ডেভিড ম্যাকচ্চন ‘বাংলাদেশের মন্দির’ গবেষণার উদ্দেশ্যে সেদেশে বেড়াতে যান। ফিরে এসে সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তাঁর লেখার এক জায়গায় বলেছেন,গত অক্টোবর নভেম্বর মাসে তিন থেকে চার সপ্তাহের জন্যে আমি পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলাম, সেখানে মন্দির, মসজিদ্ এবং প্রাচীন অট্টালিকা দেখার জন্যে। অশ্রান্তভাবে ক্রমাগত ঘুরে বেড়িয়েছি যাত্রার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, কখনো ট্রেনে, কখনো বা বাসে, কখনো ষ্টিমারে, আবার কখনো লঞ্চ বোটে; এবং একসঙ্গে কোথাও চারদিনের বেশি থাকার অবসর আমার হয়নি। মাইলের পর মাইল লম্বা সবুজ ইক্ষু-ক্ষেত অতিক্রম করেছি।... ১
ম্যাকচ্চনের জন্ম ইংল্যান্ডের কভেন্টির এক মধ্যবিত্ত পরিবারে (১৯৩০ সাল)। শিক্ষাজীবন সমাপনান্তে তিনি ১৯৫৭ সালে শিক্ষকতার সূত্রে ভারতে আসেন।২ বাংলার সংস্কৃতির প্রতি অপরিসীম মমত্ববোধ ম্যাকচ্চনকে সর্বদা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পারেনি। ফাঁক পেলেই তিনি তাই গবেষণার কাজে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতেন। যে সময়ে তিনি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন সেই ১৯৬৪ সালে সেদেশ ভ্রমণ ছিলো অনেক বেশি প্রতিকূল, অন্তত আজকের নিরিখে তো বটেই। তবু নিজের সাহসী-আত্মবিশ্বাসী- অনুসন্ধিৎসু মন তাঁকে শত কষ্ট সহ্য করেও মাইলের পর মাইল ঘুরে বেড়ানোর প্রেরণা জুগিয়েছিলো।
যদি বলি এ প্রবন্ধের বিষয় ডেভিড ম্যাকাচ্চন নয়, তাহলেও সমালোচকেরা বলবেন এদেশের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে জোন্স, ক্যানিংহাম, ম্যাক্সমুলার এঁদের অনুসন্ধানের খামতি কোথায়? সুতরাং এঁরা প্রারম্ভিক আলোচনা থেকে বাদ পড়ে কেন? আসলে এ প্রবন্ধের মূল বিষয় পশ্চিমী গবেষকেরা কেমন করে বাংলার লোকসংস্কৃতিকে নিজের করে নিতে গিয়ে কী নিবিড় আত্মমগ্নতায় এর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় সেইসব মানুষদের সম্বন্ধে এখানে দুচার কথা তুলে ধরা। তাই শুরুর আগে যে সলতে পাকানোর কাজ থাকে ডেভিড ম্যাকচ্চনের দৃষ্টান্ত দিয়ে সেটাই করা গেলো।
জেরামি হেন্স। জন্মসূত্রে আমেরিকান। সান্তা বারবরার ‘ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়া’তে পিএইচডি গবেষণারত। ওর গবেষণার বিষয় "Bhava and Affective Embodiment in South Asian Performance।" বাংলা করলে বোধহয় দাঁড়ায় দক্ষিণ এশিয় পারফরম্যান্সে ভাব এবং অনুভূতির সন্নিবেশ। ওর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। দক্ষিণ এশিয়ার এতোরকম পারফরম্যান্সের মধ্যে জেরামি শীতলামঙ্গল পালাগান কেন বেছে নিলো জানি না, শুধু এটুকু বুঝেছিলাম যে বিশ্ববিদ্যালয় নামক কোনো প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা কেন্দ্রের চৌহদ্দি ওর গবেষণা কর্মকে বেঁধে ফেলতে পারে না। কথাটা বোধ হয় জেরামিও ভালো মতো বুঝেছিলো। তাই সে এখানে আসা ইস্তক বিভাগের গণ্ডি পেরিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলবার জন্যে উসখুস করতে লাগলো। ওর একাম্ত আগ্রহ দেখে আমার ইতিপূর্বে সংগৃহীত 'শীতলামঙ্গল পালা'রঅডিও-ভিডিও রেকর্ডটা দেখালাম। দেখে আরো আশান্বিত হলো। এবার ওকে একদিন নিয়ে গেলাম একটি পালাগানের আসরে। আসরটি ছিলো দক্ষিণ ২৪ পরগণার সোনারপুর থানান্তর্গত জগদীশপুর গ্রামের শীতলামন্দির প্রাঙ্গণে। গ্রামপুজো উপলক্ষে এখানকার অধিবাসীরা প্রতিবছর এইরকম পালাগানের আয়োজন করে থাকেন। সন্ধ্যে সাড়ে সাত-আটটা নাগাদ পৌঁছে দেখি তখনো মঞ্চসজ্জার বারো আনা কাজ বাকি। মন্দিরের সামনে একচিলতে ত্রিকোণাকৃতি সমতল জায়গার একদিকে ডাইস ফেলে উপরে বাঁশের ভারার সাথে পলিথিন টাঙিয়ে লাইট মাইক বাঁধাছাঁদার কাজ চলছে। এটাই আজকের ‘শীতলামঙ্গল পালা’র নাট্যমঞ্চ।
জেরামিকে মঞ্চের অবস্থান বুঝিয়ে দিতেই সে ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে পটাপট ছবি তোলা শুরু করে দিলো। তারপর ওকে নিয়ে গেলাম নাটকের কুশীলবদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে। তাঁরা তখন মঞ্চের অদূরে মাটির দেওয়াল আর খড়ের চাউনি দেওয়া সামনের দিকে খোলা একখানি ঘরে বসে 'মেকআপে' ব্যস্ত। জেরামি আগে থেকেই কিছু প্রশ্ন লিখে এনেছিলো। আমি সেগুলি ওদের কাছে কপচালাম বটে কিন্তু তার বাইরেও নানান আলাপ জমাতে হলো। বলা বাহুল্য, প্রয়োজনীয় কথার চেয়ে এই অপ্রয়োজনীয় আলাপেই বেশি তথ্য উঠে এলো। এই ধরুন, অবসর জীবনে কেউ ওঝাবৃত্তি করে দিন কাটান, মায়ের নামে জলপড়া দিয়ে রোগব্যাধি ভালো করে তোলেন, কেউবা বিবিমার থানধোয়া জল দিয়ে প্রসব বেদনার উপশম থেকে শুরু করে নানান অশুভশক্তির বিনাশের পরামর্শ দেন -এসব হাঁড়ির খবর কি আর শুধু পালাগানের আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকলে জানতে পারতাম? আসলে সাধারণ মানুষের ভক্তি আর বিশ্বাসের এই স্তরটিকে ছুঁতে না পারলে আজ শীতলাকে কেন চৌষট্টি রোগের নিয়ন্ত্রিতা বলে মনে করা হয়েছে তা বোধ হয় ব্যাখ্যা করা যাবে না। বহুদিন ধরে তথাকথিত ভদ্রশ্রেণি থেকে বিচ্ছিন্নতা, অভাব-অনটন আর শিক্ষার অপ্রতুলতা, রাস্তাঘাটের অভাবে পরিবহণ ব্যবস্থার অসুবিধা -এসবের কারণে অসহায় মানুষ অনিবার্যভাবে হার মেনেছে গ্রাম দেবদেবীদের কাছে। সারারাত জেগে গোটা পালাগান ক্যামেরাবন্দী করলাম। জেরামি আমার পাশে বসে পালার আদ্যন্ত দেখলো, মাঝে মাঝে ডায়েরিতে নোট নিলো। পালার শুরুর দিকে ভক্ত-দর্শকদের যে ঈর্ষনীয় ভিড় দেখলাম শেষরাতে তা উবে গিয়েছে। শুধু মাঝপথে উঠে গেলে অমঙ্গলের আশঙ্কায় যে দু’চারজন প্রবীণভক্ত সারারাত জেগে বসে ছিলেন তাঁরা যে আমার মতো ঘুম কাতুরে নয় তা তাঁদের চোখ-মুখের সতেজতা দেখে বুঝেছিলাম। সকলে চলে গেলে পালাগানের এই সকল গেঁয়োযোগীরা ঠিক মতো ভিখ (পড়ুন ‘প্যালা’) পাবে না এই আশঙ্কায় পুজো কর্তৃপক্ষেরও কেউ কেউ তখনো বসে ছিলো।
আপন সংস্কৃতির প্রতি মানুষের এই উদাসীনতা দেখে জেরামির কাছে নিজেকে বড়ো অপ্রস্তুত । মনে হলো নিজেদের পাপস্খলনের জন্যে ওকে বোঝালাম, সারাদিনের কর্মক্লান্ত গ্রামবাসীদের এখন আর আগের মতো সারারাত জেগে এইসব বহুল পরিচিত পালাগান দেখে বিনোদন করবার অবসর নেই। বিদেশীদের সবচেয়ে বড়োগুণ ওরা সব বুঝে কিছু না বোঝার ভান করে, আর আমরা কিছু না বুঝে সব বোঝার ভান করি। জেরামির কপাল ভালো বলতে হবে দর্শকের অভাবে দল ম্যানেজার পালার কোনো অংশ ছেঁটে ফেলেনি। তাই কে পাশ থেকে উঠে গেলো, আর কেই বা বসে রইলো, তার দিকে খেয়াল না করে জেরামি মন দিয়ে আস্ত পালাটা দেখবার সুযোগ পেলো। পালা দেখার প্রতি ওর এই নিবিড় আত্মমগ্নতা দেখে মনে হল, ও যেন এইসব অভিনয়ের ব্যাপারে কিছুই জানে না এবং এর আগে যেন এসবের কিছুই দেখেনি, এমনকি ইতিপূর্বে ওকে আমার নিজহাতে দেওয়া পালাগানের সেই অডিও-ভিডিওটাও নয়।
এই প্রসঙ্গে আরেক জনের কথা মনে পড়ছে। তার নাম রওয়েনা (Rowena Potts)। অনধিকারচর্চায় আত্মশ্লাঘা হবে না জেনে সেদিন ওর দেশ, ব্যক্তিপরিচয় সম্পর্কে কিচ্ছু অনুসন্ধান করেনি। শুধু এটুকু শুনেছিলাম রওয়েনা নিজের দেশের এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণায় রত। যদ্দুর মনে পড়ছে ওর গবেষণার বিষয় ছিলো ভারতবর্ষের মাজার। তখন আমি নিজেই তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের পিএইচডি’র গবেষক। বিভাগে সি.এ.এস(ফেজ-টু)’র ফেলো হিসাবে কাজ করবার সুবাদে মূলত দুই চব্বিশ পরগনার মৌখিকসাহিত্য অনুসন্ধানে খাতাকলম আর একখানা ঢাউস ক্যামেরা বগলে ঘুরে বেড়াচ্ছি এদিক থেকে ওদিক। নিজেরই ভুলে সেদিন রওয়েনার দেশের খবর নেওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ওর সাথে দেখা হওয়ার দিনক্ষণটা ঠিক মনে আছে। মনে পড়ে, ২০১৩ সালে শ্রাবণ মাসের ১৭ তারিখের বিকেলবেলা আকাশে কালো কালো ভাসমান পাহাড়প্রমাণ মেঘরাজির নীচ দিয়ে রওয়েনাকে নিয়ে ট্রেনে চেপে হাজির হয়েছি ঘুটিয়ারি শরিফের পিরের মেলায়।
প্লাটফর্মে নেমে অসংখ্য লাল-হলদে সুতোর ডোর আর রকমারি আচার বিক্রি হতে দেখে ও ছবি তোলা শুরু করলো। খেয়ালিপনার সুযোগ নিয়ে কেউকেউ একপ্রকার জোর করে নিজেদের পসরা ওর হাতে তুলে দিলো মোটা বকশিশের আশায়। শেষে তা না পেয়ে দু’একজন টিটকিরি মারতেও ছাড়লো না। রওয়েনা তখন একটু-আধটু বাংলা শিখেছিলো। সুতরাং বাঙালির বটকেরা বুঝতে ওর বাকি রইলো না। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখলাম ও সব কিছু কেমন স্মিতমুখে গ্রহণ করে সকলের মন জয় করবার চেষ্টা করছে!
মূল মাজারের ডান দিকে মোবারক গাজির আত্মীয়স্বজনদের কবরস্থান। তারই একটার সেবাইতের কাজ করেন স্থানীয় নুর মহম্মদ দেওয়ান। ৬৫-৭০ বছর বয়স, ফকিরদের মতো লম্বা দাড়ি-গোঁফ বিভূষিত, ফরসা ছিপছিপে গড়ন, পরনে হলদে থানকাপড়। চোখে বাদামি ফ্রেমের চশমা। ইংরেজি না জানলেও দীর্ঘদিন মাজারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকার সুবাদে ভারতবর্ষের সব এলাকার দর্শনার্থীকে বোঝাতে হয় বলে বৃদ্ধ হিন্দিটা ভালোমতো শিখেছেন। রওয়েনাকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতেই তিনি সব শুনে সেই রাজভাষাতেই গড়গড় করে বলে যেতে লাগলেন মাজারের পুরাকাহিনি। রাজা মদন রায়চৌধুরী থেকে শুরু করে বর্ধমানের জনৈক চিনি কলের -মালিক জয়নাল আবেদিন মিঞা— কেউ-ই বাদ পড়লো না তাঁর সেই গল্প থেকে। কিছু না জিজ্ঞাসা করলেও এসব তিনি নিজেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনর্গল আওড়ে গেলেন। বুঝলাম নানান লোকের প্রশ্নগুলোর উত্তর তিনি যেন একসাথে সাজিয়ে একটা লম্বা বক্তৃতার আকারে ভোকালকর্ডের কাছটাতে রেকর্ড করে রেখেছেন, সমঝদার শ্রোতা পেলেই তা বাজিয়ে দেন। ভদ্রলোকের কাছে গল্প শুনে মাজারের পাশের মক্কাপুকুরের কাছে যেতেই দেখা গেলো অনেকে গোলাকৃতি পুকুরটাতে গোলাপ ভাসিয়ে জলের মধ্যে হাত পেতে বসে আছে সেই আশীর্বাদি ফুল ফিরে আসার অপেক্ষায়। রওয়েনাকে পুকুরের একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ তার জল নিরীক্ষণ করতে দেখে মনে হল, ও যেন পুরাতত্ত্বের সন্ধানে নেমেছে। বোধ হয় সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, বারুইপুরের রাজা মদন রায়চৌধুরী আজ এই উরসের দিন সশরীরে এসে ধুতি পরে নিজহাতে পুকুরের মজে যাওয়া মাটি সরাচ্ছেন।
জেরামি এবং রওয়েনাকে প্রচারের আলোকে আনতে গিয়ে এতোক্ষণ যা বলা হলো তা থেকে এই সত্য উঠে আসে যে, বাংলার সংস্কৃতির প্রতি বিশ্ববাসীর প্রাণের টান চিরন্তন এবং বোধ করি আমাদেরও নিজেদের জানবার জন্যে সেই টান খুঁজে ফেরার সময় এসেছে। সংস্কৃতির সর্বজনীনতার বিষয়টি মাথায় রেখেও বলতে হয় যে আমাদের সংস্কৃতি কেবল মিলনের আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ নয়, মেলাবার আকাঙ্ক্ষাতেও।
সৌজন্যে-
১। ডেভিড ম্যাকাচ্চন। ‘পূর্ব পাকিস্তানের অন্তরে।’ কয়েকটি প্রবন্ধ। (কলকাতা: বিশ্বকোষ পরিষদ, ২০০২), ৩০।
২। একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণ : আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-১৫)।
http://www.muktochintablog.com/blogpost/details/6250 access on 27.08.19। এবং
৩) Jeremy Hanes. Rowena Potts, নুর মহম্মদ দেওয়ান ও 'কাত্যায়নী অপেরা'র জগৎ জননী দেবী শীতলা পালাগানের কলাকুশলীবৃন্দ।