অনাথ - উত্তম ভট্টাচার্য

পুলিশ এসে এনকোয়‍্যারি করে গেল,-লাশটা কার! কতক্ষন হ'ল লাশ হয়ে পড়ে আছে। নেতা এল, লাশটা কোন দলের, নিজের দলের লাশ বানাতে সুবিধা অসুবিধা কিসে কিসে !স্বেচ্ছাসেবীর দল এল লাশটা পরখ করতে,-পরিশ্রম করলে কেষ্ট লাভ হবার সম্ভাবনা কতটা।মিডিয়াম‍্যান এল লাশটার খোঁজ নিতে, টি. আর. পি. বাড়ার সম্ভাবনা ততক্ষণে আছে কিনা।
কিন্তু, বাচ্চা মেয়েটির মাথায় তখনও বুদ্ধি এল না, এসব হ'ল কিসে,সে তার ঘর যাবে কিভাবে । তার বাপের কি হ'ল হঠাৎ? ওঠে না ক‍্যেনে! তাই ভয়ে কাঠ হয়ে বাচ্চা মেয়েটি তফাতে জড়োসড়ো হয়ে লুকিয়ে পড়লো। আর দূর হতে লক্ষ্য রাখল বাপের দিকে, এবং সঙ্গে আনা পুঁটলীটির দিকেও ! নাহ্, কেউ পুঁটলীতে হাত দিচ্ছে না , বাপের গায়েও না।

খুব সকালে বেরিয়েছিল ওরা, বাপ-মেয়েতে সূর্য ওঠার আগেই।মেয়ের জন্য পোঁটলায় বাঁধা দুটি মুড়ি আর কালমেঘের শুকনো ডাঁটা, পিঁপুল,লাউ-শিম-কুমড়োর বিচি,আর ঝিনুক পোড়া চুন। পুঁটলীতে সব রাখা আছে। বাবুরা খাঁটি জিনিসের খুব কদর করে। যারা কেনার তারা কেনে। তার জন্যে চুপ করে বসে থাকতে হয় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত।
বাচ্চা মেয়েটির ততক্ষনে ঘুম এসে যায় চোখে।ও শুয়ে পড়ে বাপের পায়ের কাছে এক ধারে। দুপুর হলে বাপ ডেকে তুলে মুখের সামনে এগিয়ে ধরে শালপাতার বাটিতে ঘুঘনী আর পাউরুটি একটা।
আজ দু'বান্ডিল কালমেঘের ডাঁটা বেশীই বিক্রি হয়েছে।তাই দু'টো সিঙ্গাপুরি কলাও কেনে মেয়ের জন‍্যে। নিজে একটা খেয়ে, মেয়ে বাপের মুখে তুলে ধরে- 'আর খামু না,তুমি খাও!'
বাপ তাই খায়। তারপর একটা বিড়ি ধরায়।
মেয়ে রে- রে করে ওঠে। বিড়ি খাও না বাপ! ও বিড়ি খাওনা।
বাপ কতা শুনলো না। বিড়ি টানতে লাগল।বিড়ি টানতে টানতে খুব কাশলো। কাশতে কাশতে শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকে গেলো।শুয়ে পড়লো মাটিতে। তারপর শুয়েই দাপাদাপি করতে করতে চুপ হয়ে গেলো!
মুহূর্তে, বহু লোক জড়ো হয়ে গেলো, বাঁদর নাচ দেখতে যেমন গোল হয়ে মানুষ জড়ো হয় পাড়ায়। কেউ বললো,-মিরগি! কেউ বললো-সন‍্যাস রোগ! আর কেউ কঠিন কি একটা বললো-"হাট-ট্"
কিন্তু, শরীরটা পড়েই রইলো ফুটপাতের উপর।পুলিশ এলো,নেতা এলো। শেষে দিনের সূর্যটাকে বিদায় জানিয়ে রাতের আঁধার ঘনিয়ে এলো শহরের বুকে। তারপর ধীরে ধীরে রাস্তা ফাঁকা হয়ে এলো। ঘুঘনীওয়ালা ছোট্ট কালো ছেলেটা ওর মাকে নিয়ে দোকান গুটিয়ে কখন ফিরে গেছে ঘরে।
এবার বাচ্চা মেয়েটি বেড়িয়ে এলো কুঠির থেকে।তার জল তেষ্টা পেল না,খিদে পেল না, শুধু মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত আতঙ্ক বাসা বাঁধল তার মনের গভীরে ।তার কী হবে !
বাড়ি বলে যা জানত,সেখানে যাবে কি করে !তাই এতক্ষণ পর ছোট্ট দুটি হাতে বাপের গলাটি জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো ছোট্ট মেয়েটি---'মোরে ঘর লে চল বাপ্--শুইয়া থাকোনা---ঘর চল্--!'
কিন্তু বাপ শক্ত কাঠের মতো নীথর হয়ে পড়ে রইল মাটিতে। ছোট্ট মেয়েটি নিঝুম নয়নে চেয়ে রইল বাপের মুখের দিকে। কাঁদছে না, কিন্তু কান্না তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে, ঘনঘন ঝাঁকুনি দিয়ে, অন্তরের গভীর গহ্বর হতে মাঝে মধ্যেই ফুঁপে ফুঁপে গরল বাষ্পাকারে বাইরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে।
আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হলে বোধহয় এমনটি হয়।
কে সে! তার মা? মাকে তো তার মনে নেই! মার কোনো স্বপ্ন নেই তার অন্তরে। জানা নেই মার রং-চেহারা-গড়ন-গঠন, কিংবা সোহাগ, স্নেহ , ভালোবাসা !
তবুও একটা গন্ধ তার নাকে!
এ কিসের গন্ধ!!

এসব নানা কিছু চিন্তায় যখন বাচ্চা মেয়েটি ডুবে যাচ্ছিল, ওমনি কোথা থেকে একটা কালো গাড়ি হুস্ করে এসে দাঁড়ালো ফুটপাতের ধারে। তারপর বাপের কাঠের মতো শরীরটাকে টানতে টানতে হিঁচড়ে নিয়ে তুললো গাড়ির ভিতর ! আর ওমনি দরজা বন্ধ করে হুস্ করে বেড়িয়ে গেলো ওখান থেকে।
মেয়েটি ছুটে বেড়িয়ে বহুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ঐ অন্ধকারের দিকে। যতদূর তার দৃষ্টি যায়---!
শুধু একটা কুকুর শঙ্খ বাজানোর মতো করে করুন সুরে দীর্ঘক্ষণ কেঁদে উঠলো---ভূঁ-উঁ--উঁ ভূঁ--