‘ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা হ’ল সেই দর্পণ যার সামনে তরুণ তরুণতম কবিরা নিজেদের সম্পূর্ণ চেহারাটি অবিকল দেখতে পেয়েছিলেন’
— সুজিত সরকার
‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ (১৯৭১) এই নামের কাব্যগ্রন্থের জনক ভাস্কর চক্রবর্তী। বলা বাহুল্য এটি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। সাতের দশকের গোড়ায় এই বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যাচ্ছিল বাংলা কাব্য একটা নতুন কাব্যভাষা পেয়ে গেছে। সত্যিই ‘বাতিল, অতি সাধারণ সামান্য সব কথা, দৃশ্য, ফেলে আসা দিনগুলো, আমাকে টোকা দিয়ে যায়। আর তাদের নতুন পোষাক পরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে আমার।' একেবারে সহজ, সাবলীল, সাদামাটা বাক্যবন্ধে যে কবিতাকে দাঁড় করানো যায় তা প্রথম দেখালেন ভাস্কর চক্রবর্তী। হ্যাঁ আমাদের মনে আসবে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথা। তাঁদের কবিতাও মুখের ভাষা নিয়ে। কিন্তু ভাস্কর আরও একধাপ এগিয়ে একেবারে টানটান খাঁড়া বাঁশের ভাষায় কবিতা লিখলেন তিনি। কোথাও এতটুকু তথাকথিত ছন্দ নেই, মারপ্যাঁচ নেই তেমন দার্শনিকতাও হয়ত নেই। তবু কবিতা হতে কোথাও বাধা নেই এমনই নির্ভার সেসব কবিতা।
একটি কবিতায় যাই:
তোমার হাসি
ভালো লাগে আমার— পথের
মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে
তুমি যখন হেসে ওঠো হঠাৎ-- পুলিশও
মুখ ফিরিয়ে দেখে নেয় আমাদের
সিগারেট ধরায়
জয় গোস্বামী কীভাবে দেখেছিলেন এই কবিতাটিকে দেখে নিই—
‘হলো তো। কিছুই নেই কিন্তু কবিতায়। আছে কেবল তোমার হাসি। পুরো প্রথম লাইন জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে তোমার হাসি। আর তার আলোকচ্ছটা এসে লেগেছে পুরো কবিতাটিতে। এই তুমি-কে আমরা সবাই চিনি। আমাদের সবার জীবনে এই ‘তুমি’ আছে, এসেছে। দূরে চলে গেছে। আঃ। আবার দূরে চলে যাবার কথা কেন। ...তোমার হাসি ভালো লাগে আমার যখন পথের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে হেসে ওঠো তুমি ঝরনার মতো শব্দময়। ‘হেসে ওঠো’— ব্যবহারের মধ্যে বোঝা যায় হাসিটি শব্দময়। শব্দময় আরও, কারণ অন্যরা তো বটেই, এমনকি রাস্তায় দাঁড়ানো পুলিশ পর্যন্ত মুখ ঘুরিয়ে দেখে নেয়। দেখে আমাদের। শুধু তোমাকে নয়। আমাদের দুজনকে একসঙ্গে বা দেখে নেয়। ...তারও হয়ত মনে পড়ে গেছে কোনও মেয়ের কথা। তার হেসে ওঠার কথা। নিজের প্রেমজীবনের কথা হয়ত মনে পড়েছে তার। কিংবা হয়ত তাও নয়, একটি প্রেমে তার প্রেমিকের সঙ্গে এমন সুন্দরভাবে হেসে উঠল, এই সৌন্দর্য দেখেই, বিরক্তিকর ও মুখ গোমড়া করে থাকা কাজের মধ্যেও আনন্দ স্পর্শ করল। স্পর্শ করল হালকা কোনও প্রেমানুভূতি। সুন্দর করে একটি মেয়েকে হাসতে দেখে প্রায় সব পুরুষের মনে খুশি আনন্দের ছদ্মবেশে সে অনুভূতি এসে পড়ে। তাই সে সিগারেট ধরাল। এই সিগারেট ধরানো আর কিছুই নয়, এই মুহূর্তে হাঁফ ছাড়া একটু। একটুখানি খুশি উদযাপন ।
এই লুকিয়ে থাকা কবিতাটিতে যে নতুনত্ব তা ভাস্কর চক্রবর্তীর আগে কোথাও ছিল না বাংলা কবিতায়। বিষাদের কবি হিসেবেই কবি সমাজে
তাঁর পরিচয় আজও রয়েছে।
১৯৭৭ সালে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় তাঁর একটি কবিতা প্রকাশ পায়। কবিতাটির নাম ‘আঁধার বিষয়ে’ পড়ে নিই সেই কবিতা—
যে বিকেলে জ্বর আসে
সেই বিকেলের মতো
তুমি এসে
দাঁড়িয়ে রয়েছো।
ঘড়ির ভেতর দিয়ে
রক্তের রেখার মতো
সময় চলেছে।
আমি কি অসুখ থেকে
কোনোদিন
উঠে দাঁড়াবো না? আজো রাত
জাগাজাগি হয়
শরীর মিলিয়ে যায়
নরম শরীরে। -- আমি শুধু
আমার পৃথিবী দেখে যাই...।
চারপাশে
কেমন হাজার আলো
জ্বলে আছে, তবু
এমন আঁধার আমি
জীবনে দেখিনি’।
একটা মনখারাপের আবহ আছে এই কবিতায়। ‘শরীর মিলিয়ে যায় নরম শরীরে’— এমন লাইন পড়ে বোঝা যায় কবির মনস্তাপ। এখানে সান্ত্বনা দেবার কোনো মানে নেই। খুব সহজ করে বললে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের পলেস্তরা খসা পান্ডুলিপি রচনা করেছেন তিনি। এক অনিশ্চয়তার তামাক গন্ধ লেগে রয়েছে তাঁর কবিতায়। একে একে বের হল তাঁর কাব্যগ্রন্থ— এসো, সুসংবাদ এসো (১৯৮১), রাস্তায় আবার (১৯৮৩), দেবতার সঙ্গে(১৯৮৬), আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে (১৯৮৯), স্বপ্ন দেখার মহড়া (১৯৯৩), তুমি আমার ঘুম (১৯৯৮), নীল রঙের গ্রহ (১৯৯৯), কীরকম আছো মানুষেরা (২০০৫), জিরাফের ভাষা (২০০৫)।
মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁর সম্পর্কে বলেছেন— ‘অসংলগ্ন ও তুচ্ছ বুনে বুনে তাঁর কবিতা তৈরি। মধ্যে মধ্যে উদ্ভটের ফোঁড়। অসংলগ্নতা কখনো কখনো
বিজ্ঞানের প্রশ্রয় পায়, তুচ্ছ পায় তার স্পষ্ট অর্থের অতিরিক্ত অন্য ব্যঞ্জনা, আর উদ্ভট পংক্তিগুলো যেন অকস্মাৎ তির্যকভাবে ধাক্কা দিয়ে রক্ত সঞ্চালন করে দেয় তাঁর বিবর্ণ, স্তিমিত কবিতাগুলির দেহে। দু’একটি পংক্তি নিয়ে
কোনো তরুণ উত্তেজনা গণনীয় নয়। কিন্তু তার কবিতা— সমগ্র ব্যেপে যে মনোভঙ্গিটি ছড়িয়ে আছে আমি তাকে মান্য করি। সেটি তাঁর মমতা’।
আসলে তাঁর মিথ হয়ে যাওয়া লাইন 'আমাদের স্বর্গ নেই, স্যারিডন আছে’ থেকে যে নিষ্কৃতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে তা আরও পরে পরে
ধরতে পারা যায়— তিনি জানেন এ পৃথিবী এ সময় দারুণভাবে ক্লান্ত, বিমর্ষ। তবু তিনি সেখান থেকে একটা ভালোবাসার বলয় তৈরি করতে
চান— আমার এ হাত আমি বাড়িয়ে দিয়েছি/ যদি ভালোবাসা থাকে/ মানুষের মতো যদি হও/ টান দাও/ বাজুক সেতার।
তিনিই তো বলেছিলেন—
টেবিলে পয়সা থাকে
দুজন তিনজন বন্ধু উঠে যায়—
দুজন তিনজন বন্ধু
টেবিলে ঘুমিয়ে পড়ে, হাঁটে
অনেক দূরের থেকে
আমিও নিঃসঙ্গ হাঁটা শুরু করি—
রক্ত পড়ে
রক্ত ঝরে পড়ে।
অর্ণব সাহা দেখেছেন— “আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে” বইতে এসে ভাস্কর ক্রমশ একটা বৃহত্তর উচ্চতা বা দূরত্ব থেকে যেন জগৎ ও জীবনের দিকে তাকালেন। ...কবিতা হয়ে উঠল স্টেটমেন্ট ধর্ম।
‘রাস্তায় আবার’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা পুরোপুরি বাড়িকে নিয়ে। এমন যত্নশীল কবিকে পেয়ে সত্যিই আমরা মনোকষ্টে ভুগি—
ডাল
যখন সেদ্ধ হতে চায়না ডাল
সারা বাড়ি
থমথম করে। স্নান ক’রে
বাবা দাঁড়িয়ে থাকেন। স্নান ক’রে
দিদি দাঁড়িয়ে থাকেন।
আর সকালবেলা, -- আমি চমকে উঠি—
সমস্তবাড়ি চুপচাপ
মা, বসে আছেন উনুনের পাশে
এমন কবিতা পড়ে আমরা পাঠকেরাও তো দিশেহারা হয়ে পড়ি। উন্নয়নশীল দেশের এক রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসছে এই ভারতের খন্ড এক ছবি— যে ছবি বিষণ্ণতায় ম্লান।
‘রাস্তায় আবার’ এই নামেও একটি কবিতা পাই যেখানে কাব্যগ্রন্থের নামও ‘রাস্তায় আবার’। কবি লিখেছেন—
সবুজ কাঠের বারান্দা, তুমি
শিখিয়েছ আমাকে
একলা হতে। একা
দেবতাকে নিয়ে নানান বিভঙ্গে ফুটে উঠেছে ‘দেবতার সঙ্গে’ কাব্যগ্রন্থে। অদ্ভুত সে কবিতা।
‘আমার গলির মধ্যে কোনও গাড়ি ঢোকেনা দেবতা তুমি একা খালি পায়ে হেঁটে এসো আমার বাড়িতে ছাতে শতরঞ্চি পেতে কথা হবে আরো
রাত্রিবেলা’। এভাবে কেউ দেবতার সঙ্গে কথা বলার প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে তো শুনিনি।
নিজের না থাকা নিয়ে তিনি যেভাবে লিখে গেছেন যেন নিজের জন্যও তার কোনও দুঃখ নেই।
‘তীব্র কোনো শব্দ হবে না
গড়িয়ে পড়বে না কোথাও একফোঁটা চোখের জল
‘যাক ঝামেলা চুকলো’ কেউ হয়ত বলবে
কেউ হয়ত চিঠি লিখবে: ঢ্যাঙাটা গেছে’
মৃত কবিবন্ধুদের জন্যে তাঁর ভাবনা হয়। কীরকম সে বন্ধুত্ব—
‘মৃত কবিবন্ধুদের প্রতিনিধিত্ব করি আমি
আমি কলকাতায় থাকি।
বরানগরে
মানিকের সঙ্গে চিঠিচাপাটি চলে
শামসেরের সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা হয়
খবর নিয়েছি, সুব্রতর আর ওষুধপত্রের দরকার হয় না
‘নীলরঙের গ্রহ’ এই বইটি আমি প্রকাশ কালেই দেখেছি। বইটির প্রকাশক প্রয়াত শৌণক বর্মন আমাকে এটি দেখিয়েছিলেন। আমি
পড়েছিলাম সে সব কবিতা। মনে আছে একটি কবিতার নাম ছিল‘আনন্দ’। সেখানে লেখা
ছিল—
‘মৃত্যুর পরেও, আমি কবিতা লিখে
পাঠিয়ে দেবো তোমাদের।
সারাজীবন অদ্ভুত একটা মেয়ের কাছে
তোমরা চিঠির পর চিঠি লিখবে’।
জিরাফের ভাষা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর প্রতি আমার বিশেষ মুগ্ধতা আছে।
৪৮ নং কবিতায় পাই—
‘এইসব সারেগামা পেরিয়ে তোমার কাছে
দু’ঘন্টা বসতে ইচ্ছে করে
আমার তৃতীয় চোখ হারিয়ে গিয়েছে
সিঁড়ি দিয়ে যে উঠে আসছে আজ আমি তার
মুখও দেখিনি’।
কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য যা বলেছেন তা একটু জেনে নিই— ‘জিরাফের ভাষা’ কাব্যগ্রন্থে আমরা পেয়েছি সেই আবহ, সেই দর্শন, যা এক নিশ্চেষ্ট
মানুষের নিরন্তর জীবন প্রবাহের হীরকখন্ডের মতো অভিজ্ঞতাকে হাজির করে।' আসলে জিরাফের ভাষা মানুষ বোঝেনা। যেমন কবিদের ভাষা অন্য মানুষ বোঝেনা সেরকম। একটা অনতিক্রম্য দূরত্ব পাঠক ও কবিকে আলাদা করে রাখে। অবশেষে কবি হয়ে যান আউটসাইডার। ভাস্কর বারংবার তার প্রিয় দুপুর ও হেমন্তকে কবিতায় চিহ্নিত করেছেন। ‘ভাস্করের হেমন্তকাল জীবনানন্দের হেমন্ত নয়, যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই থেকে যায়, সেখানে জীবনকে মনে হয়একটি নঞর্থক বৃত্তের মতো। ভাস্করের হেমন্ত একেবারে ব্যক্তিগত, খাপছাড়া, অনির্দেশ্য নক্শায় আঁকা, তাই পরিণতিহীন।' (দেবারতি মিত্র)
কবির নিজের খেদ—
‘আমাকে কেউ কোনোদিন বেঁচে থাকতে বলেনি’
কিন্তু আমরা দেখছি আপনি বাংলা কবিতার তরুণ-তরুনীদের মধ্যে দিব্যি বেঁচে রয়েছেন।