কুড়মালি কবিতা - মঙ্গল মাহাতো

ভাখিক খাতির

নিজাম ঠেকান তুপ-তুপালেক
বিলহালাহি মাইঁ।
কহিকে টুয়েক-দুখেক কহেল্
দেবে টুয়েক সাঁই।
মায়েঁক ভাখি- মনে রাখি, মুহেঁ
হেলেক ঠাঁইন,
দাঁড়াঞ পাহার-খালাহাতাক হামরা
বাঁচাক নি আইন্।
পড়হা চিসা-পুথিপতর
ইবেরা, হেলাহ বতর্,
মাইঁক ভাখি-নিখরান লাগি
সভুলগ হেলাহ সতর।
কুড়মালি ভাখি-চিসা চিসয়
হামরাকেরি দিসা দিসয়।
হামরাক-সকতি-ভাখিক ভগতি
কুড়ুম কলাচার ভাই।
নিখরনকের - কুড়মালি ভাখি
দিললিক জনতার মনতরাই।
নিজাম ঠেকান- তুপ তুপালেক
বেনাহেতাক মাইঁ।
 


ভাষার জন্য
(ভাখিক খাতির)

নিজ চিনহাঁপ হারিয়ে গেল
হারিয়ে গেল মাঁয়
বলছি একটু দুঃখের কথা
দিবে টুকু সায়।
মাতৃভাষা মনে রাখি
মুখে হল ঠাঁই,
দাঁড়িয়ে মার খাচ্ছি মোরা
বাঁচার বিধান নাই ?
লেখা-পড়া বইপত্র
এবার প্রয়োজন
মাতৃভাষার বিকাশ লাগি
সবাই-সচেতন
নিজের শক্তি, ভাষার ভক্তি
কুড়মালি কালচার,
দরবার করো,
মাতৃভাষার,
দিল্লির জনতর মনতরায়।
মায়ের ভাষায় ভাষায় চিনহাঁপ
পাবো মোরা তাই।
(‘কুড়মালি চারিদিশা’ হইতে) 
 


উদমা দাঁমড়া

উদমা দাঁমড়া
ইঁড়কিঁ বলে
নি, ঘাড়ে গহড়া
জনখন্ পাওলা
তনখন্ পাওলা
সিগঁ কাদাক মুড় মহড়া।
ইঠিন উঠিন
চুড়পিঁ রহে
ঠাইন ঠেকান
নি, ঠেহরাই
লকেক টাড়ে
মাঢ় খালেহে
নিজেক গঠে হুঁকরাই।
কুঁড়হা মাঢ়
টুয়েক দেলে
অখরাক গঠে গঠায়
আপন ঘাড়ে
জুঁঅাঁইল্ লেইকে
লগেক কাদা ঘাঁটলায়।
নিজাম ঘারে
ঝরে বারি
লগেক ছাঁছায় গঁজা
হামরাক ঘারে
গহাইল ডেহইর
ভাবুআই ভাভে ভেলকিটা। 


ভবঘুরে
(উদমা দাঁমড়া)

ভবঘুরে
ঘুরে বেড়ায়
সংসারের নাই জ্বালা,
যখন পায়,
তখন খায় —
ভাষণ দেওয়ার পালা।
এদের খাতায়
ওদের খাতায়
নামটি লেখায় আগে,
অন্যের হাঁড়ির 
ভাত খেয়ে
নিজের হাঁড়ি ভাঙ্গে।
খুদ কুঁড়ো
একটু পেয়ে
ওদের দলে ভিড়ে,
নিজের ঘাড়ে
বন্দুক নিয়ে 
লোকের শত্রু মারে।
নিজের চালে
ঝরে বারি
লোকের চালে গঁজা
ঘরের মাঝায়
ঝরন ফুটে
ভাবুক ভাবে মজা।
(‘কুড়মালি চারিদিশা’ সাহিত্য হইতে) 
 


রাড়েক বন ফুঁকরিঁ রেঁগে

ডহর সারে
কহে জইড় বড়ে
মানুস কি আর
নি-রেহয় রাঢ়ে।
গড়াই নি
দেলাহ মাটি
কুড়াহাতা সভে
ঝুড়ি ঝাঁটি।
নি-খাইকে
মরি সুখনাহা
অবেরাই জাহান
জাতা আনখা।
বনমুড়াক অহ
ঠুঁঠা মহুল
দিন রাইত
রেঁগাঅয় কুঁহুর্-কুঁহুর্।
কহতা ভাই
হায়-হায়
নাতি পুতি
কাহেঁ গেলাহ পালাঞ
জনখন রেহলাহ
পালহা হালি
কেতি কেরি
রেহয় কেলি।
ঠুঠাঁক কি আর
আহে রস
ঝড়রহে ফুর
ঠস্ ঠস্ 
ডহর সারে
ঢড়রা কুসুম্
হাঁক মারে তু
অনাই সুন।
রেহলায় ভাদ
রেহলায় বহড়া
উজড় হেলাহ
রকত রহড়া
ধঅ কুড়চি
আটাইড় সিধা
সঞা কুইল্
বেহচি বুদা।
ভুঁড়রু চাটিক
রেঁগাহি মাটি
পটাস গাছে
লেলাহি লুটি।
সাল গাছেক অহ
দুখ্ হেরলাহে
রেঁগাঅয় বুদালাটা,
মুড়াক আড়ে
অবর হেই
বেঁগাহি কয়র ছা-টা।
তিতির বুড়ি
পাঁজাহি ঝুড়ি
খঁধা বেনাহা লাগি
ঝুড়ি পাঁজাকে
বেগড় হেলাহি
আনখাই দেলাহি ডিম পাড়ি।
গাছ বিহনে
রেঁগাঅয় পাঁইড়কা
টেঁসা কুইলি কাঠঠকরা
বন উজাড়ে
চিল সুখনি
হেলাহ মুলুক ছাড়া
বাওঘা সিয়াল
হরিন লেকড়া
পালাঞ গেলাহ
বনেক খেড়হা।
পেটেক জ্বালায়
হাথি ঠাকুর
চাসে বাসে
হেলাহা উজইড়া।
সাল গজড়ি
নেহরে রেঁগে
হাঁক মারে
ভখা-দুখানিখরে
আয় ন ভাই
আপনাক কেরি
লেন তহরা
হিয়া ভিতরি
বঁস বাঁচাতা
পারবিস তহরা
আইজ হামরা
হেলাহি আধমরা।


রাঢ়ের জঙ্গল কাঁদছে জোরে
(রাড়েক বন ফুঁকরিঁ রেঁগে)
রাস্তা ধারে বলে বট অশ্বত্থে
আর কি মানুষ নাই রাঢ়ে ?
গড়ায় নাই দিচ্ছে মাটি
কুড়িয়ে নিচ্ছে ঝুড়ি ঝাঁটি।
না খেয়ে কি শুকিয়ে মরবো
অকালে কি জীবন দিবো !
জঙ্গল মাথায় ঠুেঁটা মহুল
দিন রাত কাঁদে কুঁহুর কুঁহুর।
বলছে — ভাই, হায় হায় !
নাতি-পুঁতি কোথায় গেল যে পালায়।
যখন ছিল পালা-হালি
কত করিলাম কেলি
ঠুঁটায় কি আছে রস
ফুল পড়বে ঠস্ ঠস্।
রাস্তা ধারের অধর কুসুম
ডেকে বলে ‘‘শুন, শুন !’’
ছিল ভাদ, ছিল বহড়া
উজড় হইল রবাত রহড়া
ধঃ, কুড়চি, আটাল, সিধা,
সঁয়াকুল, বেঁহচি বুদা।
ভুঁড়রু চাটির কাঁদছে মাটি
পলাশ গাছে নিচ্ছে লুটি।
শাল গাছের ওই কষ্ট দেখে
কাঁদছে বুদা লাটা,
মুঢ়ার আড়ে এলিয়ে বসে
কাঁদছে কয়র ছা’টা।
তিতির বুড়ি খুঁজছে ঝুড়ি
খঁবা বানাবার লাগি
ঝুড়ির খোঁজে পাগল হল
এমনি দিল ডিম পাড়ি।
গাছ বিহনে ঘুঘু কাঁদে
তিয়া-কোিকল-কাঠঠোকরা
বন উজাড়ে চিল-শকুন
হইল দেশান্তরা।
বাঘ, শেয়াল, হরিণ, নেকড়ে,
পালিয়ে গেল ভালুক খরগোস
পেটের জ্বালায় হাতী ঠাকুর
চাষ-বাসে করে সর্বনাশ।
শাল, গজড়ি নম্র সুরে
ডাকছে জঙ্গল নিবাসীরে,
এসো না ভাই আপন করে
নাওনা তোমায় হিয়া ভিতরে
কুল বাঁচাতে পারবে তোমরা
আজ আমরা হয়েছি আধমরা।
(‘কুড়মালি চারিদিশা’ হইতে) 
 


গরাম ঠাকুর সেঁউরন

গরাম ঠাকুর গরাম ঠাকুর
তর সিকড়ে পূজা
তহর পাত তহর ফর
তহর ফুরেক ধজা।
তহর লাগি আউয়াচাল
তহর গায়েক ধুনা
তহর লেই লাল ঝিঁঝরা
নি, গুনা নি, গুনা।
তহরু লাগি গেইয়াধনি
ধুনাই লাহি হিঁয়া
তহর লাগি দুধা কলা
তহরু লাগি ঘিয়া।
তহর লাগি রাঁগা সিঁদুর
দুবলা হেলা হালি
তহর লাগি হালিবন
পিঢ়িক পিঢ়ি পালি।
তহর হালি-হালি পাত
বাসাত খরা ঝড় আইল্
পিরথিমিটা সিতল কেরয়
তহরু বন জাঁগাল।
তহর লাগি করম-ধরম
তহর লাগি সরম্
তহর লাগি গরব হামর
তহর লাগি জীবন।
তহর লাগি খাম্ হাম্
তহর লাগি দড়হ
তহর লাগি হামরা সভে
ঘড়াক পিঠি চড়হ।
তহর সিরজন এহ হালিবন
তহরে কেরয় সেঁউরন
তহর লাগি জিবন মরন
হামর ভরন পসন।


গরাম ঠাকুর স্মরণ
(গরাম ঠাকুর সেঁউরন)
গরাম ঠাকুর, গরাম ঠাকুর
তোমায় করি পূজা,
তোমার পাতা — তোমার ফল
তোমার ফুলের ধ্বজা।
তোমার জোরে আতপচাল
তোমার গায়ের ধুনা,
তোমার শক্তি পেয়ে জীব
সৃষ্টি অগণনা।
তোমার জন্যে গাভী সবে
বাছুর প্রসবিল,
তোমার জন্যে দুগ্ধ কলা
তোমার জন্য ঘৃত।
তোমার জন্যে রঙগিন সিঁদুর
দুর্বা সবুজ হইল,
তোমার জন্যে সবুজবন
পরমপরায় রহিল।
তোমার এই সবুজবন
ঝড়-বৃষ্টি আনে,
পৃথ্বিকে শীতল করে
তোমারি জঙ্গলে।
তোমার জন্য কর্ম-ধর্ম
বেঁচে থাকার মান,
তোমার জন্য গর্ব মোদের
তোমায় নিয়ে জীবন।
তোমার জন্য খেয়ে দেয়ে
জীবন-যৌবন ধরি,
তোমার জন্য সংসারেতে
আমার আমার করি।
তোমার সৃষ্টি এই সবুজ বন
তোমারে করি স্মরণ
তোমার জন্য জীবন-মরণ
আমার ভরণ পোষণ।
(‘কুড়মালি চারিদিশা’ সাহিত্য হইতে) 
 


গরুক গাড়ি

ভাভরি কাঠিক বেলুন আরা
অহ পুঁঠাই ঘেরল্
পিটনা পিটা ঠুঁকা কুঁদা
গঢ়ইয়া গঢ়ল্ হেরল্।
কামার ভায়া হুলা হাইল্
পিঁধাঅয় মেঢ়ে সেঁকে
সগড় চাকা গরুক গাড়ি
গড়গইড়া গড়কে।
ধ-অক ধুরি সাল কুইমরাহা
টেড়া বাঁসেক টাঁগা
ফাইলা বাতাক বিছনা বিছল
পিঁড়া কাঠিকে সাঁটল উগা।
উপর টাঁগা বেড়ল খুঁটা
পিঁড়া কাঠিকে গুঁথা
ইঁদে-উঁদে জাতাক বেরা
ছঁাদনা ছাঁদন ধাঁচা।
চাকা গতল বেলুন হুলা
ধুরিক মুড়াই উকান খিলা।
ধুরি কুমরাহাই কড়কড়ি টান
ছাঁদনাহেক অহ গাউড়ান।
জুয়া ঘাড়ে জড়া হাইলা
জুঁড়ি দেলাঞ জুইত দড়া
গরুক ঘাড়লে দেলাহ িপঁধাঞ
আঘলি বসিকে পইনা ঝলকায়
হ, বাঁই, ঠাঁই দাহ্ নাই।
টাঠরা ঘেরা গবর গুঁড়া
আড়াস তাড়া আদ্দা বিড়া
বরহি দড়া ভরি সাঁজুড়া
হরেক বজ বজাই
আনল খামহার উজা হেবজাই।
 


গরুর গাড়ি
(গরুক গাড়ি)

বাবলা কাঠের বেলুন আরা
এই কাঠেরই পুঁইঠা,
মুগর দিয়ে পিটে ফুঁড়ে
ছুতোর তৈরী করে।
কামার ভায়া হুলা-হাইল
বাঁখন বেড়া বাঁখে,
সগড় চাকা গরুর গাড়ি
গড়গড় গড়কে।
ধয়েক ধুরি শাল কুইমহিরা
বাঁকা বাঁশের টাঁগা,
বাঁশ পাতার বিছনা বিছা
পিঁঢ়া কাঠে বাঁধা।
সরু বাঁশের উপর টাঁগা
পেছড়িওলা ধরে,
হালকা ভারি করার সময়
এই বাঁশটি লাগে।
পিঁঢ়া কাঠের দুই মাথায়
থাকে ফুটা করা,
বেড়া খুঁটি গুলো সব
হয় যে হোথা পরহা।
এখানে ওখানে যেতে
চাঁচের ধাঁচা বাঁধা,
হেলে দুলে চলে গাড়ি
ঘুমিয়ে থাকে রাজা।
চাকার মাঝে বেলুন থাকে
দুই ধারেতে হুলা,
টাঁগার নীচে ধুরি তাহার
দুই ধারে কানাখিলা।
ধুরি কুইমরাহায় কড়কড়ি টান
শক্ত করি বাঁধে গাড়ুয়ান,
যুয়া ঘাড়ে জোড়া বলদ
জুড়ি দিল কিষান চালক।
সিমলা খিলায় জোত দড়া
গরুর ঘাড়ে লাগা
সামনে বসে লাঠি দেখায়
‘হ’, ‘বাঁই’, ‘ঠাঁই’, ‘ডাহানা’।
টাঠি ঘেরা গোবর গুঁড়া
বরহি দড়া ভরি বাঁধা
অনেক রকম বোঝায় গাড়ি
আনছে চাষি আপন বাড়ি।
(‘কুড়মালি চারিদিশা’ হইতে বাংলায়)