বর্ণের বারামখানায় - রজত চক্রবর্তী

বাড়ি যাবো।
লাল তিল গালে হেসে ওঠে।
বাড়ি মানে ?
ঝুড়ো চুল ঝুঁকে পড়ে।
যেখানে আমি থাকি।
মানে আস্তানা
সেটাই আমার ঘর।
চেনো?
চিনি।
ঘরের ভেতর ঘর, তার ভেতরে ঘর, তার ভেতরে ঘর...
প্রতিটা ঘরেই থাকতে থাকতে চলা
তাহলে?
তাহলে...কিছু নয়। আমরা একটা কিছু বানিয়ে তুলি...বালকনি, জানালা, দরজা সব সব ঠিকঠাক, মাপ মাফিক, প্রয়োজন মোতাবেক...
প্রয়োজন একটা বড় বিস্ময়কর শব্দ!
হ্যাঁ ।
প্রয়োজনে এসেছিলে?
হ্যাঁ হয়তো!
হয়তো কেন?
ঠিক বুঝিনি কতটা কার প্রয়োজন, খানিকটা আমার, খানিকটা তোমার...
আমার?
হ্যাঁ ।
আমার প্রয়োজন...তুমি! বুঝলুম না!
এইখানেই গড়ে ওঠে ঘর, বাড়ি, পাড়া, মহল্লা, শহর, দেশ...
মানে?
ঐ যে বুঝলাম তোমার প্রয়োজন, বুঝলাম বলেই এলাম, থাকলাম, তোমার প্রয়োজন ছিল বলেই বসতে বললে, আমার প্রয়োজন ছিল বলেই বসলাম ...তাই তো সম্পর্ক!
এই সবই তো কথায় কথায় গড়ে ওঠা...
হ্যাঁ, কথাই তো! অযুত নিযুত অক্ষরমালার সহবাসের মধ্য দিয়েই সমস্ত সম্পর্কের নির্মিতি...
প্রেম থেকে যুদ্ধ, জন্ম থেকে মৃত্যু সব সবকিছুই সহস্র অক্ষরধ্বনির উচ্চারণ ।
কী আশ্চর্য দেখো, কতগুলি উচ্চারণেই আমার ভেতরে পুলক জাগে, প্রেমময় হয়ে উঠি, গহনে জল প্রপাতের কাঁপন...
শুধু কয়েকটি বর্ণমালার সাজিয়ে তোলার কেরামতি!
বর্ণে বর্ণে উচ্চারণে উচ্চারণে কেমন ধরতে চাওয়ার আকুতি...ইশারাও তো কোনো এক বর্ণে অনুবাদ হয়েই আসে...
ধরতে চাওয়া?
হ্যাঁ ধরতে চাওয়া!

চুপ করে বসে আছি। হাতের মুঠোয় ফলসা পাকা। পুকুর পাড়। ঝোপের আড়াল। গ্রীষ্মের দুপুর ঢুকতে পারে না ছায়া পেরিয়ে। বুনো ফুলের গন্ধ । পুকুরের পাঁকের গন্ধ । টুপ, ডুব দেয় কালো হাড়গিলে পানকৌড়ি। পাশের পাকুড় গাছের ডালে মাছরাঙা ঝিম। এই এই সবের ভেতর ডুবে গেছি আমি। ভুলে গেছি গ্রীষ্মের হোমটাস্ক । অঙ্কের স্যারের বড় স্কেল। মায়ের বকুনি । বাবার ছিপটি। সব বেবাক বেপাত্তা । নিঃশব্দ দুপুর এক গোপন কোলাহল নিয়ে আমার ভেতরে ডুব। এই আমি।
মন্দিরে সন্ধ্যারতি । ধূপ-ধুনো। কালীর জিভ। উজ্জ্বল চোখ। মুকুট। পুরোহিতের ঘন্টা ডানহাতে নড়ে যায় । বাঁহাতে চামর। শাঁখ বাজে । ঠোঁট গাল ফুলে ওঠে সুন্দরী কাকিমার। আমি হাফপ্যান্ট। বড় ঘন্টা বাজাতে থাকি বাজাতে থাকি বাজাতে থাকি...। ছাদ থেকে ঝোলানো ঘন্টা । পিতলের গোল। কাঠের হাতুড়ি আমার ডান হাতে। বাঁ হাত উঁচু করে ঘন্টার নড়া ধরে আছি। ঢং ঢং ঢং । ঢংঢং ঢং ঢংঢং। ঢং ঢংঢং ঢং। ক্রমশ ঘন্টার শব্দে শব্দে শরীর ভর্তি হয়ে যায় । সারা শরীরময় ঘন্টাধ্বনির চলাফেরা । গতিময় । ঝিমঝিম করে। আমি ধীরে ধীরে ধীরে ঘন্টাধ্বনি হয়ে উঠি। ঝিম। এই আমি।
কাঁদানে গ্যাসে চোখ ঝাপসা। জ্বালা করছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে সবাই । সামনে আবছা আবছা হেলমেট । লাঠি। হঠাৎ মাথায় ঝঁকুনি। চোখ অন্ধকার । মাথা অসার। মাথা থেকে গরম তরল গাল দিয়ে, কানের পাশ দিয়ে । দাঁড়াতে পারছি না। শুয়ে পড়ি। গরম রাস্তার ছ্যাঁকা লাগে পিঠে। মাথা রাস্তায় ঠুকে যাবার আগেই কার হাত। কোল। তাকাই। কেঁপে কেঁপে আবছা হয়ে ওঠে তৃণা। তৃণার উড়না জড়িয়ে থাকে মাথা । রক্তে ভেজে । আমি শুয়ে থাকি অন্ধকারে । এও আমি।
এই যে টুকরো টুকরো আমি। সহস্র অযুত নিযুত আমার আমি। গরমভাতে ডালের পুকুরে আমি, হারিয়ে যাওয়া মানিব্যাগে আমি, চাকরির ফর্ম ফিলাপে আমি, চায়ের ভাঁড়ে আমি, বিড়ির শেষটানে আমি, গোপন চিরকূটে আমি, হিংসার আমি, অহিংসার আমি, সত্যের আমি, অসত্যের আমি, উপকারের আমি, লোক ঠকানোর আমি...অজস্র আমার আমি ছিন্নভিন্ন ছড়িয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। তাকে ধরতে পারার এক প্রাণান্ত ছুট। পারছিনা তো!

তার গালের লাল তিল খিলখিল হয়। হাসিতে ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ে। বৃষ্টিতে হাসনুহানা।
আমরা শব্দে শব্দে বর্ণে বর্ণে অক্ষরে আঙুল দিয়ে দিয়ে চলে চলে ধরতে চাই সমগ্র...

এই ছড়িয়ে থাকা নিজেকেই ধরতে পারলাম না...

চেষ্টা করছ, চেষ্টা করি, করতে করতে এই আমরা কাছাকাছি, আমরা সিনেমা না এই নদীর কাছে এলাম, এই আমার কোলে তোমার মাথা, সবই ঐ চেষ্টার ভিন্ন ভিন্ন রূপ...

আমি তোমাকে ধরি শব্দে উচ্চারিত অক্ষরে অক্ষরে!

হ্যাঁ তো! দেখার তো একটা প্রেক্ষাপট আছেই, যা অক্ষর বর্ণনা করে গেছে...

মানে বস্তু ধরি শব্দে বর্ণে অক্ষরে!

হ্যাঁ হ্যাঁ । বস্তুর অন্তর ধরার জন্যই যুগে যুগে গুহার দেওয়াল থেকে আজকের কম্পিউটার স্ক্রিনের উপর বয়ে চলে নিরন্তর অক্ষরমালা...

চুলে নরম আঙুল বিলি কাটে। সন্ধ্যা নেমে আসে। কাছের মন্দিরে সন্ধ্যারতি শুরু হয়। নদীর রঙ পাল্টে যায় । মিশে মিশে যায় অন্ধকারে । অন্ধকারের গাছ কালো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তৃণার অনুচ্চারিত বর্ণমালারা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পরে শরীরের তন্ত্রে তন্ত্রে... প্রেমভাষা জেগে ওঠে...
জেগে ওঠে চরাচর...জঠর ছেঁড়া বর্ণমালারা খেলা করে ভুবনময়...