প্রসঙ্গ ক্রম – ১
মহামারীর স্বরূপ ও প্রকোপ প্রসঙ্গে কিছু কথা ঃ —
'মহামারী' শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল — কলেরা-বসন্ত প্রভৃতি সাংঘাতিক সংক্রামক ও দুর্নিবার মারক-ক্ষমতা-সম্পন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবের ফলে দলেদলে লোকের মৃত্যুবরণ। কিন্তু সে যাই হোক, যতদূর জানতে পারা গেছে তার হিসাবে বলতে পারা যায় যে, মারক-ক্ষমতার দিক দিয়ে আজকের ‘ কোভিড ১৯ ‘ মোটামুটি জানুয়ারী ২০২০ থেকে প্রসার লাভ করতে করতে মাত্র ৬ থেকে ৭ মাসের মধ্যেই 'বৈশ্বিক-মহামারী'-র ( Global Epidemic ) যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তার তুলনায় অতীত কালে সংঘটিত কলেরা–প্লেগ-বসন্ত-ডেঙ্গু প্রভৃতি রোগের প্রকোপকে নেহাৎই নগণ্য বললেও দোষাবহ হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। আর তার কারণ হল 'কলেরা' আদি রোগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই রোগটি কোন ভাইরাস-জাত সে কথা সহজেই জেনে নিয়ে তদনুসারে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব হত। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় কোরোনা ভাইরাসকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা চিনে নিতে পারা গেলেও কোরোনা ভাইরাসের সংক্রমণকে কিংবা এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা লাভের মত কোন ঔষধ-ভেকসিন আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। আর তাই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে, এই অপ্রতিরোধ্য, অদম্য কোরোনা-ভাইরাসজাত সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার দিনে দ্বিগুণ, রাতে চারগুণ হিসাবে বেড়েই চলেছে। সত্য কথা বলতে কি 'বিশ-কা-বিশ' –এর এই 'কোবিড-১৯' যেন 'বিশ-শ-বিশ' গুণ বিষাক্ত বিষ-ক্রিয়ায় বিশ্ব-জীবনকে ( Global Life ) পলে পলে হাজারো লাখ কোটির কোঠায় 'মড়ার ঢিপে' — মৃত স্তুপে পুঁতেই চলেছে। বিশ্বের বড় বড় বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসক, গবেষকসহ 'বিশ্ব-স্বাস্থ্য-সংস্থা' ও অাজ যেন অসহায় অবস্থায় ভয়াবহ 'কোরোনা-ভাইরাস' -এর পাতালে ভূলুন্ঠিত হয়ে কাতরভাবে যেন কাঁদছে — 'ত্রাহি মাম্, ত্রানি মাম্ ‘আর ‘কোরো-না’ আর ‘কোরো না’ (Don’t do more, don’t do), আর 'মেরো না' – 'মেরো না ‘ (Don’t kill more, don’t kill) ইত্যাদি।
প্রসঙ্গ ক্রম – ২
সামাজিক স্তরভেদানুসারী মহামারী সম্পর্কিত ধ্যন-ধারণার স্তরভেদ ঃ —
বলা বাহুল্য কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবন-চৰ্যার অন্তর্গত জীবিকার উপায় সম্পর্কিত বাস্তব চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, রীতি-নীতি, দেব-দেবীর স্বরূপ, পূজা-পার্বণ পদ্ধতি, অনুষ্ঠান, সামাজিক বিধি-নিষেধ, সামাজিক অনুষ্ঠান, খাদ্যাভাস, আচার-বিচার প্রভৃতিই হল সেই-সেই গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সামাজিক ও মানসিকতার পরিচায়ক। আর এই দিক দিয়ে দেখতে পাওয়া যায় যে-সব সমাজে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোক যত কাল আগে থেকে যত বেশী পরিমাণে পড়েছে সে-সব সমাজ তত বেশী উন্নত তথা বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে উঠেছে এবং সামগ্রিকভাবে সামাজিক-মানসিকতাও হয়ে উঠেছে বিজ্ঞানভিত্তিক। আর এই সব সমাজের সংস্কৃতি-সভ্যতার রূপান্তরও অহরহই ঘটে চলেছে। ফলে সমাজে কদাচিৎ যদি কোন রোগের প্রকোপ 'মড়ক' বা 'মহামারী'-র রূপ ধারণ করে তখন এই সব শিক্ষিত ও বিজ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন সমাজ আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পদ্ধতির দ্বারাই মড়ক বা মহামারীর প্রকোপ থেকে আত্মরক্ষা করে থাকেন। এই তো হল বিশ্ব-মনুষ্য-সমাজের একটা দিক।
অপরদিকে দেখা যায় যে, এই বিশ্বে আর এক শ্রেণীর সমাজ রয়েছে যেগুলি হল একান্তভাবে সংরক্ষণশীল। আর এই সংরক্ষণশীলতার কারণেই এই সব সমাজের মানুষ পূর্ব পুরুষদের আদিম জীবন-চর্যার সবকিছুকেই হুবহু ধরে রেখেছে। পূর্বপুরুষদের আদিম জীবন-যাপন পদ্ধতি, রীতি-নীতি, বিশ্বাস, চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা প্রভৃতির সঙ্গে সঙ্গে এই সব সমাজের সংস্কৃতি-সভ্যতাও সেই আদিম অবস্থাতেই আজও রয়ে গেছে। অবশ্য এই ক্ষেত্রে বলতে পারা যায় যে, যে-কোন কারণেই হোক-না-কেন শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোক এই সব সমাজে পড়েনি বলেই সামাজিক মানসিকতার স্তর আজও অনুন্নতই রয়ে গেছে। আর তাই দেখা যায় এইসব অনুন্নত, শিক্ষ-দীক্ষা ও বিজ্ঞান-বুুদ্ধিহীন সমাজে কদাচিৎ কোন রোগের প্রকোপ মড়কের রূপ ধারণ করলে এই সমাজের লোক পুরুষানুক্রমিক দৈবী-বিশ্বাসের অনুসারে নিজেদের গ্রামীণ দেব-দেবীর পূজা-আরাধনার মাধ্যমকেই রোগের হাত থেকে অআত্মরক্ষার উপায় রূপে গ্রহণ করে থাকেন। পরিশেষে এইভাবে বলতে পারা যায় যে, যেসব সমাজের স্তর ( Strata ) যত উন্নত হয়ে থাকে সেই-সব সমাজের জীবন-চর্চা ও মানসিকতাও ততটাই উন্নত ও পরিবর্তনশীল হয়ে থাকে। বিপরীতভাবে, যে-সব সমাজের স্তর যতবেশী অনুন্নত ও অপরিবর্তনশীল থেকে যায় সেই সব সমাজের জীবনচর্যা ও মানসিকতাও ততটাই স্থিতিশীল থেকে যায়।
প্রসঙ্গ ক্রম – ৩
কুড়মি জনগোষ্ঠীর সামাজিক স্তর ও মহামারী সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা ঃ —
আলোচ্য কুড়মি জনগোষ্ঠীর বর্তমান বাসভূমি হল অবিভক্ত বিহার-বাংলা-উড়িষ্যা-মধ্যপ্রদেেশর সীমান্তবর্তী সুবৃহৎ ছোটনাগপুর মালভূমির আরণ্যক ভূ-ভাগ। এঁরা মূলতঃ হলেন বংশগত কৃষিজীবী এবং সিন্ধুসভ্যতা অঞ্চল থেকে বহিরাগত আর্যদের আক্রমণের ফলে পরাজিত, পলায়িত ও বিতাড়িত অবস্থায় এতদঞ্চলে আগত তথা কৃষিযোগ্য অঞ্চলে উপবিষ্ট সৈন্ধব দ্রাবিড়ীয় কুড়মি জনগোষ্ঠীর মানুষদেরই উত্তরপুরুষ। আর তাই দেখা যায় দ্রাবিড়ীয়, আদিম, টোটোমিক, সর্বপ্রাণবাদী, প্রকৃতি-পূজক আলোচ্য কুড়মি জনগোষ্ঠীর জীবন-চর্যার প্রতিটি ক্ষেত্রেই সিন্ধুবাসী পূর্বপুরুষদেরই বিশ্বাস, চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা জাত আদিম মানসিকতারই হুবহু ধারাবাহিকতা আজকের জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগেও পরিলক্ষিত হয়।
প্রসঙ্গত কুড়মি জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও মানসিক স্তরের প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, সবেমাত্র এই দু-তিন 'পিড়ছি' ( Generation ) আগেও কুড়মি জনগোষ্ঠীর অগণিত মানুষদের সবাই ছিলেন একেবারে 'ঠ্যাপা-ব্র্যান্ড' হালের বঁটাধারী ( বঁটা = হালের 'হাতল' ), নিরক্ষর। বিশ্বাস ও ধর্মবোধের দিক দিয়েও এঁরা মূলতঃ হলেন সর্বপ্রাণবাদী ও প্রকৃতি-নির্ভর। কারণ এঁদের পেশা কৃষিকার্যটি যেহেতু হল প্রকৃতি-নির্ভর তাই এঁদের জীবনচর্যার মধ্যেও প্রকৃতির প্রতি আনুগত্যের প্রভাব অত্যন্ত প্রবলভাবে দেখা যায়। স্বাভাবিক কারণেই এঁদের মানসিকতাতেও আত্মপ্রত্যয় দেখাই যায় না। কৃষিকার্যের সবকিছুই প্রকৃতির কার্যকলাপের উপর নির্ভরশীল বলেই আদিম কালাবধি এঁরা নিজেদের দেবদেবীকেই একান্তভাবে আপনজন করে হৃদয়ে স্থান দিয়ে আসছেন। ভাবটি হল জীবনের ভালোমন্দের সবকিছুর ভারাভার রয়েছে দেবদেবীর উপরই। কাজেই এঁদের একমাত্র কাজ হল কৃষিকার্য করে সামাজিক জীবন যাপন করা। আর এইভাবে দেখা যায় জীবিকার বাস্তব উপকরণ, সমাজের বাস্তব সর্বসাম্যবাদী সুসংহত রূপজাত ব্যবহারিক চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি-উপলব্ধি নিয়ে গড়ে উঠেছে এঁদের জীবন-চর্যা। আর এইভাবেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পূজা-পার্বণ, আনুষ্ঠানিক রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার, বিধি-নিষেধ, নৃত্য-বাদ্য, লোক-গীতি, লোক-সাহিত্য , শিল্প-দর্শন জীবিকা সাপেক্ষিক ব্যবহারিক বাস্তব-বুদ্ধি প্রভৃতি সবকিছুর সমন্বয়ে যেমন গড়ে উঠেছে কৃষিভিত্তিকসহ প্রকৃতি-নির্ভর প্রগাঢ় ধর্মবোধ ও দৃঢ় দৈবীবিশ্বাসমূলক মানসিকতা। আর তাই দেখা যায় হিন্দু দেব-দেবীর ন্যায় অবতারবাদ সর্বস্ব দেবদেবীর ( Incarnaed Deities ) কৃত্রিম মূর্তির পূজা, যাগ-যজ্ঞ, অনুষ্ঠান, হোম ইত্যাদি এঁরা করেন না। এঁদের দেব-দেবী সবই হলেন অবৈদিক সর্বপ্রাণ ভাবাদর্শমূলক ( Animistic ) ও প্রাকৃতজ (Naturally evolved ) অকৃত্রিম পাথর, মাটির ঢিপি, পাহাড়, ডুংরি, গাছ প্রভৃতি। আর এইসব দেব-দেবীর পূজা-আরাধনা-অনুষ্ঠানও এঁরা নিজেরাই করে থাকেন। ব্রাহ্মণ পুরোহিতের কোন স্থান কুড়মি জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও ধার্মিক কোন অনুষ্ঠানেই দেখা যায় না।
এছাড়াও কুড়মি সমাজের মানসিকতা প্রসঙ্গে সবিশেষভাবে আরও উল্লেখ্য যে, আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষা তথা জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগেও জীবনের সবদিক দিয়েই এঁরা রয়ে গেছন নেহাতই রক্ষণশীল, আত্মসমাহিত তথা বহির্জগৎ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ' বেদ-ব্রাহ্মণ ছাড়া ' হয়ে। আর এইভাবে দেখতে পাওয়া যায় যে, কুড়মি জনগোষ্ঠীর সমাজের 'স্তর' (Strata) তথা মানসিকতার 'স্তর'ও (Standard) রয়ে গেছে একেবারে অপরিবর্তনশীল ও স্থিতিশীল আদিম অবস্থায়। অবশ্য একথাও উল্লেখ্য যে, কুড়মি সমাজের দুরবস্থার মূলীভূত কারণ হল এঁদের সমাজে শিক্ষা-দীক্ষার প্রচার-প্রসারের অভাব। প্রসঙ্গতঃ ঐতিহাসিক তথ্যানুসারে এই ক্ষেত্রে জানতে পারা যায় যে, সিন্ধু-সভ্যতা অঞ্চলের যুদ্ধে আর্য শক্তির দ্বারা পরাজিত হলেও সিন্ধুবাসী কুড়মি জনগোষ্ঠীর তৎকালীন স্বাধীনচেতা পূর্বপুরুষেরা যেহেতু আর্যদের দাসত্ব স্বীকার তো করলেনই না বরং অহরহ আর্যদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত থাকতেন তাই ' ঋক-বৈদিক' আর্যরা সেইসব কুড়মিদের 'ব্রাত্য' ( আর্য-বিরোধী দস্যু, শত্রু, পাপী, পতিত আদি), 'মধুবাচন' (কর্কশ, দুর্বোধ্যভাষী) আদিরূপে অভিহিত করে একদা যারপরনাই পাশব অত্যাচার চালাতেন। ঠিক তেমনি ভাবে আবার গুপ্তকালীন পৌরাণিক যুগে গুপ্ত সম্রাটদের ছত্রচ্ছায়ায় আর্য-ব্রাহ্মণগণ কুড়মিদের তৎকালীন পূর্বপুরুষদের যাবতীয় মনুষ্য-সুলভ অধিকার কেড়ে নিয়ে ব্রাহ্মণ্য উচ্চবর্ণীয় ( ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য ) সমাজের সীমানার বহির্ভূত কাজ দিয়ে নিরক্ষর অস্পৃশ্য, অচ্ছ্যুৎ 'শূদ্র' শ্রেণীভূক্ত করে দিয়ে উচ্চবর্ণীয় তিনশ্রেণীর মানুষদের 'বেগার-চাকর-সেবক' এর ঘৃণ্য জীবন যাপন করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এমনকি পরবর্তী কালেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কুড়মি সমাজের মানুষ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রঘুনাথ সিং মাহাতর নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন বলে কুড়মিদিগকে 'চুয়াড়' (অসভ্য), নিষ্ঠুর, গোঁয়ার, দস্যু, ডাকাত আদি নামে তথাকথিতভাবে অভিহিত করে। এঁদের উপরে যে অমানুষিক পাশবিক অত্যাচার চালানো হয়েছিল তার প্রকৃষ্ট ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হল ' চুয়াড় বিদ্রোহ '। আর এরপরই চলতে থাকে ' সাঁওতাল-মুন্ডা 'দের বিদ্রোহ। ব্রিটিশ শক্তিও নির্মমভাবে এইসব বিদ্রোহকে দমন করলেও ব্রিটিশের অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় 'নাজেহাল', মরণাপন্ন পশুর মত শুধু লেজ নেড়ে মাছিই তাড়াতে পারে ঠিক তেমনি ) অবস্থা। পরিশেষে দূরদর্শী ব্রিটিশ দমননীতির বদলে 'প্রলোভন' দিয়ে এই সব জনগোষ্ঠীর মানুষদের শান্ত করার উদ্দেশ্যে এতদকাল সহাবস্থানকারী সাঁওতাল-মুন্ডা-হো-খাড়িয়া প্রভৃতি সহ 'কুড়মি' দেরও Schedule Tribe রূপে চিহ্নিত করে ভূসম্পত্তির অধিকার এদের সুরক্ষিত করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় স্বাধীনোত্তর ভারতে আজ কুড়মিদের 'জাতিসত্ত্বাগত পরিচিতি' কে (Ethnical identity of the Kurdnu's) ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। আজ কুড়মিরা "Scheduled Tribe" তো নয়ই এরা ঝাড়খণ্ডে হলেন E.B.C (Eternity Backward Class), পশ্চিমবঙ্গে O.B.C. ( Other Backward Class) এবং উড়িয়াতে S.E.B.C. ( Socially and Educationally Backward Class)। বলাবাহুল্য এইভাবে শিক্ষাদীক্ষা বঞ্চিত কুড়মি সমাজের স্তর (Strata) সেই পূর্ববৎ আদিম ও স্থিতিশীলই রয়ে গেছে। ফলে এঁদের মানসিকতার মধ্যেও কোন পরিবর্তন ঘটেনি বললেই চলে।
অতঃপর উপরোক্ত আলোচনা থেকে যেহেতু কুড়মিদের সামাজিক ও মানসিক স্তর আদিম অবস্থাতেই রয়ে গেছে, একথাও অনায়াসে অনুমেয় (Easily infarential) যে, মহামারীর হাত থেকে বাঁচার জন্য এঁরা পূর্বপুরুষদের মতই দৈবশক্তির উপর দৃঢ়বিশ্বাসী রয়ে গেছেন। এঁদের বিশ্বাস অনুসারে এঁদের দেব-দেবীরা হলেন জীবন-যাপন সম্পর্কিত ভালোমন্দ, বাধা-বিঘ্ন, বিপদ-বিপত্তি, রোগ-ব্যাধি, মড়ক-মহামারী প্রভৃতি সবকিছুরই একমাত্র ও সর্বশক্তিমান নিয়ামক, নিয়ন্ত্রক অধিদেবতা। আর তাই দেখা যায় কুড়মি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত কোন গ্রামে যখনই কোন েরাগ-ব্যাধি, মড়ক-মহামারীর প্রকোপ দেখা দিত, তখনই সেই গ্রামের ' লাইআ '/' নাইআ ' (Village Non-Aryan Priest) 'গরাম যান '-এ (Sacred place of the village Deities) গরাম দেব-দেবী-র (Village Deities) যথাবিহিত পূজা আরাধনা করে মানতও করতেন যে বিপদ থেক রক্ষা পাওয়ার পরেই পাঁঠা-ভেড়া-মোরগ-পায়রা আদি দেব-দেবীর সন্তুষ্টি বিধানের নিমিত্ত উৎসর্গ করা হবে। জনশ্রুতি অনুসারে এইভাবে 'গরাম' দেব-দেবীর পূজার পর রোগ-ব্যাধির প্রকোপ যে আর থাকত না সে কথাও জানতে পারা যায়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, আমি নিজেও হলাম কুড়মি সমাজের একজন মানুষ তথা আমার গ্রামের 'লাইআ'/'নাইআ' গোষ্ঠীভূক্ত হওয়ার কারণে প্রয়োজন অনুসারে 'গরাম থান'-এ দেব-দেবীর পূজা আজিও করেছি। কিন্তু সে যাই হোক, এ সব হল অতীতের কথা।
বলা বাহুল্য, বর্তমানকালীন 'কোবিড-১৯' জাত 'বৈশ্বিক মহামারী সম্পর্কিত কুড়মি সমাজের ধ্যান-ধারণাও হল বংশানুক্রমিক ধারাবাহিক সামাজিক প্রথার অনুসরণকরে 'গরাম' দেব-দেবীর পূজা-আরাধনার মাধ্যমেই কোরোনা ভাইরাসকেও বিনাশ করার ব্যবস্থা করা। প্রসঙ্গতঃ খোঁজ নিয়ে জানতে পারা যাচ্ছে যে, কুড়মি সামাজিক পরিমন্ডলের অন্তর্ভূক্ত যে গ্রামেই কোরোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে দেখা যাচ্ছে সেখানকার 'লাইআ' গ্রামস্থ পরিবারের গৃহ থেকে গরাম যানের পূজার উপকরণ ঘি, গুড়, দুধ, সিঁদুর, আতপ চাল ইত্যাদির সঙ্গে কিছুটা পবিত্র জল সংগ্রহ করে যথাবিহিত প্রথা অনুসারে দেব-দেবীর পূজা-আরাধনার ব্যবস্থা করছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, এই পূজা হল যেমন অবৈদিক তেমনই একেবারে অনাড়ম্বর। গরাম থানের প্রাচীন পবিত্র বৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় খোলা নীলাকাশের নীচে গাছের গোড়ায়, প্রাচীন পাথরে বা মাটির ঢিপের মধ্যে অধিষ্ঠিত থাকেন এইসব দেব-দেবী। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সিন্ধুসভ্যতার অধিবাসী কুড়মিদের পূর্বপুরুষেরা মূলতঃ ছিলেন দ্বি-দেববাদী — তাঁরা পরমপুরুষ সূর্য দেবতাকে কৃষিদেবতা —আদিদেবতা রূপে এবং পরম প্রকৃতি ধরিত্রী মাতাকে কৃষিদেবী — আদিমাতা রূপে পূজা করতেন। আর এই দুই দেব-দেবীর ধারাবাহিকতা দেখতে পাওয়া যায় কুড়মিদের মানসবোধের মধ্যে। তবে এই ক্ষেত্রে পূর্বপুরুষদের আদিদেবতা ও আদিমাতা কুড়মিদের নিকট হয়ে পড়েছেন 'বুড়্হাবাবা' (The oldest God-Father) মহাদেব শিব এবং 'বুড়হিমাঁই' (The Oldest Goddess-Mother) — মহাদেবী, শিবানী বা 'জাহিতি মাঁই'/ 'জাহিরি বুডহি'। বলাবাহুল্য এই দুই দেব-দেবীই বিভিন্ন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে দুর্গা-কালী-জগদ্ধাত্রী-জগদীশ্বর-পরমেশ্বর আদি নামে অভিহিত হয়েছেন।
কিন্তু সে যাই হোক, অতঃপর মহামারী সম্পর্কিত কুড়মি সমাজের ধ্যান-ধারণার প্রসঙ্গে উল্লেখ্য হল যে, যখনই কোন গ্রামে মহামারীর আশঙ্কা দেখা দেয় তখন সেই গ্রামের 'লাইআ' গরাম থানে অধিষ্ঠিত ঠাকুর-দেবতার নামে যথাবিহিত পূজা-আরাধনা করে ঠাকুর-দেবতাকে 'জুড়ির ভোগ' (জুড়ি হল পায়সান্নের প্রায়) উৎসর্গ করার পর পাঁঠা-ভেড়া-মোরগ আদি বলি দেন। এরপর ঠাকুরের পদতলে ভূলুন্ঠিত ভাবে 'গড় লাগিকে' (প্রণাম করে) প্রগাঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে মনের তলদেশ থেকে (From the bottom of the mind) মনে মনে ঠাকুরকে ডেকে বলেন —
" এ বুড়্হা বাপ ! এ বুড়্হি মঁাই ! মঁই পূজা-পাঠ তনতর মনতর কিছুই নিহিঁ জানিএ। লিজেক গুনেঁ দুইআ করিকে মঁরজকে দসলে জাঁকেঁ মাপি দেইকে এহে গাঁওএক জতেক লককে করনাক মড়ক-লে বাঁচাও। হেই ঠাকুর, তহরা কেরে আসরা, ভরসা। বাঁচাঅইআও তহরাই, আর মারঅইআও তহরাই। বাঁচাওবে ত বাঁচ্অব, আর মরাঅবে ত মর্অব। টুএক দইআ করেঁ, বাঁচাওএ হেন যেন। " অর্থাৎ " হে আদি পিতা ! হে আদি মাতা ! আমি পূজাপাঠ মন্ত্র তন্ত্র কিছুই জানি না। নিজের গুণে দয়া করে আমার যত দোষ থেকে আমাকে ক্ষমা করে এই গ্রামের যত লোককে কোরোনার মড়ক থেকে বাঁচাও। হে ঠাকুর তোমাদেরই আশা, ভরসা, বাঁচালেও আলাও তোমরাই, আর মারলেও আলাও তোমরাই। বাঁচাবে তো বাঁচবো, আর মরাবে তো মরবো। একটু দয়া কর, বাঁচাও ইত্যাদি। " বাস্তবিকই, এই যে 'মনের তল থেকে' ( From the bottom of the mind) দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে ঠাকুর-দেবতাকে কারও প্রার্থনা জানানো হয় এর চাইতে শক্তিশালী মন্ত্র আর কী-ই বা হতে পারে ! সত্যি কথা বলতে কি এই 'মন্ত্র' শব্দটির উদ্ভবও কুড়মালি শব্দ — 'মন' (mind) + কুড় শব্দ 'তর' (bottom) > মন-তর > মন্ত্র এইভাবে হয়েছে। আর 'মন্ত্র' শব্দটির বিৎপত্তিগত অর্থ হল — ' bottom of the mind' — অর্তাৎ মনের তলদেশ থেকে ঈশ্বরের প্রার্থনা করা।
প্রসঙ্গ ক্রম – ৪
পরিশিষ্ট ঃ পর্যবেক্ষিত
কুড়মি সমাজে মহামারীর ন্যুনর আর এক নৈসর্গিক দিক ঃ —
পরিশেষে বক্তব্য হল, উল্লিখিত 'গরাম' দেব-দেবীর পূজার ফলে কুড়মি সমাজের রোগ-ব্যাধি, মড়ক-মহামারীর প্রকোপ শান্ত হয় কি না সে সবের তর্ক-বিতর্কে যাওয়া আমার অভিপ্রেত নয়। কিন্তু সে যাই হোক একটা কথা না বললে সত্যের একেবারে অপলাপ করা হবে সে কথাটা হল — অন্তত অবতারবাদী শিক্ষাভিমানী কেউই যদি কুড়মি সমাজের কৃষিভিত্তিক জাতিসত্ত্বা-সঞ্জাত খগোলীয় 'কার্য কারণতত্ত্ব' সম্পর্কিত এই সর্বপ্রাণবাদী নৈসর্গিক দৈবী বিশ্বাসকে এককথায় 'গোঁড়া অন্ধবিশ্বাস' আদি বলে উড়িয়ে দিতে চান তাহলে তো তাঁকে একথাও বলতেই হবে যে, অবতারবাদ সর্বস্ব বৈদিক যাগ-যজ্ঞ আদি বাহ্যাড়ম্বরপূর্ণ তথা পৌত্তলিক আধাত্মিক সব ধ্যান-ধারণাও হল একেবারে অলীক, কাল্পনিক ও বিভ্রান্তিকর। কিন্তু এসব কথা এখন থাক।
অতঃপর কুড়মি সমাজে মহামারীর ন্যুনতার পিছনে যে দুটি নৈসর্গিক কারণ সাধারণতঃ সবার অদৃশ্যভাবে অহরহই ক্রিয়াশীল রয়েছে সে দুটি হল —
প্রথমতঃ — স্বাস্থ্যকর প্রাকৃতিক পরিবেশে কুড়মিদের বসবাস এবং
দ্বিতীয়তঃ — স্বাস্থ্যকর নিখাদ প্রাকৃতিক খাদ্যাভাস।
১ — স্বাস্থ্যকর প্রাকৃতিক পরিবেশে কুড়মিদের বসবাস ঃ —
প্রসঙ্গতঃ সংক্ষেপে বলা যায় যে, ছোটনাগপুর মালভূমির অগণিত ছোটবড় পাহাড়-পর্বত-ডুংরি-নিঃসৃত ছোটবড় অসংখ্য নদী-নালা-ঝরনার জল-বিধৌত তথা শাল-পলাশ-পিয়াল-মহুল প্রভৃতি অসংখ্য মহীরুহ সমাচ্ছাদিত দুর্ভেদ্য বন-জঙ্গলে সমাকীর্ণ এমন এক সুবৃহৎ বিচিত্র ভূভাগে বিচিত্র কুড়মি জনগণের বসবাস রয়েছে যে ভূভাগটির প্রাকৃতিক পরিবেশ স্থল একান্তভাবে অনাবিল, উন্মুক্ত ও জীবনীশক্তিদায়ক।
বহুল প্রচলিত কুড়মালি লোকক্তি নির্দেশিত কুড়মাঞ্চলটি হল
' শিখ-শিখর-নাগপুর
আধাআধি খড়গপুর।
— অর্থাৎ শিখভূম বা উড়িষ্যার 'ময়ূরভঞ্জ' রাজ্য, পরেশনাথ পাহাড় কেন্দ্রিক 'শিখর' ভূম রাজ্য, ছোটনাগপুরের 'নাগপুর' রাজ্য এবং খড়গপুর ও মেদিনীপুরের ১৮ টি পরগণা সম্মিলিত ভূভাগটিই হল কুড়মিদের বাসভূমি অঞ্চল। কৃষিযোগ্য সর্বত্র এঁরা এহেন অনুপম পরিবেশে আবহমানকালাবধি বসবাস করে অাসছেন বলে ভেষজ নানান গাছ-গাছড়া পরিবেশিত বিশুদ্ধ প্রাণবায়ু জীবনভর বুকভরে সেবন, খনিজ-গুণ-সম্পন্ন পার্বত্য ঝর্ণা-নির্ঝরণী নিঃসৃত সুনির্মল জলপান, বনজ স্বাস্থ্যদায়ক ও শক্তিবর্ধক নানান ধরণের ফল-মূল, কন্দমূল ভক্ষণ, অনাবিল প্রাকৃতিক পরিবেশে অবারিত বিচরণ, পশুপালন তথা কৃষিকর্ম নিয়ে নিরলস শারীরিক পরিশ্রম প্রভৃতির ফলশ্রুতিতে কুড়মি সমাজের মানুষদের রোদে পোড়া কালো 'বেঁটে অাদুড় গা' (Sun-burned black short body) নৈসর্গিক কারণেই এত সুদৃঢ়, শক্তিশালী ও রোগ প্রতিরোধক
(Sturdy and antigenous) হয়ে পরে যে রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাই এঁদের একেবারে কম হয়ে যায়।
২ — স্বাস্থ্যকর নিখাদ প্রাকৃতিক খাদ্যাভাস ঃ —
(ক) সাধারণ খাদ্য ঃ প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সুস্থ, সবল, শক্তিশালী তথা নানান ধরণের রোগজীবাণু প্রতিরোধক ক্ষমতাসম্পন্ন দৈহিক গঠনের জন্য কার্বোহাইড্রেট, স্টার্চ, ভিটামিন, প্রোটিন, খনিজ রসায়ন প্রভৃতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের রোগজীবাণু প্রতিরোধক ক্ষমতাসম্পন্ন যেসব খাদ্যবস্তু যথা — ভাত, রুটি, ডাল, শাকসব্জি, মাংস, মাছ, ডিম, দুধ, ঘি, ফল-মূল, কন্দমূল প্রভৃতি নিজ নিজ রুচি অনুসারে সবসময় না হলেও প্রায়ই যে কোন মানুষ খাবার হিসাবে খেয়ে থাকেন। কুড়মি সমাজের মানুষেরাও এই সব খাদ্য তো খেয়েই থাকেন বরং সত্যি কথা বলতে কি এইসব এরা মাঝে-মধ্যে নয়, অহরহই খেয়ে থাকেন। কারণ উপরোক্ত খাদ্যবস্তু সংগ্রহের জন্য যে-ক্ষেত্রে বেশীরাভাগ লোক অর্থোপার্জন করে, সেই অর্থব্যয়ে কেনাকাটা করতে হয়, কুড়মি সমাজের মানুষদের মধ্যে সে-সবের কোন বালাই-ই দেখা যায় না। কারণ পেশার দিক দিয়ে কৃষিজীবী হওয়ার কারণেই কৃষিজাত খাদ্যবস্তুর জন্য এঁদের যেমন ভাবতেই হয়না তেমনি সহজাতভাবে এঁরা অামিষাশী হওয়ার কারণেই যেমন ঘরে ঘরে ছাগল-ভেড়া-মুরগি-হাঁস-পায়রা প্রভৃতি মাংস ডিমের জন্য পালন করে থাকেন তেমনিভাবে সেচনের সুবিধার্থে খোদিত ছোট-বড় বাঁধে-ডোবায় মাছ চাষ করার সঙ্গে সঙ্গে নদী-নালা থেকে মাছও শিকার করে থাকেন। সোজা কথায় আমিষ বা নিরামিষ সব ধরণের খাদ্য বস্তই এদের হাতের নাগালের মধ্যেই থাকে বলে অপুষ্টিজনিত 'রিকেট' রোগব্যাধিও এঁদের ধারে-কাছে প্রায় ঘেঁষতেই পারে না। ফলে শরীরও স্বাভাবিকভাবেই থাকে 'নিরোগ'। বলাবাহুল্য উল্লিখিত খাদ্যাভাসই হল কুড়মিসমাজের মানুষের সাধারণ খাদ্যাভাস।
(খ) অসাধারণ ও বিচিত্র খাদ্যাভাস ঃ —
প্রথমোক্ত সাধারণ খাদ্যবস্তু ব্যাতিরেকে কৃষিজীবী হওয়ার কারণেই অহরহ বনে-জঙ্গলে খেতে-খামারে-মাঠে-ঘোরাফেরা করতে করতে কুড়মি সমাজের মানুষেরা এমন সব বিচিত্র-বিচিত্র ফল-মূল, লতাগুল্ম আদি যেখান-সেখান থেকে সংগ্রহ করে খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন যেগুলি পৌষ্টিকতা ও নানান ভেষজগুণে এতই সমৃদ্ধ যে, কুড়মিদের দৈহিক ক্ষমতা অন্যের তুলনায় অত্যাধিক হয়ে যাওয়ার ফলে রোগ-ব্যাধির প্রকোপ এঁদের সমাজে মড়ক-মহামারীর রূপে প্রকট হতে পারে না বললেই চলে। এই সব বিচিত্র খাদ্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল নিম্নরূপ ঃ —
১) মাড়ভাত (Rice Water) ঃ —
কুড়মিদের প্রাত্যাহিক প্রিয় খাদ্য মাড়-ভাত হল মূলত ঃ —
(i) শারীরিক শক্তিবর্ধক ( Energy giving ),
(ii) ডাইরিয়ারোধক ( Diarrhea - Preventing ),
(iii) শরীরিক তাপমান নিয়ন্ত্রণকারী ( Maintains body Temperature ),
(iv) শ্বেতসারের উৎস ( Source of carbohydrate )
২) বাসি-ভাত ( Fermented-Rice ) ঃ —
কুড়মিদের প্রিয় 'বাইসাম' (< বাসি + আম ) বা 'Break Fast' হল মূলতঃ ঃ—
(i) Anti-bacteria,
(ii) Anti-Cholesterol-cum-anti-heart-attack,
(iii) Anti-virus,
(iv) Anti-gastritis,
(v) রক্তবাহী ধমনী পরিষ্কারক (Cleans and washes arteriosclerosis system),
(vi) রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতাবর্ধক ( Immune giving ),
(v) ভিটামিন-সি দায়ক ( Source of Vit - C )
৩) কুইলা খাড়হা গোকলা খাড়হা সাগ ঃ — জলাভূমিজাত গুল্মটি হল —
(i) Good Source of Iron,
(ii) Good Source of Iodine,
(iii) Enhance Physical and mental growth.
৪) পালুয়া ( Temarind leaf-powder ) ঃ —
গ্রীষ্মকালে মাড়-ভাতে মিশিয়ে খাওয়া হয়। অতিশয় মুখরোচক। ভেষজগুণে ভরপুর।
(i) রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতাবর্ধক ( Enhances anti-genous energy )
(ii) দূষিত ক্ষতরোধক ( Anti- Ulcer )
(iii) Anti - Gastritis,
(iv) Anti - Cancer,
(v) Increases W.B.C. (White Blood Cells) তথা শরীরের রোগজীবাণু ও ছত্রাক বিনাশক ( Engulfs and digests bacteria and fungi ),
(vi) Source of Vit- C.
৫) গিমহা সাগ ঃ — জলাশয়ের পার্শ্ববর্তী ভূমিতে জাত এই গুল্ম জাতীয় তিক্ত শাকটি হল মূলতঃ
(i) Anti - Malaria,
(ii) Anti - Diabetic,
(iii) Anti - Cancer,
(iv) Anti - Gastritis,
(v) Anti - Ulcer.
৬) নিমপাতা ঃ — গ্রীষ্মকালে নিমপাতা ভেজে তেল-নুন-মরিচ মিশিয়ে চাটনির মত নতুবা সিম-বেগুন
প্রভৃতির সঙ্গে ভেজে খাওয়া হয়। নিমপাতার ভেষজ গুণ হল প্রায় গিমহা শাকের অনুরূপ।
৭) গুইহা গাঁধারি সাগ ঃ — ছোট ছোট পাতাযুক্ত বুনোলতা স্বাদ কষা সাধারণতঃ
সর্দিকাশি হলে ঝোল করে ঘি মিশিয়ে খাওয়া হয়। গুণ হল —
(i) Good Source of Iron and Blood Vigour,
(ii) Increases Haemoglobin / R.B.C. (Red Blood Cells)
(iii) Oxygenates the body,
(iv) Strengthens Muscle.
৮) কালমেঘ ঃ — অত্যন্ত তিক্ত গুল্ম। প্রত্যহ প্রভাতে খালি পেটে খেলে পেটের কৃমি নষ্ট হয়।
তাছাড়া অন্যান্য ভেষজ গুণের দিক দিয়ে হল ' গুইলা খাড়হা বা গোকলা খাডহা সাগ',
'নিমপাতা', 'গুইহা গাঁধারির' মতই গুণসম্পন্ন।
৯) সনলা সজনা সাগ, ফল ও শুঁটি ( Drum-Stick ) ঃ — এই গাছটি হল সাধারণতঃ কুড়মি
পরিবারের পরিচয়বাহী গাছ। কারণ অধিকাংশ কুড়মি পরিবারেই এই গাছটি দেখতে পাওয়া
যায়। গাছটি হল অত্যন্ত উপকারী ও ভেষজগুণসম্পন্ন। যথা —
i) Source of Iron, Blood-vigorous, improves Haemoglobin-R.B.C
(ii) Anti - Virus (অনুবীক্ষণ যন্ত্র প্রেক্ষণীর অতি ক্ষুদ্র রোগজীবানুনাশক)।
iii) Anti - Ulcer,
iv) Anti - Gastritis,
v) Anti - Cancer,
vi) B. P. Regulator and anti-heart attack,
vii) Improves immunity energy.
১০) খেতসাগ কাঁথা সাগ চেঁথরা সাগ ঃ — শীতকালের পর সাধারণত বহাল, কানালি প্রভৃতি
ধানখেতগুলি খুবই ছোট ছোট পাতাযুক্ত সবুজ লতায় মখমলের মত ঢেকে যায়। খেতে জন্মে
বলে এর নাম হল যেমন 'খেত সাগ' তেমনি কাঁথা বা চঁথরা -র মত নরম হওয়ার কারণে এই
শাকটি কাঁথাসাগ বা চেথরা সাগ নামেই কুড়মি মহলে সুপরিচিত। সিদ্ধ করে ভেজে বা খুদি চাল
(ঢেঁকি-কোটা ভাঙ্গা চাল) মিশিয়ে তরকারী করে খাওয়া হয়। সাগটি হল ভেষজ গুণে ভরপুর।
যথা —
(i) Good Source of Vit- A ; দৃষ্টিশক্তি বর্ধক, চর্ম ও মাংস-কোষিকা সংরক্ষক।
(Skin and tissue protector)
(ii) Good Source of Vit - C ; হাড়, দাঁত সুদৃঢ়কারী।
(iii) Good source of iron and R.B.C (Red Blood Cell ) - cum - Haemoglobin improver.
(iv) Source of Lactic Acid ; ক্লান্তি নিবারক ও কর্মক্ষমতাবর্ধক।
(v) Anti - Hepatitis ( পিত্তাশয় রোগ প্রতিরোধক ),
(vi) Anti - Jaundiced ( পাণ্ডুরোগ অর্থাৎ যে রোগে চামড়া ও চোখের সাদা অংশ হলদে হয়ে যায় সেই রোগ সেরে যায় )।
(vii) Anti - Anaemic ( রক্তাল্পতা নিরোধক )।
১১) নুইনা সাগ ঃ — লবণাম্লযুক্ত নরম ছোট লতা বা সাগ রূপে গ্রীষ্মকালে খাওয়া হয়। অত্যন্ত ভেষজ গুণ সম্পন্ন। যথা —
(i) Source of hydrolic minerals (তরল খনিজ রসায়েনর উৎস ),
(ii) Anti - Stone ( পাথরি-রোদক ),
iii) Cleans and washes blood - Circulatory system, kidney and heart.
১২) কানা সাগ ঃ — বর্ষাকালে খামারে ও গৃহপার্শ্ববর্তী জমিতে ছোট ছোট কানের মত পাতা যুক্ত
একপ্রকার সাগ যা হল —
i) Anti - Jaundice ( পাণ্ডুরোগ-নাশক ),
(ii) Source if Iron ; R.B.C (Red Blood Cells) and Haemoglobin producer.
iii) Mucus generator — মুখের লালা, শিকনি বর্ধক।
iv) Anti - Gastritis ;
১৩) জাঁখি ( Green Myrobalan ) খাদ্য খাবার পর ' জাঁখি ' টুকরো (কচি শুখনো হরিতকী টুকরো)
মুখশুদ্ধিরূপে সচরাচর ব্যবহৃত, যার ভেষজ গুণ হল —
(i) Source of Vit - C ; হাড় ও দাঁতের পুষ্টিদায়ক,
(ii) Source of Iron and Blood vigorous (রক্তপরিষ্কারক),
(iii) Source of Vit - E ; প্রজনন ক্ষমতা বর্ধক তথা বন্ধ্যাত্বমোচক,
(iv) Source of Vit - K ; রক্তস্রাব-নিবারক (Anti-haemarrhagic),
(v) Improves immunity power.
১৪) ' ভেলুঅা ' / ভেলা পাকা ও তেল দুইই হল ভেষজ গুণে পরিপূর্ণ ।
(i) Best source of anti-biotic,
(ii) Anti-Tetanus (ধনুষ্টঙ্কার রোধ নিরোধক)
(iii) Anti-Septicamia (রক্তদূষণকারী বিষাক্ত রোগজীবাণু নাশক)।
১৫) আওলা অামলকী ঃ — ভেষজ গুণ হল —
(i) Source of Vit - C,
এছাড়াও অন্যান্য ভেষজ গুণের দিক দিয়ে 'আওলা' হল — 'পালুআ', 'জাঁখি','বাসিভাত', 'ঘোল',
প্রভৃতির মতই গুরুত্বপূর্ণ।
১৬) ঘঁঘি (Snail) ঃ — ভেষজগুণে পরিপূর্ণ। যথা —
(i) Good source of Vit - D, anti-rickety, অপুষ্টি রোগ প্রতিরোধক
(ii) Anti-Biotic (রোগজীবাণু নাশক)
iii) Anti-Virus (অণুবীক্ষণ যন্ত্রপ্রেক্ষণীয় অতি ক্ষুদ্র রোগজীবাণুরোধক)
iv) Anti-T.B. (ক্ষয়রোগ প্রতিরোধক)
v) Improves eye-sight (দৃষ্টিশক্তি বর্ধক)
vi) Source of Iron, Blood-vigarous, improves Haemoglobin,
vii) Source of Iodine
১৭) খাপড়া সাগ ঃ — ঘরের আশেপাশে অনায়াসলব্ধ সাগ। ভেষজগুণ হল —
(i) Anti-Jaundice (চামড়া ও চোখের শ্বেতাংশ হলদে হওয়া রোগ নিরোধক)
(ii) Good source of Iron and Blood vogarous, improve R.B.C.
iii) Anti-Ulcer (দূষিত ক্ষত নিরোধক)
iv) Anti-Cancer (কর্কটরোগ প্রতিরোধক)।
১৮) ` সলন্তি সাগ ঃ —
i) Good source of Iron and maintains Haemoglobin-R.B.C.
১৯) আসাইড়া ফল ঃ — কৃষিজীবী কুড়মি সমাজের লোকেরা প্রতিবৎসর ১৩ ই জৈষ্ঠে প্রতি পরিবারে অনিবার্যভাবে অনুষ্ঠিত 'বহইন' (প্রথম বীজবপন সম্পর্কিত উৎসব) উৎসবের পর রাত্রিতে
আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই অনিবার্যভাবে কষাস্বাদ যুক্ত এই 'অসাইড়া ফল' খেয়ে কিছুটা দুধও পান করেন। এঁদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, রহহনের শুভমুহূর্তে কৃষিদেবতা ফণিভূষণ শিবের অাগমন যেহেতু নিশ্চিতভাবে ঘটে থাকে তাই তাঁর অনুচর ভূত-প্রেতের দলের সঙ্গে সঙ্গে অজস্র বিষধর সাপ,
সরীসৃপ অাদিও শিবের ছায়ার মত নিশ্চয়ই এসে থাকে। অার তাই রাতে-বিরাতে খেতে-মাঠে
সাপে-খোপে দৈবাৎ যদি কামড়ও মারে তাহলেও যাতে কোন ক্ষতি না হয় তার জন্য সবাই
বিষক্রিয়ার প্রতিষেধক রূপে (Anti-dote) ভক্ষণ করে থাকেন। যাই হোক এই ফলটির
ভেষজগুণ হল —
(i) Anti-dote (বিষ-প্রতিরোধক)
(ii) Anti-Biotic (রোগ-জীবাণু-নাশক)
(iii) Anti-Septicaemia (রক্তদূষণ কারী বিষাক্ত রোগজীবাণু নাশক)
(iv) Anti-Tetanus ( ধনুষ্টঙ্কার রোগ প্রতিরোধক)
(v) Anti-Ulcer ( দূষিত ক্ষত নিরোধক )
(vi) Improves outer-body farmation
২০) আমসি ঃ — গ্রীষ্মকালে ঝোল করে খাওয়া হয়। ভেষজ গুণ হল —
(i) Good source of Vit - C. আর তাছাড়া অপরাপর গুণ হল ' আসাইড়া ফল-এর অনুরূপ।
২১) খইড়কাকুচি সাগ ঃ — ভেষজগুেণ সমৃদ্ধ। যথা —
(i) Good source of Iron ; blood-vigarous,
(ii) Controls Haemoglobin and R. B. C.
(iii) Improves mucous ( মুখের লালা আদি বর্ধক ),
(iv) Anti-Ulcer ( দূষিত ক্ষতরোধক),
(v) Anti- Cancer (কর্কট রোগ প্রতিরোধক)
(vi) Anti-gastritis,
(vii) সন্নিপাত-রোধক ( বা বাত - পিত্ত - কফ বিনাশক)।
২২) কচড়া (মহুয়া ফল) ঃ — ভেষজ গুণ হল —
(i) Source of Vit - C,
(ii) Strengthens teeth, by preventing from Diseases,
তাছাড়া অপরাপর ভেষজ গুণ হল ' আসাইরা ফল ও অামসির মতই।
২৩) মহুয়া ফুল ঃ — ভেষজ গুণ হল —
(i) Good source of energy,
(ii)m Controls OSMO-regulatory system অর্থাৎ শারীরিক তরল রসায়নের প্রবাহকে
নিয়ন্ত্রিত করে তথা দূষিত তরল পদার্থকে শোধন করে। কারণ মহুয়া হল মূলতঃ অ্যালকোহলিক গুণ সম্পন্ন।
২৪) বড় পাকা ( Banyan Fruit ) ঃ — বড় (বট) পাকার ভেষজ গুণ হল —
(i) Good source of Iron and maintains Haemoglobin R. B. C.
(ii) Good sourceof Protein.
২৫) জইড় / পিপড় ( Pipal ) পাকা ঃ — ভেষজ গুণ হল বড় পাকার অনুরূপ।
২৬) ডুমুর ( Fig ) ঃ — ভেষজ গুণ হল —
(i) Good source of energy ( শক্তিবর্ধক ),
(ii) Anti-biotic ( রোগ জীবাণু বিনাশক ),
(iii) Anti-Selticaemia ( রক্তদূষণকারী বিষাক্ত জীবাণু নাশক )
(iv) Anti-Virus (অনুবীক্ষণ ষন্ত্রপ্রেক্ষণীর অতিক্ষুদ্র রোগ-জীবাণুনাশক)
২৭) কাছিম মাংস ( Tortoise ) ভেষজ গুণ হল —
(i) Good source of Calcium ( হাড়, দাঁত সুদৃঢ়কারী ),
(ii) Good source of Iodine,
(iii) Anti-Virus.
২৮) শালুক ( কুমুদ ) ঃ — শালুক ' গেঁড়া ' (শালুকের গোলাকার মূল) ও ' ভেঁট বীজ ' শালুক কলের
সরিষার মত বীজ ) দুই-ই হল ভেষজ গুণ সম্পন্ন। যথা —
(i) Good Source of Iodine,
(ii) Good source of Energy,
(iii) Typhoid and fever protector,
(iv) Anti-Virus.
২৯) মুলইন (মৃনাল) ও টাঁইটবীজ ( পদ্মফুলের বীজ ) ঃ —
(i) Good source of Iodine
৩০) তুলসী ঃ — মহৌষধি গুল্ম। তুলসির শিকড় থেকে পাতা, ফুল, ফল সবই ভেষজ গুণে এতই সমৃদ্ধ
যে গ্রামীণ বৈদ্যেরা সর্দি-কাশি থেকে আরম্ভ করে টিবি রোগেরও চিকিৎসার সময় অন্যান্য জরিবুটির
সঙ্গে অনিবার্যভাবে ' তুলসিকে ' ' পইআন ' (Ingrediant ) দিয়ে থাকেন। গাছটির ভেষজ গুণ
হল —
(i) Protects from all diseases.)
(ii) Good source of energy,
(iii) maintains good health and makes the body sturdy.
৩১) ছাতি (Mushroom) ঃ— বর্ষাকালে জঙ্গলে-মাঠে সর্বত্র নানান ধরণের প্রচুর ছাতি পাওয়া যায়। ছাতি ভেষজগুণে হল সমৃদ্ধ। লোকোক্তি অনুসারে বজ্রপাতের শব্দে ছাতি বেশি উঠে। ভেষজগুণ হল —
(i) Good source of Vit - B and Vit - D,
(ii) Good source of Potassium, Copper and Iron.
৩২) ঘোল ( Butter Milk ) ঃ — ঘোল মিশানো গরম ভাত খুবই সুস্বাদু। ঘোলের ভেষজগুণ হল
' বাসিভাত ' এর অনুরূপ।
৩৩) কদঅ ঃ — তৃণজাতীয় শস্য। সরিষার বীজের তুলনায় কিছুটা বড় লালচে দানাদার শিষযুক্ত উদ্ভিদ।
খোসা ছাড়িয়ে লপসির মত রান্না করে ভাতের বদলে পেটভরে খাওয়া যায়। ভেষজগুণ হল —
(i) Good source of Vit - A, Vit - C, Vit - E and Vit - K,
(ii) Good source of energy.
৩৪) গুঁদলি ঃ — ' কদঅ ' জাতীয় শস্যেরই অনুরূপ একধরণের তৃণ জাতীয় শস্য। খাওয়ার পদ্ধতি ও
ভেষজগুণও ' কদঅ ' তুল্য।
৩৫) মড়ুআ ঃ — ' কদঅ ' ও ' গুঁদলি ' জাতীয় শস্য হলেও 'মড়ুআ'-র ' আফর ' (চারা) ডাঙ্গা জমিতে
ধানের মতই রোপণ করতে হয়। খাওয়ার পদ্ধতি হল ' কদঅ ' - গুঁদলির মতই লপসি করে খাওয়া।
তাছাড়া চাপাটির মত পিঠা করেও খাওয়া যায়। ভেষজগুণ হল —
(i) Good source of Vit - A, Vit - C and Vit - D,
(ii) Good source of Calcium.
৩৬) পেঁপে ঃ — পেঁপের ভেষজগুণ হল —
(i) Good source of energy,
(ii) Improves W. B. C. ( White Blood Cells )
৩৭) থানকুনি সাগ ঃ — ভেষজগুণ হল —
(i) Destroyer of hookwarm etc. ( পেটের কৃমি নাশক )
(ii) Anti- Diarrhoea. ( উদরাময় রোধক )
৩৮) হলুদ ঃ — অতিশয় ভেষজগুণ সম্পন্ন যথা —
(i) Anti - Septicaemia ( রক্তদূষণকারী রোগজীবাণুনাশক )
(ii) Anti - Infectious ( সংক্রামক রোধক )
(iii) Blood - Vigour ( রক্ত শোধক )।
আর এইভাবে পরিশেষে বলতে পারা যায় যে, যেহেতু কুড়মিদের বিশ্বাস অনুসারে তাঁদের ঠাকুর-দেবতারাই হলেন জীবনের ভালোমন্দের অধিদেবতা, তাই এই সব ঠাকুর দেবতার পূজা-অর্চনার মাধ্যমেই মহামারী থেকে বাঁচার দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে কুড়মিদের রোগ প্রতিরোধ দৃঢ় দৈহিক গঠন থাকার কারণেই রোগের প্রভাবও কুড়মি সমাজে খুব কম পড়তে দেখা যায়।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, উল্লিখিত ভাবে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবন-যাপন এবং স্বাস্থ্যকর বিচিত্র খাদ্যাভ্যাস ছাড়াও আর একটি এমন কারণ রয়েছে যার প্রভাবে এমন কিছু রোগ সাধারণত শহুরে জীবনে অহরহ দেখা যায় সেগুলি কুড়মি সমাজে নেই বললেই চলে। বাজার-শহরের লোকের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক উত্তেজনা ও অসম্তোষ এতটাই থাকে যে বেশিরভাগ লোককে বি.পি., ডায়াবিটিস, অজীর্ণ,অনিদ্রা প্রভৃতি রোগে ভুগতে দেখা যায়। ফলে, রোগের সংক্রমণও এঁদের শরীরে অনায়াসেই ঘটে থাকে। কিন্তু কুড়মি সমাজের মানুষেরা যেহেতু সহজাতভাবে সাধাসিধা তাই এঁদের মনোভাবও হল প্রতিস্পর্ধাহীন। গাড়ি-বাড়ি, টাকা-কড়ির জন্য এঁদের মনে কোন অসন্তোষও দেখা যায় না বললেই চলে। আর এইভাবে সহজাত সন্তোষের জন্য শরীরও থাকে নিরোগ তথা সংক্রমণরোধক। আর তাই কদাচিৎ সংক্রমণ ঘটলেও তা মড়ক-মহামারীর রূপ নিতে পারে না।