সাত : স্কুলে কম্পিউটার প্রদর্শনীর

তাতোনের কম্পিউটার শেখার কথা জানতে আর কারোর বাকি নেই। বিশেষ করে ওর স্কুলে। একে তো তাতোনের স্কুলের সবারই কম্পিউটার সম্বন্ধে একটা ভয়মিশ্রিত ধারণা আছে যে বিশাল বুদ্ধিমান বা পণ্ডিত না হলে কম্পিউটার শেখা সম্ভব নয়। তার ওপর তাতোনের মত একজন সাধারণ ছেলে কম্পিউটারের মতো একটা ভজকট ব্যাপার শিখেছে, এটা ওদের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। তাই তাতেনের অঙ্ক স্যার আর হেডস্যারের অনুরোধে কাকাইকে রাজী করানো গেছে। আজ তাতেনের স্কুলে কাকাই কম্পিউটার নিয়ে একটা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে। কাকাই নিজের কম্পিউটারটা নিয়ে স্কুলের ছুটির পর কম্পিউটার সম্বন্ধে আলোচনা করবে। অর্থাৎ কম্পিউটার ‘কি? কিভাবে কাজ করে? কি কি ধরনের কাজ করে?—এই সব। কাকাইয়ের বক্তব্যটা ছিল এইরকম-কম্পিউটার হলো মানুষের আবিষ্কৃত একটা যন্ত্র। একে কিভাবে কাজ করতে হবে বলে দিলে আর সেই সঙ্গে তথ্যাদি দিয়ে দিলে সেই কাজটা মুহূর্তের মধ্যে নিখুঁতভাবে করে দেবে। এখন কথা হলো কি কি কাজ কম্পিউটার করতে পারে। এর চেয়ে বলা ভালো কম্পিউটার কি কি কাজ করতে পারে না। একটা মানুষকে কাজ দিলে সে অনেক কিছুই করতে পারে। মানুষের মতো কম্পিউটারকে মানুষ শিখিয়ে দিলে কম্পিউটারও মানুষের মতো প্রায় সব কাজই করতে পারে। খালি পারে না মানুষের মতো ফাঁকি দিতে। আর সময় নষ্ট করতে, পারে সময় বাঁচাতে। কম্পিউটারকে কি কাজ করতে হবে সেই নির্দেশ দেওয়া আর কি ভাবে কাজটা সম্পন্ন করতে হবে। সেই পদ্ধতিটা কম্পিউটারকে আগে থেকে জানিয়ে রাখা—এই দুটোই প্রধান কাজ। কম্পিউটারকে নির্দেশ দেওয়ার কাজটাকে বলে ইনপুট করা। এটা করা হয় সাধারণত কীবোর্ডে বা মাউসের মাধ্যমে, এই কথা বলে তাতোনের কাকাই কীবোর্ড আর মাউসের চেহারাটা স্কুলের বন্ধুদের দেখালো। এখন নিদের্শ পাওয়ার পর কম্পিউটার এটা CPU অর্থাৎ মাঝের এই অংশের মাধ্যমে কাজটা সম্পন্ন করলো। মাঝের এই অংশের ভিতরে আছে আবার তিনটে ইউনিট বা ভাগ। প্রথম হল রেজিষ্টার বা মেমরি ইউনিট, দ্বিতীয় হল অ্যারিথমেটিক ও লজিক ইউনিট, আর তৃতীয় অংশ হল কন্ট্রোল ইউনিট। এই তিনটে ইউনিট সম্মিলিত ভাবে আগে থেকে দেওয়া নির্দেশ বা পদ্ধতি অনুযায়ী কাজটা সম্পন্ন করে পাশে এই মনিটরের মাধ্যমে ফলাফল বা আউটপুট জানিয়ে দেবে। এই যে CPU অংশ যেখানে কাজটা সম্পন্ন হচ্ছে এটাই হল কম্পিউটারের প্রাণ বা মস্তিক যাই বলো না কেন। আর এই সকটা যন্ত্র মিলিয়ে তৈরী হলো কম্পিউটার সিস্টেম। এই যে কম্পিউটার সিস্টেম যাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ছুঁতে পারছি এই অংশগুলি হল কম্পিউটার হার্ডওয়্যার। এরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে কেবল বা তারের মাধ্যমে যুক্ত৷ এখন কম্পিউটারে কাজও যেমন বিভিন্ন ধরণের হয় ঠিক তেমনি বিভিন্ন কাজে নিদের্শও হয় বিভিন্ন ধরণের। যেমন ধর, ‘কাকাই বলল’, তোমাদের দুটো সংখ্যা 12 আর 24 দিয়ে একবার বললাম এই দুটো সংখ্যাকে গুণ করো। তোমরা কি করবে, তোমারে আগে থেকে জানা গুণ করার পদ্ধতি অনুযায়ী সংখ্যা দুটি গুণ করে গুণফল লিখবে। আবার যদি ঐ দুটি সংখ্যাকে ভাগ করতে বলি, তবে সংখ্যা দুটি ভাগ করে ভাগফল লিখবে। এখন কথা হল গুণ করার বা ভাগ করার পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা যেটা তোমাদের আগেই জানা আছে। এখন আমি তোমাদের তথ্য দিলাম দুটো সংখ্যা এখানে 12 আর 24। এই যে তথ্যটা আর আগে থেকে শেখানো পদ্ধতিটা যেটা তোমাদের আগেই দেওয়া আছে—এটাকেই আমরা বলবো সফট‍্ওয়্যার। যেটাকে হার্ডওয়্যারের মতো দেখা যাচ্ছে না বা ছোঁয়া যাচ্ছে না।

কম্পিউটারের সঙ্গে মানুষের কাজ করার এখন অবধি কোন ফারাক আমরা পেলাম। না। তাহলে কথা হলো আমরা শুধু শুধু কেন কম্পিউটার ব্যবহার করব? আর এখানেই কম্পিউটার শেখার বা ব্যবহার করার আসল কারণটা লুকিয়ে আছে। ধর ওপরের গুণ বা ভাগটা করতে খুব সাধারণ একটা ছেলেরও এক মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। কিন্তু কম্পিউটার এই গুণ বা ভাগটা করবে এক সেকেন্ডেরও হাজার হাজার ভাগেরও কম সময়ে। আর যদি এর চেয়ে একশো গুণ বড় শক্ত কোন গুণ বা ভাগ হয় তাহলেও প্রায় ঐ সময়েই কম্পিউটার অঙ্কটা করে দেবে। শুধু তাই নয় অঙ্কটা কষবে নির্ভুল ভাবে। কিন্তু মানুষ হলে সে হয়তো একবার কান চুলকোবে, একবার পেন্সিল কামড়াবে, হয়তো একসময় শেষও করবে, কিন্তু উত্তরটা হয়তো দেখা যাবে ভুল। 
 অঙ্কটা একটা উদাহরণ মাত্র। কম্পিউটার এর চাইতে অনেক জটিল কাজকর্ম অসম্ভব দ্রুততায় শেষ করে দেয় নির্ভুল ভাবে। অনেক সময় একসঙ্গে অনেক লোকের কাজ একটা কম্পিউটার করে দেয়।
এখন কথা হল বিজ্ঞানের এই অসাধারণ আবিষ্কারকে যদি আমরা কাজেই না লাগাই শুধু ভয় পেয়ে একে এড়িয়ে যাই তাহলে আমাদের সম্বন্ধে একটা কথাই বলা যায়, সেটা হলো নির্বোধ, সোজা বাংলায় বোকা। আজকের যুগে যেমন সাক্ষর হওয়ার মধ্যে কৃতিত্বের কিছু নেই কিন্তু নিরক্ষর হওয়াটা লজ্জার। ঠিক তেমনি আর কিছুদিন পর কম্পিউটার সম্বন্ধে এই কথাটিই বলতে হবে। ‘তবে আমি বলছি না’, কাকাই বললো, “যে আমাদের দেশে অনেক হতদরিদ্র মানুষ আছে যাদের দুবেলা খাওয়া জোটে না, তাদেরও কম্পিউটার স্বাক্ষর হতে হবে। তবে তোমাদের মতো যারা স্কুলে পড়, তাদের অবশ্যই কম্পিউটার সম্বন্ধে ন্যূনতম জ্ঞান অর্জন করতে হবে আর সেটা শুধু বই পড়ে নয় হাতে কলমে। আর আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় এর জন্য সরকার বা আর কারোর উপর নির্ভর করার দরকার নেই। আমরা নিজেরা উদ্যোগী হলে যে কোন স্কুলেই এটা করা সম্ভব। কারণ এখন আর কম্পিউটার মানেই বিশাল অঙ্কের টাকার প্রয়োজন তা নয়। প্রয়োজন সদিচ্ছার, শেখার আর শেখানোর আগ্রহ।
 কাকাইকে স্কুলের আজকের এই অনুষ্ঠানে আনতে পারার জন্যই হোক আর স্কুলের অন্যান্য ছাত্রদের তুলনায় এই একটা ব্যাপারে এগিয়ে থাকার জন্যই হোক, তাতোনের আজ কাকাইয়েরই পাশে হেডস্যার এবং অন্যান্য স্যারদের সঙ্গে একটা চেয়ারে বসার সৌভাগ্য হয়েছে। এজন্য কিছুটা যে গর্ব তাতোনের হচ্ছে না তা নয়। তার ওপর কাকাইয়ের কম্পিউটার মেশিন দেখানোর সাথে সাথে বলা কথা গুলো শুনতে শুনতে বেশ একটা রোমাঞ্চ অনুভব করছে তাতোন।
কাকাই আরও বলে চলেছে। তোমরা আজ যারা এখানে উপস্থিত হয়েছ তাদের মধ্যে অনেকেই হয়ত বিজ্ঞানের এই নতুন আবিষ্কৃত যন্ত্রটার মজা দেখতে এসেছো। 
কিন্তু কম্পিউটারকে নিছক মজার যন্ত্র ভাবলে কিন্তু খুব ভুল করবে। মাত্র কয়েক 
বছরের মধ্যে তোমাদের এই মজার যন্ত্রটি আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে বা ফেলছে তার আঁচ তোমরা কেউই চাইলেও এড়াতে পারবে না। 
প্রথম ব্যবহারিক কম্পিউটার তৈরী হয়েছিল ১৯৪১ সালে। তখন থেকে এর অগ্রগতি অপ্রতিহত। বর্তমানে এর উপযোগিতা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সবক্ষেত্রেই স্বীকৃত। কি ব্যবসায়, কি বৈজ্ঞানিক, বা কারিগরী গবেষণায়, কি শিল্পে, কি শিক্ষা ব্যবস্থায়, কি হাসপাতালে রোগনির্ণয়ে, কি খেলাধূলায়, বিনোদনে, আইন আদালতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে, আবার ছবি আঁকায়, সঙ্গীতের সুর সৃষ্টিতে, সব জায়গাতেই এই কম্পিউটারের প্রবেশ ঘটেছে। এমন কি প্রকৃতির যে অপার রহস্য এখনও পর্যন্ত মানুষের করায়ত্ত হয়নি সেখানেও এই কম্পিউটার চেষ্টা করে চলেছে রহস্য উন্মােচনের। অন্তত এখনও অবধি অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস নিখুঁত ভাবে দেওয়া সম্ভবপর হচ্ছে এই কম্পিউটারের জন্যই। সবচেয়ে বড় কথা কম্পিউটার আজ গোটা পৃথিবীটাকেই অনেক ছোট করে ফেলেছে যোগযোগ ব্যবস্থার অসাধারণ উন্নতির ফলে। 
কম্পিউটারের এত সব কারিকুরি সবইতো মানুষের শেখানো অর্থাৎ মানুষকে আগে শিখতে হয়েছে এবং সেটা কম্পিউটারকে শেখাতে হয়েছে। তবেই না কম্পিউটার বিষয়গুলি আরও দ্রুততায় সঙ্গে, আরও নিখুঁত ভাবে, আরও বিস্তৃতভাবে সমাধান করতে পারছে। ‘তাই বলছিলাম’, কাকাই বললো, “তোমরা স্কুলের আর পাঁচটা বিষয় যেমন শিখছ জানছো ঠিক সেইভাবেই কম্পিউটারকেও জানতে বুঝতে চেষ্টা করে যাও। দেখবে কম্পিউটার সহজভাবে বুঝতে চেষ্টা করলে কম্পিউটারও সহজ ভাবেই তোমাদের কাছে ধরা দেবে। জটিলভাবে বোঝার জন্য তো উঁচু ক্লাস রইলই। তখন তোমাদের মগজের মানে CPU -র রম, র¨াম, অ্যালু, কন্ট্রোল ইউনিটের ক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে না ? এই বলে কাকাই তার বক্তব্য শেষ করলো।