যাইহোক, দিন সাতেকের মধ্যে কাকাই তাতোনকে যেটুকু শেখাল সেটা হল, কম্পিউটার কোনও দৈত্যদানব বা ম্যাজিক বক্স নয়। আবার কম্পিউটার পারে না এমন কাজ খুব কমই আছে। তা বলে ভেবোনা তোমার দিদির বিয়েতে রান্না অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে আর কম্পিউটার সেটা খেয়ে নেবে বা তোমার এবারের ইংরেজির ফলটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে আর কম্পিউটার নম্বরটা বাড়িয়ে দেবে। এধরনের কাজ কম্পিউটার পারবে না। কম্পিউটার বাজনা বাজাতে পারে, ছবি আকঁতে পারে, অঙ্ক কষতে পারে, তা সে যতই জটিল হোক না কেন। খেলতে যে পারে সেটা তো দেখাই গেল—তবে দৌড় ঝাঁপ করে নয়। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল কম্পিউটার এতসব কাজ করতে পারে তাতে তার সময় লাগে কত জানিস ? কাকাই বলল মুহূর্ত বলতে আমরা যা বুঝি তার হাজার হাজার ভাগেরও কম সময়ে। আসলে কম্পিউটার হল একজন আজ্ঞাবাহী চাকর। তাকে বলতে হবে তুমি এই কাজটা কর আর সে মুহূর্তের মধ্যে করে দেবে। তবে এতসব কাজ কম্পিউটার করবে কিন্তু নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে নয়। কারণ ওর তো নিজস্ব কোনও বুদ্ধিই নেই। এই এতো সব কাজ ওকে আগে থাকতে শিখিয়ে রাখতে হবে। আর যে পদ্ধতিতে শেখাতে হবে তাকে বলে প্রোগ্রামিং করা। এখন কম্পিউটারের সঙ্গে তুমি কথা বলবে কি করে। ও তো আর আমাদের মতো দুটো করে কান নিয়ে বসে নেই। ওর যা আছে সেটা হল অনেকগুলি বোতামওলা একটা কী বোর্ড (Key Board)।

কী বোর্ড
ওর কান হল ওই বোতামগুলি, ওই এক একটা বোতাম হল এক একটা কান। এক একটা কান এক একটা নির্দেশ শুনছে আর সঙ্গে সঙ্গে পালন করছে। তা বলে তুমি যদি ভুল নির্দেশ দাও তাহলে কম্পিউটার কাজটাতো করবেই না, উল্টে তোমাকে বলবে, যে তোমার নির্দেশে ভুল আছে। আসলে কম্পিউটারকে আগে থেকে যা শেখান আছে তার বাইরে গেলেই বলবে তোমার নির্দেশে ভুল আছে। এখন কথা হল কম্পিউটার কথা বলবে কি করে? ওর তো আমাদের মতো মুখ নেই। কম্পিউটারের মুখ হল ওই টিভির মতো পদার্টা। ওটাকে বলে মনিটর (Monitor)। ওখানে লেখার মাধ্যমে জানিয়ে দেবে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর। এছাড়া আর একটা যন্ত্র আছে অনেকটা মুণ্ডু ছাড়া ইঁদুরের ধড়ের মতো। এর পিঠে হাত রেখে কাজ করতে হয়। এর নাম মাউস (Mouse)। এর কাজও ওই কান অর্থাৎ বোতামের মতো নির্দেশ গ্রহণ করা, কিন্তু তাতেনের একটা কথা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না, যে যন্ত্রটা শেখানো নির্দেশগুলো এতো সহজেই বুঝে নিয়ে নিয়ে উত্তরগুলো চটপট জানিয়ে দেয়, তা এর মগজটা কোনটা ? আমরা তো জানি আমাদের যে কোনও অনুভূতি, প্রশ্ন, ইচ্ছে, অনিচ্ছের কথা সব সময় প্রথমে মগজে যায়। এইবার মগজ সেই অনুভূতির কথা শুনে সেইমত শরীরের বিভিন্ন অংশে নির্দেশ পাঠায় কি করতে হবে। আর আমরা সেইমত কাজ করি।

কম্পিউটারের বেলায় এই মগজের কাজটা কে করছে? কথাটা কাকাইকে বলতেই কাকাই দেখাল যে মনিটার (Monitor) আর কী বোর্ড (Key Board) -এর মাঝে সংযোগকারী একটা বাক্সের মতো অংশ আছে। ওটাকে বলে কেন্দ্রীয় বিশ্লেষণ কেন্দ্র (Central Processing Unit) বা CPU। এই CPU-ই হল কম্পিউটারের মগজ। এই CPU-র আকৃতি বিভিন্ন কম্পিউটারের বিভিন্ন রকম হলেও প্রধান কাজগুলি মোটামুটি একই পদ্ধতিতে হয়ে। থাকে। যেমন CPU-র প্রধানতঃ তিনটি অংশ বা ভাগ আছে। এক—অ্যারিথমেটিক লজিক ইউনিট সংক্ষেপে অ্যালু (ALU), দুই-রেজিষ্টার আর তিন হল কন্ট্রোল ইউনিট (Control Unit)। আর যে ব্যবস্থার মাধ্যমে এক অংশ থেকে অপর অংশে তথ্য পাঠানো হচ্ছে বা যাচ্ছে তাকে বলে বাস (Bus)। অ্যালু (ALU)-র কাজ হল ইনপুট অংশের বা কী বোর্ডের মাধ্যমে যে সব তথ্য আসছে তাদের বোঝা এবং যুক্তি গ্রাহ্য উত্তর তৈরি করা। রেজিষ্টার হল CPU এর মেমরি বা স্মৃতি ভান্ডার। এখানে বিভিন্ন রকম তথ্য বা নির্দেশ সংরক্ষণ করা থাকে এবং নতুন তথ্যও ইনপুট অংশের মাধ্যমে এখানে পাঠানো হয়। আর বাকী অংশ হল কন্ট্রোল ইউনিট (Control Unit) বা নিয়ন্ত্রক অংশ। এই অংশের কাজ হলো কম্পিউটারে পাঠানো নির্দেশাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করে ফলাফল আউটপুট অংশে বা মনিটরে পাঠানো। এর জন্য এই নিয়ন্ত্রক অংশ কখনও কোন তথ্য মেমরি অংশে পাঠায় বা কখনও মেমরি থেকে তথ্য বা নিদের্শ গ্রহণ করে অ্যালুতে পাঠায় এবং নির্দেশ মতো কাজ করে সিদ্ধান্ত বা ফলাফল প্রয়োজন মতো স্মৃতি অংশে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে রাখে অথবা সরাসরি আউটপুট বিভাগে ফলাফল প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দেয়। এবার এই সংযোগকারি বাক্সের সঙ্গে যুক্ত টিভির মতো দেখতে মনিটর (Monitor) -এ ওই ফলাফল লেখার মাধ্যমে ফুটে ওঠে। CPU -র মধ্যে বিভিন্ন অংশগুলি হল মাইক্রোচিপ নামক খুব ছোট ছোট ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ। কাকাই তাতোনকে বলল, খুব ছোট মানে কি জানিস, ধর তোর আঙুলের নখের মতো সাইজ। এর মধ্যে কয়েক লক্ষ ট্রানজিস্টার বসানো থাকে একটা সিলিকন পাতের উপর যার কথা তোকে আগেই বলেছি। তাতোন যত শুনছে তত অবাক হচ্ছে আর আগ্রহ বাড়ছে কম্পিউটারের ওপর সেটা ওর মুখ চোখ দেখেই কাকাই বুঝতে পেরেছে। কাকাই তাতোনকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, এর মধ্যে একটা কথা আছে, আমরা এতক্ষণ কম্পিউটারকে যে নির্দেশ দিলাম অর্থাৎ কম্পিউটারকে যে প্রশ্ন করলাম কম্পিউটার তার ঠিকঠাক উত্তর দিয়ে গেল কি করে, পৃথিবীতে তো কয়েকশো কোটি লোক আছে। যে কেউ এসে প্রশ্ন করলেই কি কম্পিউটার ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারবে? না তা কখনও পারবে না। কারণ কম্পিউটার তো আর জ্যোতিষী নয় যে সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিতে পারবে। তাতোন অমনি ফুট কাটল, ‘জ্যোতিষীরা তাই পারে বুঝি? কাকাই বলল, না তারা কখনই বলতে পারে না কিন্তু বলতে চেষ্টা করে, অন্তত পারব না বলে না। কিন্তু কম্পিউটার কখনই তা বলবে না। তাতোন বলল, তাহলে এই কম্পিউটারটা আমার সম্বন্ধে এত কিছু বলল কি করে? অনেকদিন আমাদের বাড়িতে আছে বলে ? কাকাই বলল, না তাও নয়। আসলে আমি আগে থেকে তোর সম্বন্ধে কিছু তথ্য কম্পিউটারকে দিয়ে রেখেছিলাম। আর কম্পিউটার সেই তথ্যটা ওর স্মৃতি ভাণ্ডারে অর্থাৎ মেমরিতে মজুত রেখে দিয়েছিল। এই তথ্য যে দেওয়া হল এটাকে বলে DATA INPUT! এবার যদি আমি কিছু ভুল তথ্য দিতাম তবে কম্পিউটারের দেওয়া উত্তরও ভুল হতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে কম্পিউটার কিন্তু কখনই বলবে না যে তুমি ভুল প্রশ্ন করেছ। তাই আমার দেওয়া তথ্যগুলি সঠিক হওয়া দরকার। কাকাই এরপর তাতোনকে জিজ্ঞেস করলো, কম্পিউটারের মগজের ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিস? তাতোন বলল, “বুঝেছি, কিন্তু একটা কথা বলার আছে।” কাকাই বলল, “কি কথা বল্।” তাতোন বলল, “তুমি একবার বলছ আগেই কিছু নির্দেশ কম্পিউটারকে দিয়ে রেখেছ। সেটা কম্পিউটার তার স্মৃতি ভাণ্ডারে জমা রেখে দিয়েছে। এখন আবার যে প্রশ্নগুলো করছ সেগুলো কি তাহলে সেই স্মৃতি ভাণ্ডারেই গিয়ে জমা হচ্ছে?” কাকাই বলল, “আসল ব্যাপারটা হল কি জানিস কম্পিউটারের মগজে দু রকমের স্মৃতি ভাণ্ডার বা Memory আছে। একটাকে বলে (ROM) রম। পুরো কথাটা হল Read Only Memory. এর কাজ হল কম্পিউটার কিভাবে কাজ করবে তার স্থায়ী নিদের্শ জমা রাখা। এর কোন রকম পরিবর্তন করা যায় না বা এর ওপরে নতুন কোন নির্দেশ লেখাও যাবে না।
আর এক ধরনের Memory বা স্মৃতি ভাণ্ডার হল রাম (RAM)। এর পুরো কথাটা হল Random Access Memory৷ ইনপুট সিষ্টেমের মাধ্যমে পাওয়া সমস্ত নির্দেশ এখানে জমা হবে, আর রম (ROM), অ্যালুর (ALU), ও কন্ট্রোল ইউনিটের (Control Unit) সাহায্য নিয়ে ফলাফল আউটপুট বা মনিটরের মাধ্যমে প্রকাশ করবে। এই র¨ামে (RAM) যে সব নির্দেশ জমা হয় সে সবই কম্পিউটার বন্ধ করা হলেই মুছে যাবে।” কাকাই বলল, ‘ধর, তুই একটা প্রশ্ন করলি আর কম্পিউটার একটা উত্তর দিল। এবার আর একজন আর একটা প্রশ্ন করল কম্পিউটার তারও উত্তর দিল। এইগুলি সব (RAM) র¨ামে যাবে আর কোন প্রশ্নের কি উত্তর হবে, কি পদ্ধতিতে সেই উত্তর দেওয়া হবে এইসব নির্দেশ যেটা আগেই দেওয়া আছে— সেগুলি সব রম (ROM) বা মুছে যায় না এমন কোন মেমরিতে জমা থাকবে।

স্মৃতি ভাণ্ডার হল রাম (RAM)
তাতোন বলল, “আচ্ছা কম্পিউটার কি ইংরেজি ভাষা বোঝে? কাকাই বলল, এরা মানুষের কোনও ভাষাই বোঝে না। এরা খালি বোঝে বৈদ্যুতিক সংযোগ। অর্থাৎ সুইচ অফ আর সুইচ অন। তোকে যে ট্রানজিস্টারের কথা বলেছিলাম সেই ট্রানজিস্টারগুলি সুইচের কাজ করে একবার বিদ্যুৎ চালু করে আর একবার বন্ধ করে। বিদ্যুৎ মানেই ইলেকট্রনের প্রবাহ। আর এই প্রবাহের আরম্ভ আর থামার পর্যায়ক্রমিক সংকেতে চলে ইলেকট্রনিক কম্পিউটার। আর এতসব কাজ হয় অবিশ্বাস্য গতিতে। তাতোন কাকাইকে বলে উঠল, একটা কথা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না—সেটা হল তুমি কম্পিউটারকে নির্দেশ দিলে ইংরেজিতে আর কম্পিউটার উত্তরও দিচ্ছে ইংরেজিতে তাহলে তুমি কি করে বললে কম্পিউটার ইংরেজি বোঝে না। কাকাই বলল, ‘ভাল প্রশ্ন করেছিস। আমরা কম্পিউটার বলতে সাধারণত ডিজিটাল কম্পিউটার বুঝি, যে শুধু অঙ্কের ভাষাই বোঝে। আর সে ভাষায় মাত্র দুটি অঙ্ক = 0 আর 1। বিদ্যুৎ বন্ধ থাকা অবস্থায় শূন্য (0) আর চললে এক (1)। যাবতীয় সংখ্যাকে তাই 0 এবং 1 -এর হিসাবে অনুবাদ করে নেয় কম্পিউটার। একে বলে বাইনারি সিস্টেম বা দ্বিসাংখ্যিক পদ্ধতি। অক্ষরের ভাষায় কম্পিউটারকে নির্দেশ পাঠালে কম্পিউটার তাকে অঙ্কের ভাষায় বদলে নেয়।

কিন্তু কাকাই এটা কি করে সম্ভব, তাতোন বলে উঠল—“ইংরাজীতে A থেকে Z অবধি মোট 26 টা অক্ষর আছে। 0 থেকে 9 মোট 10 টা সংখ্যা আছে। এছাড়াও আছে কমা (,) ফুলস্টপ (.) সেমিকোলন (;) ইত্যাদি। এছাড়াও তো অনেক চিহ্ন আছে। কিন্তু দুটো মাত্র সংখ্যা 0 আর 1 দিয়ে এতো কিছু কি করে কম্পিউটারের ভাষায় বদলে যাবে।” তাতোন কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করে বসলো। কাকাই মুচকি মুচকি হেসে বলল, “যায় যায়, কি করে জানতে চাস্ ? তাহলে আগে এক কাজ কর, এককাপ কফির ব্যবস্থা কর।”