এর মধ্যে আবার একদিন কাকাই কম্পিউটারের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা শুরু করলো। তাতোন একবার বলেছিলো আমি কম্পিউটার চালানো শিখবো তো কম্পিউটারের ইতিহাস জেনে কি করবো।
কাকাই বলল, “তোকে শুধু কম্পিউটার চালানো শেখাবো এ কথা কে বলল, কম্পিউটারটা কি, কোথা থেকে এলো, কি ভাবে কাজ করে, কি কি ধরনের কাজ কম্পিউটার করতে পারে, এসব তোকে জানতে হবে। আর তখনই কম্পিউটার শেখার আসল মজাটা টের পাবি। যাকগে যে কথাটা বলছিলাম আমাদের যেমন পূর্বপুরুষ আছে তেমনি কম্পিউটারেরও আদিপুরুষ আছে। তার নাম হল অ্যাবাকাস। এর জন্মস্থান প্রায় ২০০০ বছর আগের চীন দেশে।

অ্যাবাকাস
তাতোন হঠাৎ বলে উঠল, “আচ্ছা কাকাই তুমি আমাদের সঙ্গে অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে কম্পিউটারের তুলনা করছ কেন? কাকাই বলল, কারণ মানুষের অনেক কিছুর সঙ্গেই কম্পিউটারের মিল আছে। সেটা তুই কম্পিউটার শিখতে শিখতে দেখতে পাবি।
যাই হোক যে’কথা বলছিলাম’ কাকাই আবার বলতে শুরু করলো। আদিম যুগে বা প্রস্তর যুগে তো মানুষের গণনা করার কোন প্রয়ােজনই ছিল না। তখন মানুষের একটাই কাজ ছিল। শিকার করা আর তাকে মেরে খাওয়া। অর্থাৎ ক্ষুধা নিবৃত্তি করা। আস্তে আস্তে মানুষ আগুনের ব্যবহার শিখলো, পাথরের গায়ে ছবি এঁকে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখলো। এভাবেই ক্রমে ক্রমে নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়ােগ করে নানা ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম শিখলো। মানুষ আস্তে আস্তে মাঠে ফসল ফলানো থেকে আরম্ভ করে নানা ধরনের কাজেকর্মে তার নিজস্ব বিচারবুদ্ধি প্রয়ােগ করতে শিখলো। ক্রমে পাথরের গায়ে আঁক কষে সংখ্যা গুণতেও শিখে গেল।

গুহাচিত্রের ছবি
তাতোন কাকাইয়ের কথাগুলো বেশ মন দিয়ে শুনছিলো কিন্তু চোখমুখ দেখে কাকাই বুঝতে পারলো ও কিছু একটা জানতে চাইছে।
কাকাই জিজ্ঞেস করলো— “তুই কিছু প্রশ্ন করবি মনে হচ্ছে।”
তাতোন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো—“আচ্ছা কাকাই বলোতো, তখনকার দিনে। সংখ্যার প্রয়োজনটা কি ছিলো ?”
কাকাই বলল—“ভালো বলেছিস। তবে শোন, ধর একটা মানুষ একদিন অনেকগুলো শিকার করে ফেলল বা চাষ করতে গিয়ে অনেকটা পরিমাণ ফসল ফলিয়ে ফেলল। তখন সে কি করবে ? — না নিজের বিচার বুদ্ধি প্রয়ােগ করে বাড়তি শিকার বা বাড়তি ফসল অন্য একজনকে দিয়ে দেবে। বিনিময়ে তার থেকে অন্য কোন জিনিস নিজে নেবে। এই যে দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারটা এটার জন্যে তো একটা হিসেবের প্রয়োজন এসে যাচ্ছে না ? সেই হিসেবটাই সে পাথরে আঁক কষে মনে রাখতে চেষ্টা করলো। এর থেকেই আস্তে আস্তে সংখ্যার ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিল।
যাইহোক, কম্পিউটারের আদিপুরুষ অ্যাবাকাসের যে কথাটা বলছিলাম। অ্যাবাকাস হলো মানুষের তৈরী প্রথম গণকযন্ত্র। আর তুই শুনলে অবাক হয়ে যাবি’, কাকাই বলল—এই প্রথম আবিষ্কৃত অ্যাবাকাস যন্ত্র এখনও ব্যবহার হয় করা অনেক দেশে।

প্যাসকালাইন
বিশেষত জাপানে। আর আমাদের দেশেও একদম ছোটরা যখন প্রথম গুণতে শেখে তখনও তাদের এরকমই কাঠের গুলি লাগানো স্লেট দেওয়ার রেওয়াজ আছে।
এই অ্যাবাকাসের পরবর্তী পর্যায়ে আবিষ্কৃত হলো নেপিয়ারের রড নামে একধরনের গণক যন্ত্র। ১৬১৭ সাল নাগাদ। এর আবিষ্কর্তা হলেন স্কটল্যান্ডের অঙ্কবিদ জন নেপিয়ার। তারপর এল ১৬৪২ সালে ফরাসী অঙ্কবিদ ব্লেইজ প্যাসকালের আবিষ্কৃত গণক যন্ত্র প্যাসকালাইন। এই যন্ত্রটায় দাঁতওয়ালা হুইল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গণনা করতে হতো। এই যন্ত্রটিকে অনেকে পৃথিবীর প্রথম ক্যালকুলেটারও বলে থাকেন।
এরপর যে নমস্য ব্যক্তির নাম করতে হয় তিনি হলেন ফরাসী নাগরিক কিন্তু ইংরেজ অঙ্কবিদ চার্লস ব্যাবেজ। ১৮৩৩-৩৪ সাল নাগাদ ব্যাবেজ বাষ্পচালিত এক যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন যার নাম দেন অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন। এই যন্ত্র আবিষ্কারের জন্য চার্লস ব্যাবেজের নামকরণ হয় ‘কম্পিউটার জনক’ বলে।

চার্লস ব্যাবেজের এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের সময় তার সহকারী বা সাহায্যকারী হিসাবে কাজ করেছিলেন লেডি অ্যাডা আগুস্টা নামে এক মহিলা। ইনি চার্লস ব্যাবেজের মেশিনের প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করেছিলেন বলে অনেকে এনাকেই প্রথম প্রোগ্রামার বলে অভিহিত করে থাকেন।

এই অ্যাডা আগুস্টার আরও একটা পরিচয় আছে। সেটা হল ইনি প্রখ্যাত ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের মেয়ে। তা এই হল কম্পিউটার সৃষ্টির আদিপর্ব। এর পরের পর্ব শুরু হল পাঞ্চ কার্ড মেসিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। হারম্যান হলিরিথ নামে একজন আমেরিকান পরিসংখ্যানবিদ ওদেশের লোকগণনা বিভাগে কাজ করতেন। সেটা ১৮৮০ সাল নাগাদ।। তখনকার সময় যে পদ্ধতিতে লোকগণনা করা হতো তাতে প্রচুর সময় লাগতো। তখন হলিরিথ ট্যাবুলেটিং মেসিন নামে এক যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। এর ফলে কত সময় বাঁচল জানিস? কাকাই জিজ্ঞেস করলো তাতোনকে। তাতোন জিজ্ঞেস করলো ‘কত?’ কাকাই বলল, “আট বছরে যে কাজটা শেষ হতো, সেটা এই যন্ত্রের সাহায্যে দুই বছরের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হলো। আর এই পাঞ্চ কার্ড মেসিন এখনও ব্যবহৃত হয় অনেক দেশেই।”

হারম্যান হলিরিথ
তাতোন অবাক হয়ে কাকাইকে বলল, কম্পিউটারের ইতিহাসটাও তো বেশ ইন্টারেস্টিং মানে আকর্ষণীয়।
‘এরপর ১৯৪১ সাল নাগাদ হাভার্ড ইউনিভারসিটির এক অধ্যাপক হাওয়ার্ড আইকেন, আই বি এম নামে (IBM) এক কোম্পানির সহযোগিতায় প্রথম বেশ বড় আকারের কম্পিউটার মেসিন তৈরী করলেন। আর তার নাম রাখলেন হাভার্ড মার্ক ওয়ান। এখানে একটা কথা বলে রাখি’, কাকাই বলল ‘এই আই বি এম (IBM) কোম্পানিটির পুরো নাম হল ইন্টারন্যাশানাল বিজনেস মেসিনস্ করপোরেশন। এই কোম্পানিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হলেন হারম্যান হলিরিথ। আর এই কোম্পানির সম্বন্ধে এতো কিছু বলার কারণ হচ্ছে, এখনও পর্যন্ত এই IBM কোম্পানিটি কম্পিউটার জগতের অন্যতম বৃহৎ কোম্পানি।

যাক যে কথা বলেছিলাম, হাওয়ার্ড আইকেন আবিষ্কৃত প্রথম কম্পিউটার মেশিনটি হলো ইলেকট্রোমেকানিক্যাল। অর্থাৎ এখনকার মতো ইলেকট্রনিক্স বা আগেকার মতো ম্যানুয়াল বা হাতে করে চালানোর মতো নয়। এটির ক্ষমতা ছিল প্রতি সেকেন্ডে তিনটে যোগ, একটা বিয়ােগ বা একটা গুণ করা। ধীরে ধীরে এই যন্ত্রের আরও উন্নত সংস্করণ বের করার চেষ্টা চলতে লাগলো। ১৯৪৩ সালের শেষাশেষি নাগাদ এর যে উন্নত সংস্করণ বের করা গেল সেটার ক্ষমতা হল প্রতি সেকেন্ডে ৫০০০ টা যোগ বিয়োগ, ৩৫০টা গুণ এবং ৫০টা ভাগ করা। কিন্তু এর আকার ছিল অনেক বড়। এছাড়া এই ধরণের কম্পিউটার মেশিনটি নিয়ন্ত্রিত হত হাজার হাজার ভালবের সাহায্যে। যার ফলে প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হত এবং অত্যাধিক উত্তপ্ত হয়ে মাঝে মাঝেই বিগড়ে যেত।

জন ভন নিউম্যান
আস্তে আস্তে চেষ্টা চলতে লাগলো এর আকার কমানো এবং ক্ষমতা বাড়ানো ও সেই সঙ্গে কাজের দ্রুততা বাড়ানোর। সে সবই ধীরে ধীরে করা সম্ভব হলো। কিন্তু শুধুমাত্র যোগ বিয়োগের জন্যই যে কম্পিউটার নয় সেটা দেখালেন জন ভন নিউম্যান। ১৯৪৯ সালে তিনি কম্পিউটারে প্রোগ্রাম সংরক্ষণ বা Programe Store করে দেখালেন। আর এটাই হলো আধুনিক কম্পিউটারের প্রথম পদক্ষেপ। যে যন্ত্রাংশটির জন্য এই নতুন ব্যবস্থা অর্থাৎ তথ্য সংরক্ষণ করা এবং অন্যান্য অসুবিধা দূর করা সম্ভব হল সেটির নাম হল ট্রানজিস্টার। এই ট্রানজিস্টারের সাহায্যে অনেক কম বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়ােগে, অনেক কম জায়গায়, অত্যন্ত অল্প খরচে এবং সর্বোপরি অনেক নির্ভরযোগ্য ভাবে ভালবের কাজগুলি করা সম্ভবপর হল। অর্থাৎ ট্রানজিস্টারের আবিষ্কার কম্পিউটার তথা সমগ্র ইলেকট্রনিক্স জগতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হল। আর এজন্য যাঁদের নাম করতে হয় তাঁরা হলেন তিনজন আমেরিকান বিজ্ঞানী— ‘বারডীন (Bardeen) ব্রাটেইন (Brattain) এবং শ্যকলে (Shockley) ১৯৪৮ সালে এই তিন বিজ্ঞানীর আবিষ্কারই ইলেকট্রনিক্স জগতের একটা নতুন দিক খুলে দিল। এ প্রসঙ্গে আর একজন আমেরিকান বিজ্ঞানীর নাম করতে হয়। তিনি হলেন জ্যাক কিলবি (Jack Kilby)। ইনি প্রথম দেখালেন একসঙ্গে একাধিক ট্রানজিস্টরকে একটি সিলিকন পাতের ওপর বসিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ ঘটানো সম্ভব। যার ফলস্বরূপ দুই বা ততোধিক ভিন্নধর্মী ট্রানজিস্টারকে একটি সিলিকন পাতের উপর বসিয়ে একই বিদ্যুৎ প্রবাহের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে নেওয়া সম্ভবপর হল। এই পুরো ব্যবস্থাটিকে বলে ইন্টিগ্রেটেড সারকিট! অনেকে আবার একে সিলিকন চিপ বা শুধু চিপও বলে থাকে। ‘এবার কি হল জানিস’- কাকাই বলল তাতোনকে, তাতোন তো হাঁ করে গিলছিল কাকাইয়ের কথাগুলো, বলল “কি হল ?”

‘বারডীন (Bardeen) ব্রাটেইন (Brattain) এবং শ্যকলে (Shockley)
কাকাই বলল, “আমেরিকার সরকার বাহাদূর এই সময়ে মহাকাশ গবেষণা নিয়ে খুব মেতে ছিল। তাঁরা এই ইন্টিগ্রেটেড সারকিটের মধ্যে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পেল আর এর জন্য গবেষণার কাজে শুধু টাকা পয়সাই নয় ক্যালিফোর্নিয়ায় একটা বিশাল এলাকাও বরাদ্দ করল। জায়গাটার নাম হল ‘সান্টা ক্লারা ভ্যালি’ সেটা পরবর্তী কালে সিলিকন ভ্যালি নামে পরিচিত হল।
যাইহোক, এর ফলও পাওয়া গেল হাতে হাতে। এই সিলিকন চিপ ইলেকট্রনিক্স জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এল। শীঘ্রই একটি চিপের ওপরেই হাজার হাজার ট্রানজিস্টরের কাজ করা সম্ভব হল এবং অবশ্যই ট্রানজিস্টারগুলির কাজও হল ভিন্নধর্মী। ফলস্বরূপ ১৯৭১ সাল নাগাদ আমরা পেলাম এমন একটি স্বতন্ত্র চিপ, যার নাম ‘মাইক্রোপ্রসেসর’। এর কথা পরে বলব।
তা এই হল কম্পিউটারের মোটামুটি ইতিহাস বা ঠিকুজী যাই বলিস না কেন, বলে কাকাই বলল, এবার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তোকে করতে হবে, তাতোন খুব সিরিয়াস হয়ে বলল, “কি কাজ ? কাকাই বলল, এখুনি এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। গলাটা খুব শুকিয়ে গেছে এতক্ষণ বকবক করে। তাতোন ওহ ! শিওর’ বলে এক দৌড় লাগাল।