“দৌড়বোগড়ার উপাখ্যান” পশ্চিম সিংভূমের আদিবাসী জনজীবনের কৃষ্টি-সংস্কৃতির আখ্যান যেখানে শুধু তথ্য নয়, অভাবী বনবাসী জীবন ভুঁইলতার মত ছুঁয়ে আছে আকরিক মাটি। শাল-গামার-শিশমের দেশে অভাব সর্বত্রগামী হলেও ভূমিপুত্রদের মানসিক দৃঢ়তার হেরফের ঘটে না। দৌড়বোগড়া একটি ছোট নদী বা স্রোতধারা যার দু’ধারে জনবসতি শোনে ছোট ছোট ঢেউয়ের ঘুঙুর বাজানোর শব্দ। অধিক বর্ষায় পাহাড় চুঁইয়ে লৌহ-আকরিকের ঢল নামে নদীতে। যেখানে লোহা আছে সেখানে সোনার কুঁচি থাকা আশ্চর্যের নয়। সোনা আর লোহার পীরিত-সোহাগ আজন্মের। হো, মুন্ডা আর সাঁওতালি অধ্যুষিত এলাকায় সমাজ জীবন নিজের প্রয়োজনে ভাষার জন্ম দিয়েছে। রীতি-রেওয়াজ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আলাদা। এ সত্ত্বেও কোথাও একটা অন্তনীল আদিসুর বাজে যে সুরে দুলে ওঠে প্রাণ, নব বসন্তে পলাশের কুঁড়ি লাবণ্য স্পর্শ দিয়ে যায়। ফুলপরবের গীত মাঘী পরবের আয়ুকে দীর্ঘায়িত করে। মহুয়া গাছের ডালে মিহি গলায় পাখি ডাকলে খাপরার ঘরে অনেকেরই মন ধরে না, বিবাগী বাতাসে বাউল হয়ে ওঠে গৃহস্থ মন। হীরালাল বুড়া আর গুরুবারি তাদের যুবক বয়সে ফিরে যায়। চেনা গতর, চেনা গাছের কুসুমবৃন্ত তবু নারী শরীরে কি এত খোঁজে হীরালাল ? তার অনুভবী চোখ মাটির নীচে কতটুকু সোনা আছে তা বলে দেয়। এমন যার পর্যবেক্ষণের তীক্ষ্মতা, এই শেষবেলায় এসে সে কি খোঁজে ? রাতের অন্ধকারে খড়ের চালার নীচে গুরুবারির কাচ শরীর যেন হয়ে ওঠে দৌড়বোনালার ভেজা গতর। এই তণ্বিষ্ঠ অন্বষণে হীরালালের মনে হয়, বউটার শরীরে এক ফোঁটা মাংস বা বস্তু নেই, যা আছে শুধু মাটি। কালো-কালো আকরিক ভরা মাটি। তার খাঁজে-খাঁজে, ছন্দে-বাঁকে যেন জড়িয়ে আছে পাহাড় চুঁয়ানো খনিজ সুগন্ধ। যে মাটিতে লুকিয়ে থাকে আকরিক— সে মাটি তো বলে দেয় সোনার ঠিকানা। শুধু দৌড়বোগড়ায় নয়, শরীরের নদীতে সোনা খোঁজে অভাবী মানুষের দল। তাদের হাতে অঙ্কুশ, পাটাতন জলে ভাসানো অ্যালুমিনিয়ামের বাটি। তানু ভাত খেয়ে শীতকালে শুরু হয় সোনা খোঁজার কাজ, পুরো বস্তি যেন নতুন ভাবে বেঁচে উঠতে চায়, নতুন পাতার কাঁপন শুরু হয় তাদের মনের নির্মল বনাঞ্চলে। প্রকৃতি নির্ভর কৃষিব্যবস্থায় ভাগ্য নির্ভর চাষ প্রথায় চোখ কাঁদে আকাশের দিকে তাকিয়ে। বৃষ্টি হলে চাষ হবে, মাঠ নাচবে সবুজ সংকেতে... না হলে ফক্কা। জীবন তাই শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, শরীরের ঘাম তাই ভাগ্য নির্ভর হতে পারে না। মানুষ কাজ চায়। কিন্তু পাথর দেশে কাজের বড় অভাব। তাই সকাল হলে শীতকালটা সোনার সকাল হয়ে যায়। সেখানেও সেই খোঁজ, অন্বেষণ। যে বছর ধান ভাল হয়, সে বছর পাহাড়ের জঙ্গল ভেদ করে হাতি আসে, তারা ফসল তছনছ করে অন্ধকার বিছিয়ে দিয়ে চলে যায়। জীবনের খোঁজে অসমযুদ্ধে হেরে গিয়ে পেটের গর্ত ভরাতে আবার শুরু হয় অন্বেষণ। এ খোঁজ অনন্ত এবং আদিম। প্রাচীন বৃক্ষের শেকড়ের মত কঠিন তার জেদ। ঝড় আসে আসুক তবু সে ভাঙবে না, উপড়াবে না, মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে মাটির মায়ায়। গোয়েলকেরা, সোনুয়া থেকে আধুনিকতার বাতাস আসে, বিড়ি বদলে সিগারেট খায়, হাড়িয়ার বদলে কেউ বিয়ার খায়, নিমদাঁতনের বদলে কেউ ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দাঁত মাজে... তবু অণ্বেষণ-পর্ব থামে না, দৌড়বোগড়া তিরতিরে স্রোতের মত তার গতি, কখন ভেঙে যায় জাত্যাভিমানের বেড়া, উচ্চ-নীচের সীমান্ত... ভাষার লতানে গাছে ফুল ফোটে যে ফুলের সুগন্ধ আছে আর সেই ফুলের ভেতর খাপটি মেরে বসে থাকে রাজনীতির সন্তান। তেঁতুলতলার ছায়া ওদের ঘষা কাচজীবনের পরম প্রাপ্তি, মুঠো মুঠো মাটির গন্ধে ওদের আয় বাড়ে। খিলসি বা টাপুরা ভাত ছাড়া বাঁচলেও ভালোবাসা ছাড়া বাঁচে না। এসবের মাঝখান দিয়ে বয়ে যায় নানা ঋতুর দৌড়বোগাড়া। একটা ছোট নদীরও বিশাল প্রভাব থাকে ক্ষুধার সঙ্গে লড়ার। হীরালাল বুড়া শিমের খাঁচি ভেঙে নিয়ে মাটিতে দাগ কাটে শুধু নিজের জন্য নয়, এই দাস রাউতু-তম্যায় কিংবা বস্তির অন্যান্য মানুষগুলোর জন্য। তার এই মাটি চেনার দক্ষতা একদিনের নয়, পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে অর্জন করা। মাটি দেখে কোথায় সোনা আছে তা বলে দিতে পারে হীরালাল বুড়া। দৌড়বোগড়ার জলে পলি পড়ে কালচে লোহার। সেই কালচে ‘লোহার মল’ বয়ে আনে সোনার কুচি। পশ্চিম সিংভূমের মানুষরা গান বাঁধে এসব নিয়ে, ‘যা তে বাতে পেরিয়েআ কানা/সোনা-চান্দিতে পেরিয়ে কানা/দিশুম ছোটনাগপুর তাইন্ হীরানাগপুর’...। গলায় বুনো সুর তুলে আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষ যায় দৌড়বোগড়ায়। কেউ পায়, কেউ আবার শূন্য হাতে ফিরে আসে। তবু মায়া-অন্বেষণের শেষ নেই। শ্বাস ফুরালে শরীরের জল শুকিয়ে ভেসে উঠবে হাড়-পাঁজরা। মাস-মজ্জা পচে গলে সার হবে। যত দিন সার না হয় এ দেহ ততদিন খোঁজা। দুই নারী, এক পুরুষ। নারী ধারণ করে সোনা। পুরুষ খোঁজে। খোঁজায় কোন পাপ নেই।
হাড়িয়াওয়ালির মুখের হাসিটা মহুয়া রংয়ের। কুসুম তেল মাখায় চকচক করে চুল। রাঁচি থেকে শিবা এলে তার এখানে হাড়িয়া খায়। এই ঠেকে তার বাবা দয়ানন্দ কোড়া-ও আসে হাড়িয়া খেতে। এই সংস্কৃতির ভেতর হাড়িয়ায় চুমুক দিলে তেতো লাগে শিবার। কেন লাগে ? হাওয়ায় হাড়িয়া-ঠেকের পলিথিন নড়ে উঠলে নীল মেঘের মতন মনে হয়। শিবার বন্ধু ধনকুমারের ঠোঁটে মজার রং, তার চোখ যেন জীবন খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে দৌড়বোগাড়ায়। মুরগা লড়াই-এর মাঠে কি শুধু মোরগ লড়ে, মোরগের পাশাপাশি মানুষও লড়ে, কেননা জুয়া এবং লড়াই ক্ষেত্র মহাভারতের যুগ থেকে পেয়ে এসেছি আমরা। আলো-ছায়ার বনভূমিতে আজও চোখের জলে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে, যারা রসের নাগর তারাই টের পায় এই কাঁপন। তবু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তেঁতুলগাছের গোড়াটায় ফোঁপরা ধরেছে বহুদিন। শুধু গাছেরই নয়, অনেক সম্পর্ক এই ফোঁপরা ধরা গাছের মত, বেঁচে আছে কেউ টের পাচ্ছে না। শিলাবৃষ্টিতে বনের টিয়াপাখি মরে গেলে কার না কষ্ট হয়, সেই কষ্টও হজম করে নেয় বস্তির ছেলে-বুড়া। এসবের মধ্যে কুসমা গর্ভবতী হলে সারা পাড়ায় গুঞ্জন ওঠে, কলতলায় জমে ওঠে মহিলা-আসর। গুরুবারি ভাত নিয়ে যায় দৌড়বোগাড়ায়।
সারাদিনের মেহনতের ফল সোনার কুঁচি অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে চিকচিক করে। বেলা পড়লে টাটানগর, মনোহরপুর গোয়েলকেরা থেকে মহাজন আসে। একটা চালের ওজনে মাপ হয় সোনার। জটিল হিসাব, কুঁচ ফল, কালো ফল আরও কত কি! পেতলের নিক্তিতে জীবনের মাপ হয়।
আলো-আঁধারিতে নজরকাড়া কুসুমাকে মনে হয় সোনা খাদান। ভুণ্ডে আকরিক ভরা সোনা খাদানের মত দাঁড়িয়েছিল নিশ্চুপ। কুসমা বিড়বিড় করে বলছিল, মনে কর, আমি তোমার কুসমা নই, শুয়ে থাকা ঐ নদীটা।
সামনে নদী ও নারী। এক পুরুষ। নারী ধারণ করে সোনা। জামুন গাছের ছায়ায় এসে গাঢ় শ্বাস ছাড়ল ভুণ্ডে। এখন পৃথিবী তার হাতের মুঠোয়। নতুন চোখ দিয়ে সে আবিষ্কার করতে চায় অরণ্যছায়ার মাটিকে, নদীকে।