও বাংলা ভাষার প্রভেদটুকুও বলা হয়েছে। গ্রন্থটি আমাদের মনীষী পঞ্চানন বর্মা ও ক্ষত্রিয় আন্দোলন সম্পর্কে আরও অজানাকে জানার তথ্য দেয়। এই গ্রন্থটি ভবিষ্যতের গবেষণার নতুন দিশারি হবে— এই আশা রাখি।
মনীষী পঞ্চানন ও অসম — ড. দীপক কুমার রায়
রাজবংশী একাডেমী, শিলিগুড়ি
মূল্য – ৫০ টাকা



তিস্তাবুড়িঃ চির পরিচয় মাঝে নব পরিচয় — জয় দাস
    যে কোনো সভ্যতার প্রাণ নদী। উত্তরবঙ্গে অন্যতম নদী হল তিস্তা। সমগ্র উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে রয়েছে তিস্তার জনপদ। না, এই পরিচিতি দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত’ কিংবা উত্তরবঙ্গের ‘তিস্তা-তোর্ষা’ এক্সপ্রেসের জন্য নয়, এ পরিচিতি এ নদীর পাশে অবস্থিত রাজবংশী, মেচ, ধিমাল, লিম্বু প্রভৃতি জাতি-জনজাতির প্রাত্যহিক জীবনগাথায়, মিথ কথায়, অভিজ্ঞতায় — ছড়ানো ছিটানো ও সমৃদ্ধশালী। এ তিস্তা লেপচা জনজাতির রঙ্গিত ও রংগুর প্রেমিক প্রেমিকার লোককথা, এ তিস্তা রাজবংশী নারীব্রত ‘তিস্তাবুড়ির পারনা’। এ তিস্তা ছড়িয়ে আছে উত্তরবঙ্গের লোকগানে, এ তিস্তার কথা আছে পুরানে, দেবী ভাগবতে। একদিকে বিস্তীর্ণ সময় ও অন্যদিকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আছে তিস্তাবুড়ি। গতিপথ বদলেছে তিস্তা বহুবার, বন্যায় ভাসিয়েছে জনপদ, তাই তো সে দুঃখের নদী। ছড়ানো ছিটানো, কালবিস্তৃত তিস্তার তথ্যকে একত্রিত করতে সময়, নিষ্ঠা, অর্থ ও বহু পরিশ্রমের প্রয়োজন। বিভিন্ন জাতি-জনজাতির মানুষের সাথে মিশে গিয়ে তাদের আঁতের কথা বের করে আনা সহজ নয়। ‘তিস্তাবুড়ি’র লেখক ড. দীপক কুমার রায় মহাশয় তার নিবিড় অধ্যবসায় ও কঠিন পরিশ্রমে কাজটি সুসম্পন্ন করেন এবং আমাদের তিস্তার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধশালী করে তোলেন — অসম, পশ্চিমবঙ্গ, নেপাল এবং বিহারের নানা স্থানের ক্ষেত্রসমীক্ষার ভিত্তিতে। পরবর্তী গবেষকদের নতুন গবেষণার দিশা ও আগ্রহী পাঠককে নতুন করে তিস্তাকে জানার জুগুপ্সা বাড়িয়ে দেয় এই ‘তিস্তাবুড়ি’ গ্রন্থটি। বইটির নির্ভুল কম্পোজ ও প্রচ্ছদ ভাবনাও প্রশংসা যোগ্য। প্রচ্ছদে তিস্তাবুড়ির মূর্তি, জাতি-জনজাতির চিত্র ‘তিস্তাবুড়ি’ গ্রন্থের একটি অঙ্কন ভূমিকা প্রদান করে ও সাক্ষাৎকারের চিত্র দীপকবাবুর কাজের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমকে ফুটিয়ে তোলে।
তিস্তাবুড়ি — দীপক কুমার রায়
সোপান পাবলিশার, কলকাতা
মূল্য – ২০০ টাকা