উত্তরের গ্ৰামীণ সমাজে লোকায়ত জীবন চৰ্যা ও লোকসংস্কৃতি লোক সাহিত্যের প্ৰবহমান একটি ধারা৷ এই ধারা প্ৰকৃতির নিয়মেই আপন স্বকীয়তায় প্ৰবাহিত হয়ে থাকে৷ রাভা-জনগোষ্ঠী লোকেদের সমাজ জীবনেও অনুরূপ ধারা প্ৰবাহিত৷ তবে অন্যদের থেকে একটু ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র৷ বলাবাহুল্য এই ভিন্নতা ও স্বতন্ত্রতার মাঝেও দৈনন্দিন জীবন চিত্ৰ প্ৰায় একই রকম৷ অন্যদের মতই সুখ,দুঃখ,হাসি-কান্নায় ভরা তাঁদের সমাজ জীবন৷ সেই সমাজ জীবনের মৌলিক চেতনার অনুভূতি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে মৌখিক সাহিত্য৷ বস্তুত যে সাহিত্যের নেই কোনো লিখিত রূপ, নেই কোনো সৃজন কৰ্তা চলার পথে জীবিকার অনুভূতি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই সাহিত্য৷ যার মধ্য দিয়ে প্ৰকাশ পেয়েছে সুখ দুঃখের নানা কাহিনী ও জীবন চিত্ৰ৷ যা সমাজ জীবনের মানচিত্ৰও বলা যায়৷
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে মৌখিক সাহিত্য হলো সমাজ দৰ্শনের একটি অনুবীক্ষণ যন্ত্র৷ যার মাধ্যমে লোকায়ত সমাজ জীবনের প্ৰকৃত চিত্ৰ সহ নৃতত্ত্বের নিদৰ্শন খুঁজে পাওয়া যায়৷ সেই অৰ্থে রাভা সমাজে চৰ্চিত মৌখিক সাহিত্য সমাজ দৰ্শনের একটি আয়নাও বটে৷ কারণ এই মৌখিক সাহিত্যের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি তত্ত্বের লৌকিক কাহিনী সহ নারীকেন্দ্ৰীক সমাজ জীবনের নানা দিক খুঁজে পাওয়া যায়৷ সেই দিক থেকে কালক্ৰমে অতিবাহিত রাভা জনগোষ্ঠীর লোকেদের জীবন জীবিকার প্ৰণালী নানা বাঁকে প্ৰবাহিত এবং বিবর্তিত হলেও মৌখিক সাহিত্যের প্ৰচলন বহু প্ৰাচীনকাল থেকেই প্ৰচলিত৷ বলা যায় সৃষ্টির আদিকাল থেকেই৷ সেই আদিকালের সাহিত্য হলো মুখে মুখে প্ৰচলিত প্ৰবাদ-প্ৰবচন, ছড়া, হেঁয়ালী, লোকশ্ৰুতি, লোক কথা, লোক কাহিনী ও লোকগীতি৷ যার মাধ্যমে জানা যায়-লোকায়ত সমাজ জীবনের নানা আত্মকথন সহ সমাজ শিক্ষার উপাদান৷ সেরকমই সুদূর প্ৰসারী মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত রাভাদের সুপ্ৰাচীন এবং লুপ্তপ্ৰায় একটি লোকশ্ৰুতি থেকে জানা যায় পৃথিবী সৃষ্টির কাহিনী৷ স্বভাষায় লোকশ্ৰুতিটি এই রকম ঃ—
রাভাঃ
আমবাড়ী জামবাড়ী-
হাসঙ্তােকৗ মামাবৗলা,
উয়ৗন সায়অৗউ মাকসা মাকপড়,
চৗলপাগ মাসৗউ িচকা ঝড়া,
বঙ্গানুবাদঃ-
আম’বন জামবন জঙ্গলময় পৃথিবী,
সৃষ্টি করলো পরম পিতা(সৃষ্টি কৰ্তা)
সেখানেই জন্ম নিলো বাঘ-ভাল্লুক,
জীবন পেলো(সজীব হলো)নদ-নদী ইত্যাদি,
এইরূপ েলাকশ্রুতির মধ্য দিয়ে যেমন জানা যায় পৃথিবী সৃষ্টির নিগুঢ় তত্ত্ব, তেমনি নারী কৰ্তৃক প্ৰবাহিত মাতৃতান্ত্রিক প্ৰথার "হৌসুক-সরু "অৰ্থাৎ গোত্ৰ সূত্ৰে আপন জনকে খুঁজে বের করার বিরলতম প্ৰক্ৰিয়ার কথাও জানা যায়৷ এ এক অদ্ভূত পদ্ধতি! মাতৃ সূত্ৰে প্ৰবাহিত "হৌসুক" অৰ্থাৎ গোত্ৰের সূত্ৰ ধরেই কোনো সময় হারিয়ে যাওয়া আপনজন বা আত্মীয়কে খুঁজে বের করা হয়৷
প্ৰসঙ্গত উল্লেখ্য মঙ্গোলীয়ান বংশোদ্ভূত রাভারা বংশ পরম্পরা ভাবেই মাতৃতান্ত্রিক এবং মাতৃতন্ত্রের রীতিতে প্ৰবাহিত হয় তাঁদের সমাজ জীবন৷ সেই সমাজ জীবনের যাবতীয় রীতি নীতি নিয়ন্ত্রিত হয় মাতৃতন্ত্রের প্ৰথা অনুযায়ী৷ সেই অৰ্থে রমনীরা এই জনজাতির মুখ্য পরিচায়ক৷ যার কারণে মহিলাদেরকে প্ৰকান্তরে গৃহকৰ্ত্ৰী’ বলে গণ্য করা হয়৷ সমাজের চিরাচরিত প্ৰথা অনুযায়ী বংশ পরিচয়ের সমৃদ্ধি ঘটে মূলত মহিলাদের গোত্ৰের সূত্ৰ ধরেই৷ সেই সূত্ৰে সমাজের লোকেদের বিশ্বাস কেউ কোনোদিন হারিয়ে গেলেও (বিশেষ করে মহিলারা) খুঁজে বের করা অসাধ্য কিছু নয়৷ কারণ রাভাদের মাতৃ সূত্ৰে বহণ করা "হৌসুকবারায়" অৰ্থাৎ গোত্ৰ পরিচয় এই জনগোষ্ঠীর লোকেদের ইহকাল পরকাল যোগসূত্ৰের অনন্ত রেখা৷ তার কোনো মরণও নেই, ক্ষয়ও নেই৷ নদী যেমন মরে গেলে তার প্ৰবাহিত গতিরেখা থেকে যায়, তেমনি এই জনগোষ্ঠীর কেউ কোনোদিন হারিয়ে গেলেও অক্ষরেখার ন্যায় তার "হৌসুক" অৰ্থাৎ গোত্ৰ সূত্ৰ থেকেই যায়৷ আর সেই সূত্ৰ ধরেই হারিয়ে যাওয়া পরিজন বা আত্মীয়কে খুঁজে নেওয়া সহজ হয়৷ সেরকমই একটি সুপ্ৰাচীন লোকশ্ৰুতি প্ৰচলিত রয়েছে৷ স্বভাষায় লোকশ্ৰুতিটি এই রকমঃ-
রাভাঃ
হৗসুক সৗরু তারায় নাঙা িতিঙ-হৗসুক সৗরু বাসায়মৗন,
সৗরুবিন্দু িমলায়মৗন,
অৗকৗই সুক লানা নাঙ্ িতিঙ-----
বঙ্গানুবাদঃ-
গোত্ৰের সূত্ৰ ধরে মিলাব মোরা আজ-
জ্ঞাতি গোত্ৰ নির্ণয় করে,
রীতির জল (সম্পৰ্ক) মিলিয়ে নিয়ে,
আপনজনকে খুঁজে নেবো আজ-----
উল্লেখ্য রাভা সমাজে পিতৃ ধারার প্ৰবাহিত রক্তের সম্পৰ্কের থেকে মাতৃ সূত্ৰে বহনকারি স্বগোত্ৰের আত্মীয়কে বেশী আপন বলে মান্য করা হয়৷ কারণ মাতৃ সূত্ৰে প্ৰবাহিত"হৌসুক" অৰ্থাৎ গোত্ৰই বংশ পরিচয়ের সমৃদ্ধি ঘটায়৷ সেই কারণেই বাড়িতে কখনো স্বগোষ্ঠীর কোনো অতিথির আগমন ঘটলে পরিচয় জ্ঞাপনের সময় আগে তাঁর "হৌসুক" অৰ্থাৎ গোত্ৰ যাচাই করা হয়৷ সেই পরিচয় পৰ্বে আগন্তুক ব্যক্তি যদি কোনোক্ৰমে গৃহ কর্তার গোত্ৰের সঙ্গে সমগোত্ৰ’ বা জ্ঞাতি গোত্ৰ হয়, তাহলে তাঁরা পরম আত্মীয় বলে গণ্য হন৷ মনে করা হয়, আগন্তুক ব্যক্তি অতীতে কোনো সময় হারিয়ে যাওয়া একই মায়ের কন্যাসন্তানের বংশধর৷
বলা বাহুল্য প্ৰকৃতির নিয়ম অনুযায়ী মেয়েদেরকে ভিন্ন গোত্ৰের পুরুষ সঙ্গী গ্ৰহণ করে সংসার ধৰ্ম পালন করতে হয়৷ সেই সূত্ৰে অতীতে জীবন জীবিকার তাগিদেই খাদ্য অন্বেষণে পরিবার পরিজন নিয়ে নানা প্ৰান্তরে ঘুরে ঘুরে দিন-যাপন করতে হতো৷ সেই সময়েই পরিভ্ৰমণ কালে অনেকে মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন৷ ফলে জন্ম সূত্ৰে একই নাড়ীর আপন জনেরা একে অপরের থেকে বিচ্ছেদ হয়ে যায়৷ সেই কারণেই-গোষ্ঠীর লোকদের বিশ্বাস অতীতে হারিয়ে যাওয়া আপন জনের কোনো না কোনো সময় দেখা হবেই৷ আর সেই বিশ্বাস আজও সমাজে পোষণ করে৷ যার কারণে বাড়িতে স্বগোষ্ঠীর কোনো অতিথি এলে তাঁকে স্বভাষায় জিজ্ঞাসা করা হয় তুমি কোন্ গোত্ৰের ? বস্তুত এইরূপ গোত্ৰের সূত্ৰ ধরেই খুঁজে বের করা হয় হারিয়ে যাওয়া আপনজনকে৷ এই খুঁজে নেওয়ার প্ৰক্ৰিয়াকে স্বভাষায় বলা হয় "হৌসুক তারায়ঙি" অৰ্থাৎ গোত্ৰ নিৰ্নয় করার পদ্ধতি৷ সেই অৰ্থেই উল্লেখিত ছড়া বা লোকশ্ৰুতিটির গুরুত্ব অত্যন্ত প্ৰাসঙ্গিক৷ সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, এইরূপ ছড়া বা লোকশ্ৰুতি নৃতাত্ত্বিক তথা সমাজ দৰ্শনের তাৎপৰ্য্ বহন করে৷ শুধু গোত্ৰ নিৰ্নয়ই নয়, রাভাদের দৈনন্দিন জীবনচৰ্যাতেও জড়িয়ে রয়েছে মৌখিক সাহিত্যের নানা উপাদান৷ তার মধ্যে শিশু সন্তান পরিচৰ্যা ও শিশু ভোলানো সহ ব্যঙ্গাত্বক রসিকতার নানা ছড়া রয়েছে৷ সেরকমই শিশু পরিচৰ্যার একটি ছড়া প্ৰচলিত রয়েছে৷ স্বভাষায় ছড়াটি এই রকমঃ-
রাভাঃ
েকেরং বৗইয়া’কুরুং বৗইয়া,
নিিন হৌনি নাচর হানা-
নুকুং হানা,
বঙ্গানুবাদঃ-
হাঁড় বাটি কুড়বাটি-
তোর শ্বশুরের নাক কাটি-
কানটা কাটি,
উল্লেখ্য জনসমাজের প্ৰতিটা সম্প্ৰদায়ের মধ্যেই কম বেশী শিশু পরিচৰ্যার প্ৰচলন রয়েছে৷ কিন্তু রাভা রমনীদের সেই পরিচৰ্যার পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র৷ সেখানে নেই কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া, নেই কোনো তথাকথিত শিক্ষার জ্ঞান৷ মায়েদের মৌলিক চেতনার অনুভূতি থেকে নিৰ্বাহিত অন্তৰ্নিহিত সেই জ্ঞান৷ পরিভাষায় যাকে বলা হয় ’লোকাচার’ ৷ সেই লৌকিক আচার আচরণে শিশুকে বলিয়ান ও পুষ্ট করে তোলা হয়৷ উল্লেখিত ছড়াটি তারই উদাহরণ৷
প্ৰসঙ্গত উল্লেখ্য গ্ৰামাঞ্চলের মায়েরা শিশুকে স্নান করানোর পর সাধারণত উষ্ণ গরম সৰ্ষের তেল শিশুর শরীরে মালিশ করান৷ অনুরূপভাবে রাভা রমনী বা মায়েরাও শিশুকে তেল মালিশ করান৷ বিশেষত শিশুকে স্নান করানোর পর শিশুর মা অথবা পরিবারের দায়িত্বশীল কোনো মহিলা আধ ছায়া রোদে দুই পা লম্বা করে বসে,পরিধেয় বস্ত্র আটো সাটো করে গুটিয়ে উলঙ্গ শিশুকে দুই উরুর মাঝখানে শোয়াইয়ে উষ্ণ তেলের প্ৰলেপ দিয়ে মালিশ করেন৷ সেই সময় শিশুর নরম হাত-পা এদিক ওদিক েমাচড় দিতে দিতে উল্লিখিত ছড়াটি বলে থাকেন৷ আপাতদৃষ্টিতে সাময়িক আনন্দ বা নিছক রসিকতা মনে হলেও প্ৰকান্তরে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানকেই প্ৰমাণিত করে৷ কারণ এইরুপ শিশুর হাত পা নড়া চড়া বা মৰ্দন করা মানেই শিশুর শরীরের শিরা-উপশিরা ও মাংস পেশির স্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়া৷ সূতরাং রাভা রমনীরা অজান্তেই চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে৷ শুধু শিশু পরিচৰ্যাই নয়,শিশুকে কোলে নিয়ে স্নেহ ভরা ব্যঙ্গাত্বক ছড়া কাটা, বা শিশুকে নাচাতে নাচাতে বাবা মা’র উদ্দেশ্যে ব্যঙ্গ রসের ছড়া প্ৰচলিত রয়েছে৷ তার মধ্যে শিশুর বাবাকে ব্যঙ্গ করে রসে ভরা একটি ছড়া পাওয়া যায়৷ স্বভাষায় ছড়াটি এই রকমঃ-
রাভাঃ
তিং বাবা তিং-
িনিন আওয়া বৗিসতা
কেপ্ৰাক সিং,
বঙ্গানুবাদঃ-
তাধিনা ধিন ধিন-
তোমার বাবা নাচ করে
বেটে বেটে সিং,
অনুরূপ ভাবেই শিশুর চঞ্চলতা ও দুষ্টমির নিরিখে বাঁদরের সঙ্গে তুলনা করে মিত্ৰতা জুড়ে দেওয়ার ছড়া রয়েছে৷ স্বভাষায় ছড়াটি এই রকমঃ-
রাভাঃ
হাঁয় িপিদং হাঁয়-
পান ফাঙায় কৌয়ৗই বৗসা’
উয়ৗইন িনিনবায়,
বঙ্গানুবাদঃ-
হায় পিদিং হায়(অলঙ্কার)
গাছের ডালে বাঁদর নাচে
সেটিই তোমার বন্ধু,
শুধু বন্ধুই নয়, শিশুর জন্য পৃথিবী ঘুরে বৌ এনে দেওয়ারও ছড়া রয়েছে৷ ছড়াটি এই রকম—
রাভাঃ
হাসঙ্ বৗিজমৗন ৈফয়ৗউ আঙ্-
িমিচক সাকসা মৗকতানাং িগলপুক না’নাং,
বঙ্গানুবাদঃ-
পৃথিবীটা ঘুরে এলাম আমি-
তোর জন্য বৌ পছন্দ করেছি
গলায় একটি ঘেঘ্(গোলগন্ড)
লিঙ্গ বিশেষে বিপরীত ধৰ্মী ছড়াও রয়েছে৷ সেক্ষেত্ৰে শিশু যদি মেয়ে হয়, তাহলে তার বেলায় বলা হয়-
রাভাঃ
মাশলাঙ্গা কাঁও কাঁও-
ভূত পাকারাও,
কিলাং সাকসা চেইতানাং-
তত’গাগাড়াও,
বঙ্গানুবাদঃ-
মাছরাঙা ফড় ফড় করে-
যেন দেখতে ভূতের মত,
একটি জামাই পছন্দ করেছি-
তার পুরুষাঙ্গটি খাটো,
এই ছড়াটির মধ্যে ঈষ্বৎ অশ্লীলতার স্পৰ্শ থাকলেও শিশু মনের সরলতা থেকেই বলা হয়ে থাকে৷ এছাড়াও আরও এমন কিছু ছড়া প্ৰচলিত আছে, যা শুধু মহিলাদের ক্ষেত্ৰেই প্ৰযোজ্য৷ উদাহারণ স্বরুপ হালকা শব্দের সে রকমের একটি ছড়া তুলে ধরা হলো৷ স্বভাষায় এই রকম
রাভাঃ
হা’পালাং পালাং
পান পালাং পালাং,
নিনি আমায় মলায়’জু-
জিতুং কাব্লাং,
বঙ্গানুবাদঃ-
মাটি ছুঁই ছুঁই-
গাছের আগা ছুই ছুই,
তোমার মা লজ্জাবতী-
পাছাটি ফুটো,
এইরূপ পাছা ফুটো বা ফাটা’র ন্যায় কিছু মেয়েলি অশ্লীল শব্দ রয়েছে যা পুরুষদের পক্ষে উচ্চারণ করা সম্ভব নয়৷ মূলত প্ৰতিবেশী মাসি পিসিরাই শিশুর মাকে জব্দ করার জন্যই শিশুকে কোলে নিয়ে নাচাতে নাচাতে ছড়াগুলি বলে থাকেন৷ এছাড়াও শিশু ভোলাতে চাঁদের বুড়ির গল্প কেই বা না জানে৷ জনসমাজের প্ৰতিটি সম্প্ৰদায়ের মধ্যেই চাঁদ মামা বা চাঁদের বুড়ির সুতো কাটার গল্প রয়েছে৷ যার প্ৰলোভনে শিশু মুগ্ধ হয়ে ভুলে থাকে৷ রাভা সমাজেও অনুরূপ গল্প ছড়া প্ৰচলিত আছে৷ তবে অন্যদের থেকে রাভাদের গল্প কাহিনী একটু ভিন্ন রকম৷ যেমন
রাভাঃ
গসা তারা-অৗঙ্িনং তারা,
তারানি আমায় অনতি হারা,
নগৌ’জিকামায় বিলৌ,
চাগ দাকা পিললৌ,
কেন্ট্ৰাক বুদি৷
বঙ্গানুবাদঃ-
একটি তারা দুইটি তারা,
তারার মা অনতি হারা,
ঘরের পিছনে জনাকু(জনাকি পোকা)
পাতা ছিড়ে হামাকু(তামাক পাতা)
থুর থুরি বুড়ি৷
এইরূপ ছড়ার মধ্য দিয়ে চাঁদের বুড়ির শীৰ্ণকায় শরীরের বৰ্ণনা দেওয়া হয় শিশুকে ৷ শুধু শিশু ভোলানোই নয়, দাদু-দিদাদেরকে ঠেস দিয়ে রসিকতা করারও নাতি-নাতনীদের ছড়া রয়েছে৷ উল্লেখ্য দাম্পত্য জীবনের শেষ লগ্নে এসে বুড়ো-বুড়িদের সম্বল হয় একে অপরের প্ৰতি নিৰ্ভর এবং জন্ম জন্মান্তরের অকাট্য ভালোবাসা৷ তাই বুড়ো কোনো সময় কখনো বাড়ির বাইরে গেলে বুড়ি উৎকণ্ঠায় দিন কাটায়৷ দৃশ্যত সেই অনুভূতি থেকেই নাতি-নাতনীরা দাদু-দিদাকে ঠাট্টা করে ছড়া কাটেন৷ ছড়াটি এই রকম
রাভাঃ
লৌয়াক কৗরৗঙা তরৎ তরৎ
হ্বা’চাপা পুঁমায়,
বুদা’লেইতানা তামা হৗতাং-
বুিদহেঁপা নগুয়ায়,
বঙ্গানুবাদঃ-
ব্যাঙ কাঁন্দে তর তর করে-
মাটি চাপার তলে,
বুড়া গেছে তামার হাটে-
বুড়ি কাঁন্দে ঘরে,
এইরূপ বুড়ো-বুড়ি ছাড়াও পরকীয়া প্ৰেমের ছড়াও পাওয়া যায়৷ বিশেষত শ্যালিকার প্ৰতি জামাই বাবুর দুৰ্বলতা এবং সেই দুৰ্বলতা থেকে প্ৰকারন্তরে শ্যালিকাকে বিয়ে করতে চাওয়া সমাজের বহুলাংশেই লক্ষ্য করা যায়৷ সেই প্ৰবাহমান মানসিকতা থেকেই জামাইবাবু শ্যালিকাকে বিয়ে করতে চান৷ কিন্তু বাধ সাধেন কন্যার মা বাবা৷ এদিকে উচ্ছল যৌবনা শ্যালিকারও মনের বাঁধ মানেনা৷ সেরকমই হতাশাপূৰ্ণ একটি ছড়া পাওয়া যায়৷ ছড়াটি এই রকমঃ-
রাভাঃ
স্বৗৰ্গৗ লৗউ লৗউ পুঁইমৗন লেইতা-
উয়ৗন ব্ৰাঁকা িটয়া,
কাবক আঙা লানা’নাপা-
কৈদি(টাকা)রুংশা পিয়া,
বঙ্গানুবাদঃ-
আকাশ পানে যায়রে উড়ে-
তাকেই বলে টিয়া,
জামাইবাবু আমাকে বিয়ে করতে চায়-
মা বাবা এক কুড়ি টাকা পণ চায়,
উল্লেখ্য অতীতে রাভা-সমাজে কন্যা পণের প্ৰচলন ছিলো৷ কোনো পুরুষ বিয়ে করতে চাইলে ক’নের মা ও বাবাকে কন্যাপণ দিতে হত৷ সেই অৰ্থে আৰ্থিক ভাবে দুৰ্বল জামাই বাবুর কন্যাপণ দেওয়ার মত সামৰ্থ ছিলো না৷ ফলে শালী জামাই বাবুর মধ্যে মিলনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়৷ সেই বিলম্বিত প্ৰেমের হতাশা এবং খেদ প্ৰকাশিত হয়েছে এই হেঁয়ালী বা ছড়ার মাধ্যমে৷
বলাবাহুল্য যুগ যুগান্ত ধরে পরকীয়া প্ৰেমের কাহিনী চলে এসেছে মানব সমাজে৷ যার জ্বলন্ত উদাহরণ আয়ান ঘরনী শ্ৰীমতি রাধিকার বিরহ কাহিনী৷ শ্ৰীকৃষ্ণের প্ৰেমে মজে শ্ৰীমতি রাধিকাকে শাশুরী ননদির সামনে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে৷ আর সেই বিড়ম্বনার হাত থেকে বাঁচতে তাকে তাৎক্ষণিক নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে৷ অনুরূপ বিড়ম্বনা লোক সমাজেও প্ৰভাবিত হয়েছিল৷ পরকীয়া প্ৰেমে বশীভূত হয়ে বিরহিনী রমনীকে কতই না বিড়ম্বনায় পড়তে হয়৷ বিশেষ করে স্বামী বা শ্বশুর শাশুরীসহ পরিচিত আত্মীয় পরিজনদের সামনে৷ আর সেই বিড়ম্বনা কাটাতে তাৎক্ষণিক নানা কৌশল অবলম্বন করে থাকেন৷ অনেকটা সেরকমই বিড়ম্বনা কাটানোর লুপ্ত প্ৰায় একটি হেঁয়ালী রয়েছে রাভা সমাজে৷ হেঁয়ালীটি স্বভাষায় এই রকম
রাভাঃ
পুরুং হায়অৗউ লাম’দাকানায়-
সায়তা খোক্সা চাগ,
বেতেৎচা বুতুৎচা-
হতং হুঁউয়াক,
বঙ্গানুবাদঃ-
ছাগল বাঁধলাম পথের ধারে-
খায় খোকসার পাতা,
চেনা নেই জানা নেই-
তুমি হ্যাঁ করে দেখছ কি?
(খোকসা এক ধরনের পাতা যুক্ত জঙ্গলী গাছ৷ তার পাতা ছাগল খেতে খুব ভালো বাসে)উল্লেখিত ভাব ধারার হেঁয়ালী রাজবংশী সমাজেও প্ৰচলিত আছে৷ হেঁয়ালীটি এই রকমঃ-
ঘাটার মাতাত বাঁন্দিলুং ছাগল-
খায় খোকসার পাত,
চিনা নাই জানা নাই-
ঠাট্টা মারেন কাক?
প্ৰসঙ্গত উল্লেখ্য-পরকীয়া প্ৰেমে বিরহী রমনী নানা অছিলায় তার প্ৰেমিকের সঙ্গে দেখা করার জন্য সুকৌশলে ঘরের বাইরে গিয়ে নিরালায় দু’দন্ড কথা বলার সুযোগ খোঁজেন৷ আর সেই সুযোগ তৈরী হয় গরু ছাগল বাঁধার অছিলায়৷ কিন্তু সেই সময় যদি স্বামী বা পরিচিত কেউ হঠাৎ দেখে ফেলেন, তাহলে বাঁচার উপায় কি? স্বাভাবিক ভাবেই প্ৰেমিককে গালি দিয়ে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া হয়৷ উল্লেখিত হেঁয়ালীটি বলা হয়েছে৷
বলাবাহুল্য রাজবংশী সমাজের সঙ্গে রাভাদের রীতিগত ফারাক থাকলেও মৌলিক ভাবান্তরের উৎস প্ৰায় একই রকম৷ তুলনামূলক পৰ্যালোচনা করলে দেখা যায় প্ৰবাদ, প্ৰবচন, ছড়া বা হেঁয়ালীর মধ্যে নারীকেন্দ্ৰীক ভাবান্তরেই বেশী৷ বস্তুত রমনীরা পুরুষ অপেক্ষা পেশী শক্তির দিক থেকে সৰ্বদাই ছিলেন দুৰ্বল৷ ফলে দৈনন্দিন জীবন যন্ত্রণার সুখ, দুঃখের মুহূৰ্তগুলি প্ৰকাশ পেয়েছে এইরূপ প্ৰবাদ, প্ৰবচন, ছড়া, হেঁয়ালী ও লোকগীতির মধ্যদিয়ে৷ পরিভাষায় তাকেই বলা হয় মৌখিক সাহিত্য৷ এই মৌখিক সাহিত্যের মধ্যে যেমন রয়েছে রস সমৃদ্ধ কৌতুক কথা, তেমনি রয়েছে নারীর হৃদয়ের বিরহ যন্ত্রনার নানা আত্মকথন৷ বলাবাহুল্য এইরূপ আত্মকথনের প্ৰবক্তা রাজবংশী সমাজের রমনীদের মধ্যেই বেশী পাওয়া যায়৷ সেই তুলনায় রাভা সমাজের রমনীরা একেবারেই আত্মকেন্দ্ৰীক৷ তাঁদের ছড়া, প্ৰবাদ, প্ৰবচন বা লোকগীতির মধ্যে ব্যঙ্গ রসাক্তক কৌতুক কথা ও সুখ, দুঃখের নানান বিলাপ থাকলেও পরকীয়া প্ৰেমের কাহিনী তেমন পাওয়া যায়না৷ সেই দিক থেকে বলা যায় রাভা রমনীরা গোষ্ঠীকেন্দ্ৰীক জীবন যাপনে আবদ্ধ থাকায়,তাঁদের মৌলিক ভাবনার তেমন প্ৰসার ঘটেনি৷ শুধু বংশ পরম্পরায় বহন করে নিয়ে আসা মাতৃতান্ত্রিক নিয়মের কঠোর শৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রিত হয়েছে তাঁদের জীবনধারা৷ ফলে তাঁদের মধ্যে পরকীয়া বিষয়টি ছিলো সামাজিক অপরাধ৷ সেই তুলনায় রাজবংশী সমাজের রমনীরা ছিল বহু পূৰ্বের থেকেই ভাববাদী৷ বস্তুত সৰ্ব প্ৰাণবাদ বিশ্বাস পরিহার করে তাঁরা আৰ্য সংস্কারে সংস্কারকৃত হয়ে বৈষ্ণববাদে প্ৰবেশ করেছিলেন৷ ফলে তাঁদের মধ্য বৈষ্ণব ভাবধারার বিস্তার ঘটেছিল৷ আর সেই কারণেই রাজবংশী রমনীদের মধ্যে পরকীয়া প্ৰেমের বিস্তার ঘটেছিল৷ যার দরুণ প্ৰবাদ প্ৰবচন, হেঁয়ালী ও লোকগীতির মধ্যে বিরহ যন্ত্রণার আত্ম কথন সহ ছল চাতুরী ও বিষাদ ভরা নারী মননের নানা প্ৰলাপ পাওয়া যায়৷
তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, রাভা রমনীরা আত্মকেন্দ্ৰীক হলেও বংশ পরম্পরায় বহন করে নিয়ে আসা সংস্কৃতির ধারা তাঁদের মধ্যে সুদূর প্ৰসারিত৷ সেই সূত্ৰে রাভা রমনীরা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক৷ তাঁদের নিৰ্বাহিত সংস্কৃতির মাধ্যমেই পাওয়া যায় এই জনগোষ্ঠীর আদিমতম পরিচয়৷ সেরকমই সুদূর প্ৰসারিত লুপ্তপ্ৰায় একটি সুপ্ৰাচীন লোকগীতি প্ৰচলিত রয়েছে৷ স্বভাষায় লোকগীতিটি এই রকমঃ-
রাভাঃ
নািঙ েকাচা আচারেদা েতায়াসৗই-
িচকাবৗরৗই সৗই নািঙ-িচকাবৗরৗই সৗই,
উয়ৗন লায়মৗন নাঙ্ েকাচা-
উয়ৗন লায়মৗন নাঙচ-------
বঙ্গানুবাদঃ-
মোদের কোচ জাতির কলা কৃষ্টি আছে জলদান করা রীতি
হায় জলদান করার রীতি,
তাই নিয়ে আমরা কোচ
তাই নিয়েই আমরা------
উল্লেখিত লোকগীতিটির মধ্য দিয়ে যেমন মাতৃতান্ত্রিক রীতির কথা বলা হয়েছে, তেমনি দ্ব্যৰ্থহীন ভাষায় গোষ্ঠীর আদিমতম পরিচয়টিও প্ৰদান করা হয়েছে৷ সেই সূত্ৰে মৌখিক সাহিত্য নৃতত্ত্বের মাইল ফলকও বটে৷ এইরূপ মাইল ফলকের সূত্ৰ ধরে খুঁজে পাওয়া যায় একটি জাতির শিকড়ের সন্ধান৷ শুধু তাই নয়,সমাজ জীবনের নানা চিত্ৰ ফুটে ওঠে রমনীদের ছড়া, প্ৰবাদ ও লোকগীতির মাধ্যমে৷ সেরকমই প্ৰচলিত একটি লোকগীতি তুলে ধরা হলো৷ লোকগীতিটি এই রকম
রাভাঃ
বাঁ’খৗিত পালাও আনাও-
বাঁ’খৗিত পালাও,
িশর খৗিত দুকু আনাও-
িশর খৗিত দুকু,
উদুকুমৗন উপালাওমৗন-
িচকা ঝড়া হাসামায় নাকেচংিরিতয়া-
আনাও না’ েরিতয়া৷
নৗঙ্ দুকু নউ আনাও-
আঙ্ পালাও ৌলয়া,
িচকা ঝড়া হাসামায় নাকচেংরেতিয়া-
আনাও না’ েরিতয়া৷
রাসানবা দুনাংতা,িবগলাবান পুঁনাংতা৷
নায় আনাও নগুয়াং েলইয়া-
সৗই নগুয়াং েলইয়া------
বঙ্গানুবাদঃ-
বাঁশের কাঠির জাকই দিদি বাঁশের কাঠির জাকই,
শির কাঠির খালই দিদি-
শির কাঠির খালই,
সেই খালই নিয়ে সেই জাকই দিয়ে,
নদীর মোহনায় চিংড়ি ধরতে যাই দিদি মাছ ধরতে যাই৷
সূৰ্য অস্ত যাচ্ছে বকগুলিও উড়ে যাচ্ছে,
চলো দিদি ঘরে ফিরে যাই দিদি ঘরে ফিরে যাই৷৷
প্ৰসঙ্গত উল্লেখ্য মাতৃতান্ত্রিক রাভা সমাজে রমনীরাই গৃহকৰ্ত্ৰী৷ সেই সূত্ৰে নারী প্ৰধান তাঁদের সমাজ জীবন৷ ধৰ্মীয় রীতি নীতি ও সংসারের যাবতীয় দায় দায়িত্ব রমনীরাই পালন করে থাকেন৷ সেই অৰ্থে রাভা রমনীরা কঠোর পরিশ্ৰমী এবং সহনশীল পরায়ণ৷ কঠোর পরিশ্ৰমের পরেও তাঁরা নিজেদের ঐতিহ্য ও দায়িত্ববোধের কথা ভুলে যাননা৷ সংসার জীবনের দৈনন্দিন কাজকৰ্ম সেরে অবসর সময়ে তাঁরা দল বেঁধে জাকই ও খালই (মাছ ধরার যন্ত্র) নিয়ে নদীতে চিংড়িমাছ ধরতে যান৷ সেই মাছ শুকনা করে গ্ৰাম্য হাটে ভাগা দিয়ে বিক্ৰি করে সংসারের নিত্য প্ৰয়োজনীয় দ্ৰব্য যেমন নুন তেল হলুদ রন্ধন মশলা সহ নানা সামগ্ৰী ক্ৰয় করে থাকেন৷ একটি ভাগা রেখে দেন সেটি বিক্ৰি করে আনন্দের সহিত খিলিপান কিনে খান৷ বস্তুত সেই চিরন্তন জীবন ধারার চিত্ৰই চিত্ৰায়িত হয়েছে লোকগীতির মধ্যে ৷ বিশেষত রমনীদের দল বেঁধে মাছ ধরা এবং বেলাশেষে ঘরে ফেরা সমাজকে ঐক্য ও দায়িত্ববোধের প্ৰেরণা যোগায়৷ সেই অৰ্থে রাভা রমনীরা ত্যাগেরও প্ৰতীক৷ কারণ অক্লান্ত পরিশ্ৰমের পরেও হাসি মুখে তাঁরা পরিজনের সেবা করেন৷ সেই সূত্ৰেই সমাজ বিজ্ঞানীদের অভিমত রাভা রমনীদের আত্মত্যাগ এবং সমাজ সেবা প্ৰকারন্তরেই আধুনিক সভ্যতাকে জব্দ করে৷ কারণ তাঁদের পরম্পরা সংস্কৃতি সমাজ দৰ্শনের পথ দেখায়৷