ঐতিহ্য পরম্পরায় আদিবাসী কোল তথা হো জনজাতির সংস্কৃতিতে পূজা পার্বণ - বীরেন্দ্রনাথ সিং তুবিড

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে আদিম জনগোষ্টীর মানুষজন তৎকালীন পরিবেশ মণ্ডলীর মধ্যে বসবাস করত, যা সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। যা প্রাচীন সংস্কৃতির উপর ঘটেছিল। তাদের মধ্যে কোল তথা হো জনগোষ্ঠী ছিল অন্যতম। এই আদিম জনজাতি নিজস্ব ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতি রয়েছে। এখানে ভিন্ন ঋতুতে নানান পূজা-পার্বণের বৈচিত্রতা লক্ষ্য করা যায়।
আদিবাসী কোল তথা জনজাতির মানুষজন মহামারী রোগ, ক্ষয়-ক্ষতি ইত্যাদি থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে পূজা-পার্বণ (সংস্কৃতি) -এর উপর খুবই বিশ্বাসী।
এইরূপ পরিপেক্ষিতে এই মহামারী রোগ, ক্ষয়-ক্ষতি এই জনগোষ্ঠীর উপর যাতে আঘাত আনতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে পাড়াভিত্তিক বা গ্রামভিত্তিক হিসেবে কোল তথা হো জনজাতি "দেশাওলি" (পূজার স্থান) স্থানে পূজা করে। এই দেশাওলি স্থানে যিনি পৌরহিত্য করেন তাকে কোল তথা হো ভাষায় বলা হয়ে থাকে "দিউরি"।
এই পূজা সম্পূর্ণরূপে মঙ্গলবার ও শনিবার ধরে করা হয়। পূজার যে উপকরণ ব্যবহার করা হয় তা হল একটি সিঁদুরের টিপ, ধূপ এবং এক ঘটি জল ইত্যাদি।
যেদিন পূজা করা হয় ঠিক তার আগেরদিন থেকে প্রত্যেক বাড়ির পুরুষদেরকে এবং 'দিউরি' (ব্রাহ্মণ) দেরকে উপোস থাকতে হয়। দিউরি-এর আদেশে পুরুষদেরকে গভীর জঙ্গল, ঘন পাহাড় থেকে "পাতাল গরুড়", "রানু র‍্াড", "গাই কেশরী", "বঙ্গা গড"  ইত্যাদি গাছের শেকড় যোগাড় করে আনতে হয় ঠিক পূজার আগে দিন থেকে,  এমনকি পূজার দিন ঠিক সকাল বেলায় ওই গাছের শিকড় বা ওষুধগুলো 'দেশাওলি' -তে রাখা হয়। দিউরি সকালবেলায় এক ঘটি জল নিয়ে 'দেশাওলি' -তে জল ঢেলে, সিঁদুর দিয়ে গাছের শেকড়গুলির উপর পূজা-অর্চনা করে। পূজা-অর্চনা করার পর পুজোর দিন ঠিক রাত্রি ৯ টা থেকে ১২ টার মধ্যে দুইজন বস্ত্রহীন যুবক প্রত্যেক বাড়ির দুয়ারে শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে তাতে ওই পূজা করা শেকড়গুলো পুঁতে দেয়। তারপর দিউড়িরা ওই পুঁতে দেওয়ার স্থানে ঘটি জল ছিটিয়ে সিঁদুরের টিপ দিয়ে দেয়। এরপর সকল বাড়ির মালিকদেরকে ডেকে পূজার শেকড়ের ঔষধ তাদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়।  তারা বাড়ির সকল ছেলেমেয়েদেরকে সাদা সুতো দিয়ে ঔষধটি বেঁধে গলায় মালার ন্যায় ব্যবহার করে, এছাড়াও হাতের বাহুতে বেঁধে রাখে।
এরপর গ্রামে বা পাড়ায় ঢোকার যে রাস্তা বা মোড় থাকে সেই পথেও পূজার্চনা করা হয় যাতে এইসব মহামারী রোগ পাড়া বা গ্রামে প্রবেশ করতে না পারে।
 গ্রামে বা পাড়ার মধ্যে কোনরূপ অশুভ শক্তি যদি থেকে থাকে, তাও বিভিন্ন দেবদেবীর নামে ডেকে তা বাইরে বের করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন বঁগা (দেবতা)-দের নাম( মাংবুরু, সিঞবঙ্গা, গঁআ বঙ্গা, বীর বঙ্গা, ধরমগুরু, কাউনরু গুরু)  গ্রামের আগের গুরুদেবের নাম এবং এখন গুরুদের নাম নিতে হয়। 
সিঞবঙ্গা নুতুম ত্যা, দুপুর দিশুম মারাংবঁগা,
চানালঅঃ দিশুম মারাংবঁগা
দুপুর দিশুম হাম হঅ ক
দুপুর দিশুম হাম হঅ ক

এই সব দেবতাদের নাম করে পূজা করতে হয়। এছাড়াও 'অআরাঙ' চিতি লিপির যে ৩২  টি বর্ণ রয়েছে এই বর্ণগুলিও হল একএকটি বঁগা (দেবতা)-দের নাম — অড, অঁআ, আ, উই,  ইউ, এ্যাঃ অঃ, হ্যায়াঃ, হিয়ঃ, ঈঃ, ঊঃ, অঙ, গয়, কঃ, ইঞ, উইজু, উইচ, এ্যান, ড, ট্যা, নুঃ, দাআ অত, আম, বুঃ, পুঃ, হয়অঃ, হলঅঃ, হড়, হার, সু, সী ।
এইভাবে কোল তথা হো জনজাতির মানুষজন ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে আজও তাদের মধ্যে আঁকড়ে রেখেছে। যাতে তাদের এই সংস্কৃতি পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত না হয়ে যায়। আঁকড়ে রেখেছে তাদের মাতৃভাষা এবং কথার মধ্যে গানের ছন্দ, চলার পথে নাচের ভঙ্গী। যা আমরা কোল তথা হো ভাষায় বলি —    
    স্যান গ্যা সুসুন
             কাজি গ্যা দুরাঙ।
    মাট গ্যা রুতু
          হাসা গ্যা দুমাঙ

স্যান = চলার পথ, সুসুন = নাচ, কাজি = কথা, দুরাও = গান, মাট = বাঁশ, রুতু = বাঁশি, হাসা  =  মাটি, দুমাঙ  =  মাদল।