রক্ষমাংসের শরীরে ' ক্ষুধা' একটি জৈবিক প্রবৃত্তি।আমীর থেকে ফকির- এই প্রবৃত্তির বাইরে একজন ও নন ।জীবনধারণের তাগিদেই খাদ্যগ্রহণ প্রয়োজন।মেধার উৎকর্ষতাতে পুষ্টি একটি বিজ্ঞানসম্মত অধ্যায়।সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনুরাগের আন্তরিকতায় এই ক্ষুধাকে উত্তরণের পথে নিজেদের ভাবনাকে পরিচালিত করেন সুফি সাধকেরা।আধ্যাত্মিক উপলব্ধির একটা বিশেষ স্তরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে, ক্ষুধা- তৃষ্ণার মতো জীবনধারণের একদম প্রাথমিক শর্তগুলিকে জয় করা সম্ভবপর হয় না। সুফি সাধকেরা সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁদের অন্তরের কাকুতিকে এমন একটা জায়গাতে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন, যেখানে ক্ষুধার অস্তিত্ব ই কার্যত থাকে না। ক্ষুধার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে সাধনমার্গের একটি পর্যায়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবার যে সুফি ধারা, সেই ধারাকে তাঁরা বলেন, ' জো'ওরক আল শাহওয়া'।
ক্ষুধার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে পরমকারুণিকের চিন্তায় আত্মসমর্পণের এই ধারা সুফি পথ কে চিন্তার জগতে একটা অনন্যতা দিয়েছে। জাগতিক চিন্তা থেকে কেবল মন নয়, সমস্তরকমের প্রবৃত্তিকে সরিয়ে নেওয়ার এই কৌশল শরীর বিদ্যার একটি বিশেষ রকমের পারাঙ্গমতার ভিতরে ধীরে ধীরে সুফি সন্তদের উত্তরীত করে।এই জো'ওরক আল শাহওয়া কিন্তু নিছক কোনো উপবাস নয়।আত্মশুদ্ধির ভিতর দিয়ে চিত্তশুদ্ধিতে উপনীত হওয়ার একটি সোপান এই ভাবধারা।চিত্তের প্রবৃত্তি , তা কেবল কু প্রবৃত্তি ই নয়, ক্ষুধা- তৃষ্ণার মতো স্বাভাবিক প্রবৃত্তি গুলিকে জয় করতে না পারলে ভালোবাসা জন্মায় না। এই ভালোবাসা কিন্তু কোনো অর্থেই দেহজ ভালোবাসা নয়। সৃষ্টিকর্তার প্রতি সর্বাত্মক আত্মনিবেদন।এই আত্মসমর্পনের ভিতর দিয়েই উঠে আসে মানুষের প্রতি পরম ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাতে জাতি- ধর্ম- বর্ণ - বিত্ত , কোনো কিছুর ই বিন্দুমাত্র আবডাল থাকে না।
বিনয় হল সুফি তরিকার একটি অঙ্গ।কারো কথায় উত্তেজিত হয়ে এতোটুকু বৈরি মনোভাব প্রকাশ - কখনো কোনো সুফি সন্তের ভিতরে দেখতে পাওয়া যায় না।অনুরাগী, অনুগামীর কাছেও কখনো এতোটুকু ঔদ্ধত্য কোনো সুফি সাধক দেখান না।তাঁদের চিন্তাধারাতে স্পর্ধা বিষয়টিই একটি অভিধান অপ্রসূত শব্দ।কোনো সুফি সাধক কখনো অপর তরিকার বা ধর্মের সাধন অথবা সাধন পদ্ধতি ঘিরে একটি বারের জন্যে ও স্পর্ধিত কোনো শব্দ বলেন না।এই যে বিনয়াবনত ধারা, সুফি সাধনাতে তাকে বলা হয়,' খোশুঅ' ।অনেকে আবার এটিকে ' তওয়াজু' ও বলে থাকেন। সৌজন্যে র এক প্রতিচ্ছবি হিশেবেই সুফি সাধনাতে বিনয় , সাধকদের যাপনচিত্রের একটি ধারাতে পরিণত হয়েছে।
ব্যক্তি জীবনে ই হোক আর সমষ্টিগত ক্ষেত্রেই হোক, যে কোনো রকমের অশুভ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াই হল সুফি সাধনার একটি বিশেষ ধারা।অশুভ প্রবৃত্তি যদি মনের ভিতরে বাসা বাঁধে তবে সেই মন কখনোই কোনো ইতিবাচক চিন্তার দিকে ধাবিত হবে না- এই বোধটি সুফি সাধনার একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় চেতনাসমৃদ্ধ স্তর। মনের কুপ্রবৃত্তি সম্পর্কে যেমন সজাগ থাকার কথা সুফি সাধনাতে বলা হচ্ছে , তেমনি ই সমষ্টির ক্ষেত্রে, সমাজের নিরিখে যদি কোনো কুবৃত্তির স্ফুরণ দেখা যায়, তাহলে সর্বশক্তি দিয়ে সেই কুচেতনার বিরুদ্ধে সমবেতভাবে লড়াই করতে হবে- সুফি মতবাদে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এই কার্যকারিতাকে সুফি সাধনায় বলা হয়,' মোখালফত অল নফস' । অনেকে এটিকে ' যিক্ র উয়োবিহা' বলে ও অভিহিত করে থাকেন।এই ' যিক্ র উয়োবিহা' সময়ের নিরিখে বাংলা তে মরমীয়া সাধকদের ক্ষেত্রে জিকির দেওয়া - এমন একটি শব্দবন্ধতেও পরবর্তীতে বিবর্তিত হয়েছে।এই জিকির দেওয়ার মতো লৌকিক ইসলাম জনিত অভ্যাস টি বাংলায় তথা ভারতেও সুফি সাধনার মরমীয়া ধারা র বাইরের তরিকার সাধকদের ভিতরেও অনেক সময়ে দেখতে পাওয়া যায়।
সুফি ধারা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী চিন্তাস্রোত ' আহলে হাদিস' দের ভিতরেও অষ্টাদশ শতকে গ্রামবাংলাতে এই জিকির দেওয়ার অসাধারণ সামাজিক প্রেক্ষিতের ছবি এঁকেছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ তাঁর কালজয়ী উপন্যাস' অলীক মানুষে' ।' যিক্ র উয়োবিহা' সুফি সাধকদের একান্ত যাপনচিত্রের অঙ্গ হিশেবে যে অভ্যাসের সূচনা এবং সময়ের বিবর্তনে সুফি তরিকার সাধনাতে যে বিষয়টি একটি অবশ্যপালনীয় অধ্যায় হিশেবে স্বীকৃতি লাভ করলো, সেই বিষয়টি ই সুফি ভাবনার সময়ের তরণীতে প্রবাহমানতার নিরিখে কি ভাবে গৌণ ধর্মের একটি আঙ্গিকে পরিণত হল, তা আমাদের গভীর ভাবে ভেবে দেখা দরকার।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকে গৌণ ধর্ম একটি ধারা হিশেবে নিসৃত হওয়ার পর ও সেই গৌণ লক্ষণ কোনো অভেদ্য ধারা হিশেবে থাকছে না। গৌণ ধর্মের লক্ষণ আবার ওয়াহাবীদের প্রাতিষ্ঠানিক ধারাতে মিশে যাচ্ছে।সময়ের বুকে , সংস্কৃতি যেমন একটা প্রবাহমানতার মিশেল, তেমনি ই গৌণ ধর্ম আর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ভিতরেও একটা সহজ - সরল মিশেল আছে। সেই মিশেল টাকে আমরা বোঝার চেষ্টা করি না। ধরার চেষ্টা তো দূরের কথা।
সুফি তরিকা হাদদের দ্বারা পরশ্রীকাতরতাকে কার্যত একটি নিষিদ্ধ বস্তু হিশেবেই মেলে ধরেছে। হাদদের চর্চা মরমীয়া সাধনাকে গোটা বিশ্বে মানবধর্মের প্রসারে একটা উচ্চতার শিখরে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বস্তুত অমুসলমান সমাজে গৌণ ধর্মে যে পরশ্রীকাতরতার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে, তার বোধের উন্মীলনে সুফি সাধকদের একটা বড়ো রকমের অবদান আছে। গীবতের ভিতর দিয়ে যেভাবে পরনিন্দা- পরচর্চার প্রতি প্রবল বিরক্তি প্রকাশ করা হয়েছে সুফি সাধনার ধারাতে , তেমনটা তো সুফি মতবাদ বিকাশের কালে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে দেখতে পাওয়া তো দূরের কথা, গৌণ ধর্মেও দেখতে পাওয়া যায় নি। ( চলবে)।