মহামারীতে ধিমাল জনজাতি - গর্জন কুমার মল্লিক ( ধিমাল )

উত্তরবঙ্গে বসবাসকারী বহু জনজাতির মধ্যে ধিমাল জনজাতি একটি প্রাচীন আদিম জনজাতি। ধিমালদের আগমন সম্পর্কে অনেকের অনেক রকম মত থাকলেও ভারতীয় ধিমালদের পূর্বপুরুষরা আর্যদের আগমনের 1000 খ্রীষ্টপূর্বে ভারত উপমহাদেশের উত্তর পূর্ব হিমালয়ের অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। কিরাঁতশাখার একটি শাখার মধ্যে ধিমালরা ছিল । সেই আদিকাল থেকেই ধীমাল জনজাতির মানুষ যুগ যুগ ধরে উত্তরবঙ্গের তরাই অঞ্চলে, আদিবাসী ভূমিপুত্র হিসেবে বসবাস করে আসছে।
 তখনকার দিনে এই তরাই অঞ্চল ছিল স্যাঁতস্যাঁতে অস্বাস্থ্যকর ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরপ্রবণ এলাকা। ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। হিংস্র বাঘ, ভাল্লুক, নানান ধরনের সাপ, পশু-পাখি, হরিণ, ময়ূর ইত্যাদি বন্য পশুতে ছিল ভরপুর। নানান প্রতিকূলতা সহ্য করে ধিমাল, মেচ ও মারু জনগোষ্ঠীর মানুষ পশুশিকার, মৎস্য শিকার, ফল-মূল-কন্দ সংগ্রহ করে জীবনধারণ করত। পরবর্তীতে এই আদিবাসীদের জীবনশৈলীতে নেমে আসে বিরাট হতাশা ও বিপর্যয়। সরকার ধীরে ধীরে আদিবাসীদের ভূমি বনজঙ্গলের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা শুরু করল। দিশেহারা হয়ে আদিবাসী মানুষ ধিমালরা বাস্তুচ্যুত হয়ে ধিমালেরা পশ্চিমের গভীর ঘন জঙ্গলের দিকে, বোড়োরা পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে। গভীর জঙ্গলে মহামারী বন্য জন্তুকে সঙ্গী করে দার্জিলিং জেলার তরাই অঞ্চলে রয়ে গিয়েছিল আজকের ভারতীয় ধিমালদের পূর্বপুরুষরা। 
আজ থেকে ১৫০ — ২০০ বছর আগে ধিমাল জনজাতির মানুষ সম্পূর্ণরূপে ছিল নিরক্ষর। ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, কলেরা নানান ধরনের অসুখ থেকে বাঁচবার জন্য সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল ছিল ধামী ও ওঝাদের ঝাড়ফুঁক,  তুকতাক  আর লতাপাতা বনৌষধির উপরে। এই নিয়ম শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা ধিমালজাতি আজও ধরে রেখেছে। তাই আজও অসুখ-বিসুখ হলেই সর্বপ্রথমে তারা যায় ধামী বা ওঝার বাড়িতে। অসুখের কারণ খুঁজে কোন দেবতা রুষ্ট হয়েছে ওই দেবতার উদ্দেশ্যে জলপড়া, তেলপড়া, ঘিপড়া আর গাছ গাছড়ার ওষুধ তৈরি করে দিত ওঝা বা ধামীরা।  ধীরে ধীরে জঙ্গল শেষ হয়ে যাওয়ায় আর ওঝা বা ধামীর মৃত্যু হওয়ায় বনজঙ্গলে বনৌষিধ হারিয়ে যাচ্ছে।  ওঝা বা ধামীরা কাহাকেও শেখাতে চায় না। নিজের ছেলে, বংশের লোকেরা তাকে অনুরোধ করলে শিখিয়ে দেয়। তাকে ধর্মের বাবা বানালে কিছু কিছু শিখিয়ে দেয়। ধিমালদের অক্ষর জ্ঞান না থাকায় ওষুধের বিষয় কেহই লিখে রাখেনি। কিছু দলিলপত্র থাকলেও ঐ ধামী বা ওঝা মারা গেলে তার সমস্ত দলিলপত্র মাটিতে পুঁতে দেয়, ফেলে দেয়, আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। এটা একটা কুসংস্কার যা ধিমালরা বিশ্বাস করে। মৃত ব্যক্তির দলিলপত্র, কাপড়, জিনিস রাখলে মৃত ব্যক্তির আত্মা এসে বাড়ীর লোদের অত্যাচার করবে বলে তাদের বিশ্বাস। 
 বনবাসী আদিবাসী ধিমাল মানুষদের শরীরে অসুখ। এর সঙ্গে লড়াই করার দম বর্তমান। এর কারণ এরা  জঙ্গলে নানা ধরনের ফল, ফুল, লতা-পাতা, মধু, ডুমুর, ফেরং,কুরচিলা, টেকর, কাইচি, থানকুনি জোগাড় করে খেত। শাকসবজি, অল্প তেল, রসুন, আদা, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে যেমন তেমন রান্না করে খেত। মশলা তেল সামান্যই ব্যবহার করত। জঙ্গলের ধরা কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, মাছ শিকার করা জঙ্গলের শূকর, হরিণ, বনবিড়াল ইত্যাদির মাংস আগুনে পুড়িয়ে কাঁচা লঙ্কা লবণ দিয়ে খেত। আগেকার দিনের ধিমালরা বাড়িতে তৈরি চোলাই মদ হাঁড়িয়া পান করে, গল্পগুজব করে, ঢোল বাজিয়ে,বীণাতে ছড় কেটে গান নাচ করে নিশ্চিন্তে থাকতেন। সেদ্ধ করা শাকসবজি, মাংস, মাছ খেয়েছিল আগে ধিমালরা। খাওয়া-দাওয়া, রোদ বৃষ্টিতে কাজ করা নিশ্চিত শরীরে অসুখ থেকে বেঁচেই ছিল। তবুও যখন তখন গ্রামে মহামারী অসুখ আসত।
 ধিমাল মহিলারা সাবধান হয়ে, আঙ্গিনা, ঘর গরুর গোবর দ্বারা লেপা মোছা করতেন। নিমপাতার সেদ্ধ করা গরম জলে স্নান করতেন।  সামাজিক দূরত্ব পালন করে ভয়ার্ত মানুষ মহামারী থেকে বেঁচে থাকতেন। গ্রামে কলেরা আর অন্যান্য অসুখ আসার খবর শুনলে ধিমাল আদিবাসীরা ভয়ে ওই গ্রামে বেড়াতে যেতেন না। আগেকার দিনের ধিমালদের একটি আলাদা লোকের জন্য আলাদা ঘর ছিল। বাইরে থেকে আসা লোক ঐ ঘরেই গল্পগুজব করে চলে যেত। আজও বাইরে থেকে আসা লোকদের ধিমালরা ঘরে ঢুকতে দেয় না। আমাদের পশ্চিমঘর ঘরের মূল মানুেষর ঘর সেখানে আমাদের সাদি বেরাং দেবীর থান আছে।  বাড়ির লোক ছাড়া বাইরের লোককে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না। রান্নাঘর জমি থেকে এক দু ফুট উঁচু মাচাং-এর হয়ে থাকে, তার ওপরে ঘাস, গরুর গোবর দিয়ে একটি মোটা প্রলেপ দেওয়া হয়। তার জন্যই বর্ষার সময়েও রান্নাঘর ও অন্যান্য ঘরগুলি শুকনো থাকে। এটি একটি ভালো থাকার পদ্ধতি।আগের ধিমাল আদিবাসী  লোকেরা কাঁসার থালি, লোটা, বাটি, বাঁশের গ্লাস মাটির কলসে জল রাখত। শাকসব্জী ভাত পান করত এবং খেত। প্লাস্টিকের ও থার্মোকলের ব্যবহারের প্রচলন এই জনজাতিদের ছিল না। পূজা পার্বণে পেচং পাতা, কলাপাতা, কলার বাকলে মানুষ দই, চিড়া, গুড় খেত। আগেকার দিনে অনেক জঙ্গল, জল, বাতাস ছিল। পূর্বে মানুষ অসুস্থ হলে ভয় পেত, ভয়ে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেত। আজকের দিনে আমরা অনেক বুঝে গেছি তাই করোনার মত মানুষকে ভীত করা রোগকেও আমরা ভয় পাচ্ছি না। ভালো থাকার জন্য যা নিয়ম পালন করা দরকার আমরা মানছি না। মুখে মাক্স লাগাতে হবে, বারবার হাত ধুতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ঘরেই থাকতে হবে। অসুখকে লুকিয়ে রাখা যাবে না। আমরা শিক্ষিত সভ্য হয়েছি নিয়মগুলি জেনেও ভাঙছি আমাদের সুবিধার জন্য। বনজঙ্গল কাটছি, প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ করছি। আদিবাসী ধিমাল মানুষ নিজের প্রয়োজন অনুসারে শাকসবজি, পশুশিকার করেছিল। আজও ধিমাল আদিবাসী মানুষ প্রকৃতির গাছ, পাথর-পাহাড়, নদী, পশুগুলিকে স্মরণ করে পূজা করে। তার জন্য প্রকৃতিও তাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।  আজকের বাইরে থেকে আসা লোকেরা বন-জঙ্গল, নদ-নদীর জলের জায়গাগুলি নষ্ট করে সর্বনাশ করছে। সম্পত্তির লোভে বন-জঙ্গল কাটছে, জঙ্গলের পশুদের নির্বিচারে শিকার করছে। নদীতে বিষ দিয়ে, কারেন্ট দিয়ে মাছ ধরে প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ করছে, স্বার্থবাদী মানুষরা। তার জন্যেই মানুষ্যকৃত খারাপ কাজের ফলে জল, মাটি, বায়ু দিনের পর দিন বিষে বিষাক্ত হচ্ছে। মানুষ সাবধান হুশিয়ার না হলে খুব স্বার্থবাদী হলে করোনার মতো আরও নানান ধরনের অসুখ আসবে। মানুষ মরবে। মহামারী থেকে বাঁচার জন্য আদিবাসীর সাধারণ সরল জীবন ধারণের নিয়মগুলি ধরা প্রয়োজন। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে, না হলে আমাদের অস্তিত্ব পৃথিবীতে থাকবে না।