বীরেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্যের জনজাতিচর্চা :   একটি পর্যালোচনা  অনির্বাণ সাহু

ভারতবর্ষে বিচিত্র জনজাতি বা জনগোষ্ঠীর বাস। এইসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা দেশের আদি অধিবাসী (Aborigines) তাদেরকে 'আদিবাসী' (Tribe) বলা হয়ে থাকে। 'আদিবাসী' শব্দটি ইংরেজি Tribe শব্দের বাংলা অনুবাদ।  ল্যাটিন Tribas শব্দ জাত ইংরেজি Tribe শব্দটি একই বংশধারার ধারাবাহিকতা নিয়ে বসবাসকারী একটি গোষ্ঠীকে বোঝায়। আমরা জানি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৫০-এ ভারতীয় সংবিধান তৈরি হয়। ভারতীয় সংবিধান-এ তাদেরকে 'তপশিলী উপজাতি' (Scheduled Tribes') বলে অভিহিত করা হয়েছে। এইসব আধিবাসীদের অধিকাংশই প্রোটো অস্ট্রেলীয় গোষ্ঠীর (Proto-Austroloid) মানুষ। অবশ্য  নিগ্রোবটু বা মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর আদিবাসী মানুষও রয়েছে। আদিবাসীরা মূলতঃ ঝাড়খন্ড, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ওডিসা, মধ্য-প্রদেশ,ছত্রিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মনিপুর, মেঘালয়, সিকিম, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যে বসবাস করলেও ভারতের প্রায় সমস্ত রাজ্যে তারা ছড়িয়ে রয়েছে। আজও বহু আদিবাসী গোষ্ঠী পাহাড়, পর্বত, টিলা, অরণ্যে বসবাস করে এবং আদিম জীবন যাপন করে। তাদের জীবিকা হল পশু-পাখি শিকার এবং বনের ফল, মূল, শাক, পাতা আহরণ।  এদের মধ্যে যারা কিছুটা উন্নত তারা জুম প্রথায় চাষ করে বিভিন্ন ফসল ফলায়। আর বাড়িতে গরু, মোষ, শুয়োর, কুকুর, হাঁস,মুরগি ইত্যাদি পালন করে। 
ভারতবর্ষে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস। আদিবাসী জনসংখ্যার নিরিখে সারা পৃথিবীতে আফ্রিকার পরেই ভারতের স্থান ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী প্রায় ৩৫০ টির মতো আদিবাসী জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষে বসবাস করে। তাই সঙ্গতভাবেই ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তাই ভারতবর্ষের প্রাচীনতম সাহিত্য রামায়ণ এবং মহাভারতেও আদিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পরিচয় পাই। 'রামায়ণ' মহাকাব্যের রচনাকার মহাকবি বাল্মীকির মুখ থেকে '' মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ। যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।'' ইত্যাদি যে প্রথম শ্লোকটি উচ্চারিত হয়েছিল তা তো একজন 'নিষাদ' অর্থাৎ ব্যাধের ক্রৌঞ্চ বধের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই।  তাছাড়া মতঙ্গমুনির আশ্রমে শ্রীরামচন্দ্রের জন্য প্রতীক্ষারত শবরীর কথা কিংবা রামচন্দ্রের মিত্রগুহক চণ্ডালের কথা বাল্মীকি উপস্থাপিত করে আদিবাসীদের সঙ্গে রাজা-মহারাজা তথা উচ্চবর্গের মানুষদের সুসম্পর্কের দিকটি তুলে ধরেছেন। মহাভারতের মহাকবি বেদব্যাস ব্যাধ একলব্যের বীরত্বের তথা তার সততা ও গুরুর প্রতি একান্ত ভক্তির দিকটি তুলে ধরে তার মহৎ হৃদয় তথা আত্মত্যাগের দিকটি তুলে ধরেছেন। এছাড়া লাক্ষাগৃহে ছ'জন আদিবাসীর দগ্ধ হওয়ার মর্মস্পর্শী ঘটনাটিও বেদব্যাস বিবৃত করেছেন। বাংলা সাহিত্যেও চর্যাপদের যুগ থেকে শবর, ডোম, চন্ডাল, ব্যাধ ইত্যাদির যে কথা রয়েছে তা বিস্তৃত হয়েছে 'চণ্ডীমঙ্গল' ও 'ধর্মমঙ্গল' -এর কাহিনীতে। বাংলা কথাসাহিত্যের বঙ্কিমযুগে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পালামৌ' -তে আদিবাসী জনজীবনের ছবি ধরা পড়ে। 'পালামৌ' ভ্রমণ কাহিনী হলেও গল্প বলার ঢঙে আরণ্যক মানুষদের প্রতি আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রাজকাহিনী'-তে ভীল উপজাতি গোষ্ঠীর সমাজজীবন খুঁজে পাওয়া যায়। আদিবাসীদের প্রসঙ্গ উনিশ শতকে ক্ষীণভাবে ধরা দিয়েছিল স্বর্ণকুমারী দেবীর 'মিবাররাজ' (১৮৮৭) ও  'বিদ্রোহ' (১৮৯০)-তে। আদিবাসী জীবনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর কয়লাকুঠি বিষয়ক  গল্পগুলিতে। ১৯৩৯ সালে রচিত বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক'-এ  শেষ পর্যন্ত মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় দুই ভারতবর্ষের কাহিনী। একদল মানুষ, কথক তাদের প্রতিনিধি, গড়ে তুলতে চাইছে এক 'ভারতবর্ষ', আর একদল মানুষ সেই 'ভারতবর্ষ'-এর আধিবাসী তারা, তারা জানেনা কোথায় সেই ভারতবর্ষ। আদিবাসী নেত্রী, পল্লীবালা, আরণ্যক আধিবাসী প্রভৃতি মানুষেরা বিভূতি রচনায় ধরা দিয়েছে । আদিবাসী সমাজ ও জীবন উঠে আসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কালিন্দী' (১৯৪০) -তে। চিনিকলের মালিক বিমলবাবু তাঁর যন্ত্রদানবের মাধ্যমে কালিন্দীচরের আধিবাসী সাঁওতালদের আদিম জীবনযাত্রাকে বিনষ্ট করেছে। মৈনাকের (শৈলেন বন্দ্যোপাধ্যায়) 'সুবর্ণরেখার তীরে' উপন্যাসে ধলভূম মানভূমের বঞ্চিত নিপীড়িত মৃত্তিকাচারী মানুষের অন্তরঙ্গ চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রফুল্ল রায়ের 'পূর্বপার্বতী' (১৯৫৬) উপন্যাসে নাগা উপজাতিদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও রীতিনীতি সংস্কৃতির দিকটি যথাযথ ভাবে লক্ষণীয়। নাগাদের আদিম মানব প্রকৃতির উগ্রতা, শত্রুর প্রতি নিষ্ঠুরতা, মুন্ড শিকারের বীরত্ব সর্দার প্রথা, রিরংসা জীবন ও জীবিকা পালা-পার্বণ উৎসব, বিবাহ অনুষ্ঠান ইত্যাদি সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। মহাশ্বেতা দেবীর রচনাবলীর একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে বিশ শতকের আদিবাসী জীবন ও মহা সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি লিখেছেন, ' আমরা ও তারা একই ভূখণ্ডে বাস করি, কিন্তু তাদের ধ্যান-ধারণার জগৎ একেবারেই পৃথক। ' বিরসা মুন্ডার জীবন ও বিদ্রোহ অবলম্বনে রচিত 'অরণ্যের অধিকার' (১৯৭৭) -এ বীরসা হয়ে উঠেছেন এক অনিঃশেষ বিপ্লবের নায়ক, অারণ্য মানবের অধিকারের জীবন্ত কণ্ঠস্বর। 'চোট্টি মুন্ডা এবং তার তির' (১৯৮০) -এ চোট্টি মুন্ডা বীরসার মতো কোনো 'উলগুলান'-এর নায়ক নয়। অথচ মুন্ডা জীবনের যা কিছু ভালো, তার সব কৃতিত্বই তার ওপর বর্তায়। তাঁর 'ভেঙ্কটাসণী ও নারীয়েঁা' গল্পে এক আদিবাসী সম্প্রদায় অর্থাৎ ডোমবারির বড় মেয়ের নির্যাতিত হবার ছবি দেখতে পাই। 'দৌলতি' গল্পে যে প্রথাটির কথা বলা হয়েছে, তার নাম 'কামিয়ৌতি' বা 'বন্ডেড লেবার'। এ গল্পের পটভূমি পালামৌ । দৌলতি নামের একটি হরিজন মেয়ের যন্ত্রণাময় কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এই গল্পে। 'বায়েন' গল্পে  একটি ডোম (গঙ্গাপুত্র) মেয়ের করুণ কাহিনী পাই। তার নাম চন্ডী। ঘটনাচক্রে তাকে বাঁয়েন অর্থাৎ ডাইনি অপবাদ কুড়োতে হয়। আসলে মহাশ্বেতা আমাদের কখনো নিয়ে গেছেন প্রাগৈতিহাসিক যুগে, আবার কখনো বা নিয়ে গেছেন মধ্যযুগে, আবার কখনো নিয়ে এসেছেন আধুনিক যুগে। কখনো উচ্চবিত্তের সংসারে, কখনো নিম্নবিত্তের সংসারে। পরিচিত করিয়েছেন নানা অঞ্চলের নানা রকম প্রথার সাথে। আবার গরিব বলেই, নিম্নবর্গ বলেই, কুবেরের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই কোথাও। ময়নাদ্বীপ যে কোন নিশ্চিন্ত আশ্রয় নয় এবং ইচ্ছাপূরণের কল্পলোক নয় — আপন  জীবনী শক্তির ঘ্রাণে তা বুঝে নিতে পেরেছিল কুবের, যা দেখানো হয়েছে মানিকের 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাসে। সতীনাথ ভাদুড়ীর 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' (১৯৫১)-এ ঢোঁড়াই কে ভারতবর্ষের বৃহত্তর রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে সংযুক্ত করে নিম্নবর্গকে রাজনৈতিক অধিকার দিতে উন্মুখ হয়ে উঠেছিলেন। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের প্রেক্ষিতে রচিত 'শতকিয়া' (১৯৫৮) উপন্যাসে সুবোধ ঘোষ গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে আদিবাসী কৃষক জীবনকে তুলে ধরেছেন। 'অরণ্যের দিনরাত্রি' (১৯৬৮) উপন্যাসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাঁওতালি নারীর দৃশ্যচিত্র নানা প্রসঙ্গে উত্থাপন করেছেন। কিছু কিছু দৃশ্যে লেখক তার মনোভাবও ব্যক্ত করেছেন। যুবকদের দেখে সাঁওতালি মেয়েদের হাসি থামানোর সূত্রে লেখক তাদের সম্পর্কে তাঁর অভিমত প্রকাশ করেছেন '' সাঁওতাল মেয়েদের বয়স ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু ১৫ থেকে ৩৫ এর মধ্যে বয়স সবার নিশ্চিত। নীলপাড় শাড়ি পরা মেয়েটির বয়সই কম সবচেয়ে। অন্য মেয়েরা চোখ ফিরিয়ে আছে। '' এই অঞ্চলের সাঁওতালি মেয়েদের প্রসঙ্গে ঔপন্যাসিক অনেক দৃশ্যচিত্র ও মনোভাবনা তুলে ধরেছেন। বুদ্ধদেব গুহর ' শালডুংরি ' উপন্যাসে ছোটনাগপুর অঞ্চলের সাঁওতাল, মুন্ডাদের জীবন ধারা চিত্রিত হয়েছে। তাঁর 'কোয়েলের কাছে'(১৯৭০) উপন্যাসে পালামৌর চেরো, খেরওয়াড়, ওঁরাওদের প্রসঙ্গ আছে। আবার 'কোজাগর' উপন্যাসে ঝাড়খণ্ডের রোমাঞ্চকর অরণ্যভূমি তিতলী, কাড়োয়া, নানকুয়া, টুমিয়া প্রভৃতি জনজাতি্র পরিচয় পাওয়া যায়। আব্দুল জব্বারের 'মাতালের হাট' উপন্যাসে রবি হাঁসদা ঝাড়খন্ডের রাচি কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেছে। যে একজন প্রতিবাদী চরিত্র। তার চেতনায় জেগে ওঠে নতুন মানুষ , নতুন জীবন, তাদের গ্রামে গ্রামে প্রাইমারি স্কুল,দু'মাইল ছাড়া হাই স্কুল, চারমাইলের মধ্যে কলেজ, তাদের বিস্তীর্ণ আদিবাসী এলাকায় দু'তিনটে স্কুল। উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে সে। রবি হাঁসদা  শোষিত, বঞ্চিত আদিবাসী সমাজের প্রতিভূ। ধলভূম, মানভূম ও রাঁচির পটভূমিতে রচিত 'অরণ্যপুরুষ',  'রুক্মিণী বিবি' ও 'ধলঝুরি পাহাড়ে পায়রা বাসায়' হো, মুন্ডা, সাঁওতাল, ভূমিজ, কাহার, কুর্মি  সম্প্রদায়ের প্রেম, সুখ-দুঃখের বর্ণালী, সংগ্রামী আত্মার কথা সুধীরকুমার করণ অন্তরঙ্গভাবে তুলে ধরেছেন।
এছাড়াও রমাপদ চৌধুরী, নারায়ণ সান্যাল, সমরেশ বসু, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শক্তিপদ রাজগুরু, সমরেশ মজুমদার, গুণময় মান্না, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সৈকত রক্ষিত, ভগীরথ মিশ্র, নলিনী বেরা, রামকুমার মুখোপাধ্যায় এর মত কথা সাহিত্যিকগণ তাঁদের কথাসাহিত্যে আদিবাসী সাহিত্যচর্চার বৃত্তটিকে প্রসারিত করেছেন। ভারতীয় সভ্যতা-সমাজ-সংস্কৃতির ধারায় চির উপেক্ষিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অবস্থান ও মূলগত সমস্যা এবং নিপুণ ক্ষেত্রসমীক্ষার মধ্য দিয়ে তাদের জীবনের নানা অজানা তথ্যের উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন। শুধু তাই নয় , উত্তরকালে ভারতবর্ষে আদিবাসীদের বিপন্ন অস্তিত্ব সম্পর্কে নির্ভুল অনুমান করার একটা তাগিদও অনুভব করেছেন তাঁরা। আমরা আমাদের আলোচনায় ভারতের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত নাগাল্যান্ড রাজ্যে বসবাসকারী নাগা আদিবাসীদের জীবন সংগ্রাম ও সংস্কৃতি বিষয়ে রচিত বীরেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্যের 'ইয়ারুইঙ্গম' উপন্যাসটি পর্যালোচনা করে নাগাদের জীবন ধারার মূল বৈশিষ্ট্য গুলি তুলে ধরার চেষ্টা করবো। উপন্যাস মূলতঃ জীবনেরই কথা বলে। উপন্যাসের মাধ্যমে যেমন আমরা সমাজের নানান দিকের সঙ্গে পরিচিত হই তেমনই আবার কখনো না কখনো কথাসাহিত্যের রস গ্রহণ করতে গিয়ে আমরা চরিত্রগুলির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করি। যেকোনো ধরনেরই উপন্যাসে সমাজের পাশাপাশি চরিত্রগুলির ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। কাজেই নাগা সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবন নিয়ে রচিত এই উপন্যাসে নাগা চরিত্রগুলির ভূমিকাও অনস্বীকার্য। বলাবাহুল্য যে, কালের ব্যবধানে ভারতবর্ষের অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতো নাগাদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে।
ভারতীয় সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট লেখক বীরেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য্য (১৯২৪ - ১৯৯৭)। তাঁর অসমীয়া ভাষায় লেখা একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস 'ইয়ারুইঙ্গম' (স্বাধিকার বা স্বায়ত্বশাসন)।  এই উপন্যাসটি ১৯৬০ সালে রচিত। নাগা ভূমিপুত্রদের জীবন ও সংস্কৃতি অবলম্বনে লেখা এই উপন্যাসে ভারতবর্ষের এক উত্তাল সময়ে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায় (আনুমানিক ১৯৪০) থেকে গান্ধীজীর মৃত্যুর (৩০ শে জানুয়ারি, ১৯৪৮) কাল অবধি নাগাল্যান্ডে বিশ্বযুদ্ধের ফলে যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাদের নিজেদের মধ্যে যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছিল তা এখানে দেখানো হয়েছে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা, আজাদহিন্দ ফৌজ ও জাপানি সৈন্যদের সঙ্গে ব্রিটিশ বাহিনীর সংঘর্ষ এবং নাগাল্যান্ড-মণিপুর পুনরাধিকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি (১৪ই আগস্ট ১৯৪৫) কলকাতার ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা, ভারতের স্বাধীনতা লাভ এবং মহাত্মা গান্ধীর হত্যার ঘটনাগুলি 'ইয়ারুইঙ্গম'-এ বর্ণিত হয়েছে। উপন্যাসটির মূল কাহিনী নির্মিত হয়েছে শিক্ষিত নাগা যুবক বিশাঙ, অপূর্ব রূপসী যুবতী শারেংলা, খুটিংলা, নাজেক, ফানিটফাঙ, ভিডেশেলীকে ্কেন্দ্র করে। বিশাঙ, খুটিংলা ও ফানিটফাঙ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল এই শর্তে যে তারা নাগাভূমি পুনরায় দখল করতে পারলে তাদের গ্রামে স্কুল, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল ইত্যাদি তৈরি করতে সাহায্য করবে। ইংরেজরা ভারত ছেড়ে চলে গেলে বিশাঙরা স্বাধীন ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছে অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য। কিন্তু বাধ সেধেছে ভিডেশেলী যে আজাদহিন্দ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। তাই তার আদর্শ ছিল নেতাজি। সে নাগাল্যান্ডের স্বতন্ত্র স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিল। ফলে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং বিশাঙদের জয় হয়। এদিকে যুদ্ধের বীভৎসতা বিশাঙ ও শারেংলার গভীর প্রেম সম্পর্ককে বিপর্যস্ত করে দেয়। একজন  জাপানি সৈনিক ইসেবরা তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে সহবাস করতে বাধ্য করে ।  ইংরেজরা জাপানিদের হটিয়ে দিলে পালাবার সময় ইসেবরা নিহত হয়। আর তার ফলে শারেংলা সমাজচ্যুত হয়ে পড়ে। বিশাঙ তাকে মানব সেবার জন্য হাসপাতালে নার্সের কাজে যোগদানের ব্যবস্থা করে দেয়। খুটিংলা বিশাঙকে ভালোবাসতো এবং শেষ পর্যন্ত খুটিংলার সঙ্গেই বিশাঙের বিবাহ হয় এবং তাদের একটি সন্তানেরও জন্ম হয়। এই উপন্যাসে খ্রিস্টান ও অখ্রিস্টানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ, প্রাচীনপন্থী নাগাদের — নাজেক, ভিডেশলীর সঙ্গে নব্যপন্থী  নাগাদের বিশাঙ, খাটিং প্রভৃতিদের দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে এই উপজাতিদের প্রাচীন রীতি-নীতি লোকবিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা এবং নতুন চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী নাগাল্যান্ডকে গড়ে তোলার চেষ্টার পরিচয় পাওয়া য়ায় — যাকে যুগ সন্ধিক্ষণের বৈশিষ্ট্য বলা যায়।
নাগাল্যান্ডে বসবাসকারী এই আদিমজাতি মূলতঃ ভারতের অন্যান্য আদিবাসীদের তুলনায় বীরত্বে ও দুধর্ষতায় বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তারা মূলতঃ তিব্বতী-চীনীয় বা তিব্বতী বর্মী গোষ্ঠীর।  ভারতীয় জনজাতি সৃষ্টির পক্ষে তিব্বতী চীনীয়দের অবদান কম নয়। কিন্তু বহুদিন পর্যন্ত সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে তাদের চিহ্নিত করতে পারা যায় নি। বহুকাল আগে দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে তারা নাগা পাহাড়ে চলে আসে। এককালে তারা ছিল 'নরমুন্ড শিকারী' আর যারা শত্রুপক্ষের মুন্ডু কেটে আনতো তারা তাদের সমাজে বীর বলে পরিগণিত হত। নাগা আদিবাসীরা অত্যন্ত স্বাধীনতা প্রিয় ছিল। তারা দুর্গম পাহাড় ও অরণ্যে বসবাস করত। তাই তাদের সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হত প্রকৃতির দ্বারা। তাদের বাড়িঘর অরণ্যের গাছপালা-বাঁশ দিয়ে তৈরি হতো। তাদের জীবন ধারণের মূল উপাদান ছিল বনের ফল, মূল, শাক, পাতা এবং পশুপাখি। নাগা উপজাতিরা প্রায় সকল প্রকার বন্য প্রাণীর মাংস খেতে অভ্যস্ত। বিশেষ করে হরিণ, মহিষ, চিতাবাঘ, কুকুর, পাখি ইত্যাদি মাংস তাদের খাদ্য তালিকায় থাকত। তাছাড়া জুম চাষ করে ধান, জোয়ার, বাজরা, যব, অালু, আদা প্রভৃতি ফসল ফলাতো। মদ ছিল নাগাদের সবচেয়ে প্রিয় পানীয়। তবে নাগাদের খাদ্যতালিকাতেও যে ক্রমশঃ পরিবর্তন ঘটছিল, ছোঁয়া লাগছিল  সমতলের মানুষদের এবং খ্রিস্টান পাদ্রী ও ইংরেজ সৈনিকদের তার পরিচয় রয়েছে 'ইয়ারুইঙ্গম'-এ। 
 ভারতের অন্যান্য জনজাতির মতো নাগা খন্ডজাতিদের পরিধানও ছিল খুবই স্বল্প। তবে উৎসব-অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষ খুব জমকালো পোশাক পরে। লাল ও কালো তাদের প্রিয় রঙ। 'ইয়ারুইঙ্গম'-এ নাগাদের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত থাকায় এবং কটিদেশে ছোট্ট কাপড়ের টুকরো জড়ানোর কথা বলা হয়েছে। গলায় মুন্ডমালা আর কানে পেতলের আঙটি পরার কথা রয়েছে। তবে বিশাঙ, খাটিং, ফানিটফাঙের মতো শহুরে হাওয়া খাওয়া যুবকদের শার্ট, প্যান্ট গায়ে চাদরের বদলে কোট, গ্রেট কোট, লং প্যান্ট পরার কথা রয়েছে। এই উপন্যাসে দেখা যায় মেয়েদের সাজপোশাকে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। মেয়েদের ঊধ্বাঙ্গ অনাবৃত নয়, তারা ব্রহ্মাবরণ পরে এবং কটিবস্ত্র পরে। তারা বেশিরভাগ লাল-সাদা কাপড় পরে। কানে দুল, গলায় লাল নীল পাথরের মালা পরে। আধুনিক মেয়েরা বক্ষাবরণীর বদলে ব্লাউজ বা জামা এবং নিচে স্কার্টের মতো রঙিন কাপড় পরে। যেমন শারেংলা ' গায়ে পাতলা একটা জামা আর কটিদেশে রঙিন একটা কাপড় পরেছে।
' ইয়ারুইঙ্গম '-এ নাগাদের বিভিন্ন লোক উৎসব এর কথা বলা হয়েছে। অন্যান্য উপজাতিদের মতো নাগারাও নৃত্য-গীত প্রিয়। বিভিন্ন উৎসবে তাদের রঙিন জমকালো সাজ-সজ্জার বাহার, নৃত্য-গীত, মদ্যপান, উদ্দাম উল্লাস চোখে পড়ার মতো। গ্রামের নারী পুরুষ সকলেই সব অনুষ্ঠানে যোগদান করে। 'মংলাথা উৎসব', 'নবান্ন উৎসব' ও 'বড়দিনের উৎসব'-এর উল্লেখ রয়েছে এই উপন্যাসে। গ্রামে আগামীকাল থেকে নবান্ন উৎসব শুরু হবে। ঘরে ঘরে মাংসের ব্যবস্থা করা হয়েছে, ভোজ হবে। মল্লযুদ্ধ হবে। দড়ি টানাটানি খেলা হবে। 'ইয়ারুইঙ্গম'-এ বড়দিনের উৎসবের উল্লেখ থাকায় বোঝা যায় খ্রিস্টান মিশনারীরা পাহাড়ি গ্রামে গিয়ে আদিবাসী নাগাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার কাজে অনেকখানি সফল হয়েছে। আর তাই খ্রিস্টান নাগা তাদের গ্রামে বড়দিনের মিলন উৎসব করেছে চার্চে গিয়ে। তবে গ্রামের খ্রিস্টান ও অ-খ্রিস্টান নাগাদের মধ্যে চার্চ তৈরি করে বিবাদ ও সংঘর্ষের বিবরণও রয়েছে এখানে । এর থেকে বোঝা যায় যে একটি যুগ-সন্ধিকালের অবস্থার কথা 'ইয়ারুইঙ্গম'-এ উপস্থাপিত হয়েছে। নাগাদের রীতি অনুযায়ী পাত্র পক্ষের লোকেরা বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে মেয়ের বাড়িতে যায় কন্যাপণ বা 'বউপণ' — মেয়ের বাবার জন্য ঐতিহ্য পূর্ণ বর্শা আর মেয়ের জন্য নানা ধরনের অলংকার নিয়ে। এই উপন্যাসে বিশাঙ ও খুটিংলার বিবাহের যে বিবরণ পাওয়া যায় তা কিন্তু নাগাদের প্রাচীন বিবাহ রীতি অনুযায়ী হয়নি, খ্রিস্টানদের রীতি অনুযায়ী হয়েছে।
নাগা আদিমজাতিরা ভূত, প্রেত, আত্মা, জন্মান্তর, স্বর্গ, ডাইনি, বনদেবী, রিখুস (প্রেতাত্মা), আনিজা (অপদেবতা), ওঝা, মন্ত্র-তন্ত্র প্রভৃতিতে বিশ্বাস করে। এছাড়া সূর্যদেবতা, বশীকরণ বিদ্যা, স্বপ্ন-ফল ইত্যাদিতেও তাদের গভীর বিশ্বাস। নাগারা বীর, কোনকিছুতেই  তারা ভয় পায় না। শুধু ভয় পায় 'আনিজা' (অপদেবতা) কে। তাদের বিশ্বাস নাগাদের জীবনাচরণের রীতিনীতি কোন ভাবে পালন করলে আনিজার কোপে তার মৃত্যু অবধারিত।
এখানেও দেখা যায় প্রাচীনপন্থী সকলের সম্মানীয় নাগা নাজেকের বিশ্বাস তাঁর মৃত্যু হলে কামিও পূজার ভোজ পর্যন্ত তাঁর আত্মা গ্রামেই থাকবে সবার সঙ্গে। তাছাড়া নাগারা মনে করে যে, মৃত্যুর পর তৃতীয় দিনে মৃতের আত্মা কাকের কাছ থেকে 'কাথি কামাম' ঘুরে আসে এবং 'কাথি কামামের' ভোজের দিন পর্যন্ত গ্রামের মধ্যেই থাকে। ভূত-প্রেতেও তাদের গভীর বিশ্বাস এর পরিচয় দিয়েছেন বীরেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য্য। নাজেকের কবরের উপর বহু পায়ের ছাপ । অবশ্য শিক্ষার ক্রমপ্রসারের ফলে তাদের কারও কারও মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করেছে। আধুনিক পন্থী ফার্মিটফাঙ ভিডেশেলীর কথা বিশ্বাস করেনি। নাগারা স্বর্গলোকেও বিশ্বাসী। নিষ্ঠাভরে  'কামিও'র পূজা করে, তাহলে মৃত ব্যক্তির আত্মা স্বর্গলোকে গিয়ে দেবতাদের সঙ্গলাভ করে। নাজেকও মৃত্যুর পূর্বে সে কথা ভেবেছেন। নাগারা সূর্য ও চন্দ্রকে দেবতা বলে মনে করে। সূর্য দেবতার ওপর তাদের জীবনে যে সবকিছু নির্ভর করে সে কথা তারা একান্ত ভাবে বিশ্বাস করে। আদিম যুগের মানুষেরা যেমন, বৈদিক যুগের ঋষিরাও তেমনি, সূর্যকে দেবতা বলে স্তবস্তুতি করেছেন। ঋকবেদের সাবিত্রী সূক্তে সূর্য-বম্দনার পরিচয় রয়েছে। নাগা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সূর্যকে নিয়ে বহু লোক কাহিনিও রয়েছে। তারা বিশ্বাস করে সূর্যদেবতাকে অপমান করলে বা তাঁকে নিয়ে কোনরূপ সন্দেহ প্রকাশ করলে আমিজা ক্রুদ্ধ হয়। আর তার ফলে সূর্য অার ওঠে না।
নাগা আদিবাসী মানুষদের দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ, তাদের সংগ্রাম, ব্যক্তি জীবনের স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ, কুসংস্কার, নতুন চিন্তা-চেতনা ইত্যাদি ইত্যাদি দিকগুলি সাহিত্যিক বীরেন্দ্রকুমারের লেখায় ধরা পড়েছে। প্রকৃতি সংলগ্ন এই জনজাতিরা প্রকৃতিকে কেন্দ্র করেই তাদের সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। গভীরভাবে গোষ্ঠীবদ্ধ ও সমাজবদ্ধ জীবন যাপনে অভ্যস্ত এই আদিবাসী সম্প্রদায়।  এরা প্রয়োজনে গোষ্ঠী সচেতনতার পরিচয় দেয়, গোষ্ঠী মনোবৃত্তি নিয়ে যুদ্ধ বিগ্রহ বা সংগ্রামে লিপ্ত হয়। যদিও সমতলের তথাকথিত সভ্য মানুষেরা আদিবাসীদেরকে অসভ্য, বর্বর, আদিম বলে মনে করে। ইংরেজরা এদেরকে Tribe বা Uncivilized তকমা দিয়েছিল। সারা পৃথিবীর উচ্চবর্গের মানুষদের এই জনজাতিদের সম্বন্ধে এরূপ মনোভাব। আমরা জানি, জাতীয় উন্নয়নের জন্য কাউকে-না-কাউকে যেহেতু মূল্য দিতে হয়, তাই বলিপ্রদত্ত হতে হচ্ছে কখনো সাধারণ কৃষক, কখনো দলিত, কখনো আদিবাসী, কখনো বা সর্বধারক নিম্নবর্গ। কখনো ধর্মের অত্যাচারে, কখনো বর্ণের অত্যাচারে, কখনো বা পুঁজির অত্যাচারে। তাইতো আমরা অরুন্ধতী রায়ের মতো কাউকে কাউকে চিৎকার করে বলে উঠতে দেখি 'কোথায় সেই ভুমি' ? কেউ কি ভুমি উৎপাদনের কোনো যন্ত্র আবিষ্কার করেছ ?' তা সত্ত্বেও বহু চরিত্রের কথোপকথনের মাধ্যমে নাগাদের সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে যে সুশৃঙ্খলা রয়েছে তা প্রকাশ করা হয়েছে 'ইয়ারুইঙ্গম-এ। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, শিকারের  আগের দিন স্ত্রী সঙ্গ করা নিষিদ্ধ, পবিত্র হয়ে শিকারে যাওয়া, অন্য নারীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক করলে শাস্তি বিধান, স্বামীর মৃত্যুর পর বৈধব্য জীবনযাপন, গ্রামের কারও মৃত্যু হলে পুরো গ্রামের মানুষদের সৎকারের কাজে অংশগ্রহণ, পুরুষেরা সামাজিক নিয়ম নীতি না মেনে অন্য গোষ্ঠীর মহিলাকে বিবাহ করলে তাকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ম প্রচলিত ছিল।
'ইয়ারুইঙ্গম' উপন্যাসের লেখকের নাগাল্যান্ড গিয়ে নাগা উপজাতিদের জীবন ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তা এই উপন্যাসে উপস্থাপিত করেছেন। বীরেন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য্য ছিলেন আসামের অধিবাসী। স্বাধীনতার পরে ১৯৫০ সালে তিনি নাগাল্যান্ডের উখরুল হাই স্কুলের চাকরির সুবাদে নাগাল্যান্ড যান। ফলে তিনি নাগাল্যান্ডে ভারতের সহিংস ও অহিংস আন্দোলনের প্রভাব, খ্রিস্টান মিশনারীদের নাগা পাহাড়ের আধিবাসীদেরকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা, নাগাযুবকদের শিক্ষা-দীক্ষায় আগ্রহ ইত্যাদি সম্বন্ধে যে সব তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন তা 'ইয়ারুইঙ্গম'-এর উপজীব্য বিষয়। উপন্যাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা নাগা পাহাড়ের মানুষদের জীবনকে ভয়ংকর অবস্থার সম্মুখীন করেছিল এবং যুদ্ধের গোলা-গুলিবর্ষণে নাগাদের বাড়িঘর সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়েছিল। ১৯৪৫ -এ যুদ্ধ শেষ হলে নাগা যুবকরা তাদের গ্রামগুলির পুনর্গঠন-এর কাজে আত্মনিয়োগ করে। বিদ্যালয় ও হাসপাতাল গড়ে ওঠে। তারপর ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে এবং নাগা পাহাড় ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত একটি রাজ্যের মর্যাদা পেলে তার অর্থনৈতিক উন্নতির পথ প্রশস্ত হয়। উপন্যাসে এই জনজাতির প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কিভাবে ক্রমশঃ বিলুপ্ত হয়ে চলেছে এবং নতুন চিন্তা-চেতনার সূচনা হচ্ছে তার ছবিও এখানে বিমূর্ত হয়ে উঠেছে। সাজ-পোষাকে, আচার-আচরণে নাগা যুবক-যুবতীদের উপর সমতলের মানুষদের বিশেষ করে বিদেশি খ্রিস্টানদের প্রভাব পড়েছিল। ফলে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি,তাদের ধর্ম, তাদের খাদ্যাখাদ্য, সাজপোষাক, নাচ, গান, উৎসব, পালা-পার্বণ, বিবাহ, তাদের বিশ্বাস ও সংস্কার, তাদের বাদ্যযন্ত্র, তাদের সামাজিক রীতিনীতি শৃঙ্খলা কিভাবে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল লেখক তাও এখানে লিপিবদ্ধ করেছেন। বলাবাহুল্য, 'ইয়ারুইঙ্গম' উপন্যাসে নাগা জনজাতিরা তাদের আদিম জীবনচর্যা থেকে কিভাবে আধুনিক জীবন-যাপনে ক্রমশঃ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল তার ধারাবাহিক ইতিবৃত্তটির উল্লেখ হয়েছে। শিকড়ের এই মানুষগুলি সংস্কৃতির স্রোতধারাকে যেভাবে সাহিত্যিক বীরেন্দ্র কুমার তাঁর সাহিত্যে তুলে ধরেছেন তাও প্রশংসনীয় ও সার্থক।