তখন পাড়ায় একটা বিয়ে মানেই সবার আগে আমাদের খেলার মাঠ টা হাপিস।সেকালে তো আর বিয়েবাড়ি ভাড়া পাওয়া যেতো না। নিজের বাড়িতে উঠোন,ছাদ থাকলে তো কথাই নেই না থাকলেও কথা নেই পাশের বাড়ি -তার পাশের বাড়ি কারুর তো থাকবেই, ব্যস তাহলেই হলো।আর পাড়ার মধ্যে ফাঁকা জায়গা থাকলে তো হয়েই গেলো, যেমনটি আমাদের ছিল।সাতদিন আগে থেকেই বাঁশ পড়ে যেত মাঠে।তাই বলে আমরা কি আর খেলা বন্ধ করতাম? Adaptation বলে একটা কথা আছে না? আমাদের খেলা গুলো ও সেই মতো বদলে যেতো - বাঁশের ডাই পড়ে থাকলে সেই ডাই বেয়ে ওঠা নামা, নামতে গিয়ে হড়কে পড়া আর বাঁশ বাঁধা হয়ে গেলে এক বাঁশ থেকে আরেক বাঁশে বেয়ে বেয়ে চলা-বাঁশ ধরে দোল খাওয়া আরো কতো কি।ভাগ্যিস তৈলাক্ত বংশ দন্ড ছিলো না নৈলে বাকিটা তো আমরা ছিলাম ই!!!
বিয়ের মজা এই বাঁশ দিয়েই শুরু হতো। বিয়ে ঠিক হতে পারতো না আমাদের মাতন শুরু হয়ে যেত।যে বাড়িতেই বিয়ে হোক কমপক্ষে তিন দিনের দায়ে নিশ্চিন্তি। তবে মজার ব্যাপার হলো আমার ছোট বেলায় বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজে আমি দুধরনের বিয়ে দেখেছি।বিয়ের নিয়ম কানুন মোটের উপর এক হলেও স্ত্রী আচার - খাওয়া দাওয়া ছিল একদম আলাদা একদিকে এই বীরভূমের বিয়ে অন্য দিকে কলকাতার বাঙাল বাড়ির বিয়ে।
বীরভূমের বিয়ে বাড়ি মানেই বিয়ের সাতদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যেতো মুড়িভাজা।সে এক দেখার মতো জিনিস। চার পাঁচটা মাটির উনোনে মাটির হাঁড়িতে গরম বালির মধ্যে মুঠো মুঠো চাল দিয়ে কুচি কাঠি দিয়ে নেড়ে দিলেই ধবধবে সাদা জুঁই ফুল ফুটে উঠতো যেন।কি অপূর্ব যে লাগতো সেইগরম মুড়ির গন্ধ।ধীরে ধীরে মুড়ির পাহাড় তৈরি হতো। তিন চারজন মিলে টিনের গায়ে বাড়ি মেরে মেরে মুড়ি ভরতো।আমরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে সেই পর্ব দেখতাম।জলখাবারে সেই মুড়ি,খোসাশুদ্ধ আলুর তরকারি আর বোঁদে।রোজ সকালে মাটিতে লাইন দিয়ে বসে শালপাতায় সেই মুড়িভোজ চলতো।বীরভূমে আমি কখনো কলাপাতায় খেতে দেখিনি।কলকাতায় যেমন কলাপাতা বীরভূমে তেমনি শালপাতা।তবে জল সবখানেই মাটির খুড়িতে।
আমাদের বাঙাল বাড়ির বিয়ে গুলোতে হাঁকডাক বড্ড বেশি যেন।পাড়ার ঘটি বাড়িতে বিয়ে থাকলে মাইক না বাজা অবধি কেউ টেরই পেতো না বিয়ে বলে।শুধু মাঝেমধ্যে শাঁখ আর উলুর আওয়াজ।আর বাঙাল বাড়িতে? মামিমা কে ডাকতে হলে মা-ই ই-মা বলে এমন হাঁক পারবে তিন কুলের কানে তালা লাগিয়ে তবে থামবে।সক্কাল থেকেই ময়দার লুচি আলুর তরকারি আর মিষ্টি।আমাদের ছোটবেলায় সাদা তেল বলে কিছু ছিলো না।ডালডার লুচির সেই পাগল করা গন্ধ - আহা গোটা পাড়ায় নেশা ছড়িয়ে দিতো।
ভিয়েন বসিয়ে মিষ্টি তৈরি হতো।ভিয়েনের প্যান্ডেল হতো আলাদা, এককোণে।বাটি নিয়ে গিয়ে মা কাকিমা দের নাম করে মিষ্টি হাতিয়ে লুকিয়ে খাওয়ার সেই অফুরান আনন্দের খেসারত এখন সুগারের ওষুধে সুদে আসলে উসুল হচ্ছে।রাজভোগ-সন্দেশ-পান্তুয়া হতোই হোত।তারপর গৃহকর্তার রেস্ত বুঝে কলার তোলার ব্যবস্থা।বেঁচে যাওয়া সিরা দিয়ে তৈরি হতো বোঁদে- খাজা- গজা -লবঙ্গলতিকার মতো অপেক্ষাকৃত অসবর্ণ মিষ্টি। যা জলখাবারে আর ঘুরেফিরে খাওয়ার কাজে লাগানো হতো।
বিয়ের দিন সকালে মাছ দেখা টাও এক পর্ব ছিলো।কুড়ি পঁচিশ কিলো ওজনের বিশাল বিশাল মাছ উঠোনে এনে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি শুদ্ধ লোকের দৌড়াদৌড়ি পরে যেতো।তিন চারজন জোয়ান পুরুষ লেগে যেতো শুধু আঁশ ছাড়াতেই।তাও আবার বটি না ছুরি না স্টিলের গ্লাস দিয়ে।রাতের ভোজের মাছে শুধু পিস নিয়ে দুপুরের রান্নায় মাছের মুড়ো দিয়ে কাঁটা চচ্চড়ি আর মাছের তেলের ডিমের বড়া। বিয়ের দিন দুপুর থেকেই খাওয়া দাওয়া প্যান্ডেলে।আমরা ছোটরা লেবু নুন দেওয়ার জন্য সাত দিন আগে থেকে নাম লিখিয়ে রাখতাম।কিন্তু জলের অনুমতি নেই-ফেলে দিলে কেলেঙ্কারি।সে দায়িত্ব অপেক্ষাকৃত বড় দের।
তখন প্যান্ডেলেও এতো কারিকুরি ছিলো না।কার সঙ্গে কার বিয়ে সবাই জানে। কার্ডেই তো দেওয়া হয়েছে আবার গেটে লেখার কি দরকার? একখানা কাপড়ের গেট আর খান কতক টিউব লাইট খাড়া করলেই সবাই বিয়েবাড়িটা আর পাঁচটা বাড়ির থেকে আলাদা করতে পারতো। মেয়ের বিয়ের দায়িত্ব তো বিসমিল্লাহর ফু এ। বৌভাত হলে রবীন্দ্র সংগীতের ফাঁকে ফাঁকে রসিক জামাইবাবু আর তুতো- খুতো দাদাদের কল্যাণে মান্না- হেমন্ত- শ্যামল- সন্ধ্যা -আরতি- লতা- আশা রা সুরের ঝর্ণা ঝরিয়ে অলি গলি ভাসিয়ে বিবাহিত দের স্মৃতি আর অবিবাহিত দের বাসনা উস্কে
দিয়ে যেতো।
দুপুর গড়াতেই কনে কে নিয়ে বৌ মেয়েরা দরজা এঁটে সাজাতে বসতো । আমাদের ছোট দের একদম ঘেটি ধরে বাইরে বের করে দিয়ে।রাগে দুঃখে কান্না এসে যেতো।কিন্তু এ ব্যাপারে কারও কথাতেই চিড়ে ভিজতো না। আমাদের ঘরে ঢুকতেই দিতো না। আমরাও সন্ধ্যে হতে না হতেই মায়ের কাছে সেজেগুজে রেডি। আর রেডিই বা কি হবো? আমার শৈশবের প্রায় সব বিয়েতেই আমার একটাই hair style - নেড়া মাথা।বিয়ের দিন সকালে নাপিত আসতো বাড়িতে।বাবা কাকাদের চুল কেটে দাড়ি কামিয়ে ও নাপিতের আয়-পয় তেমন জোরদার হোত না বোধহয় আমার একমাথা ঝাঁকড়া চুল দেখে নাপিতের কাঁচির মাড়ি সুলাতো - আর সবার দাড়ি গোঁফ চুল কাটা দেখতে দেখতে আমারো কেমন ঘোর লেগে যেতো; নাপিতের হাতছানি নিশির ডাকের মতো আমায় টেনে নিয়ে যেতো।আমার দশা দেখে মা -কাকিমারা হা হা করে উঠতো, ঠাকুমা বাবার ওপর রাগে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিতো-দিদিরা হাসাহাসি করতো আর অবাক আমি ভেবে পেতাম না চুল ছাড়া আমি কি এতো খারাপ নাকি? কই আয়নায় তো বেশ অন্যরকম দেখাচ্ছে। নিজের রূপে নিজেই মুগ্ধ আমি, যতোই পুরীর পান্ডার মতো দেখাক না আমায়।
সেকালে এমন স্টল বসিয়ে ফুচকা- পকোড়া- কফি -লস্যির কোনও গল্পই ছিলো না(তবে হ্যাঁ বরযাত্রী দের আলাদা একটা জলখাবারের ব্যবস্থা হতো)।বাদবাকি সব ডিনারের নেমন্তন্ন তো ডিনারই। ফালতু জিনিস খাইয়ে পেট ভরিয়ে আসলে ফাঁকির ক্যাটারিঙি চালের ফাঁদ সেকালে থাকতো না।একপেট খিদে নিয়ে খেতে বসো ভরপেট খেয়ে উঠে যাও।স্কুলের মত হাইবেঞ্চে কলাপাতা পরবার আগে আসতো সাদা কাগজের রোল।সে রোল টানার কায়দাই আলাদা।একজন জলের ছিটে দিয়ে যাবে।এরপর একজন কাগজ একপ্রান্তে চেপে ধরবে অন্য জন রোলটি নিয়ে হনহনিয়ে ও প্রান্তে।এইবারই তো আসল কেরামতি ফ্যাচাং করে কাগজ টি ছেড়া ঠিক টেবিলের মাপে মাপে।যারতার কম্মো নয়।একদম অপারেশন এর রুগির সেলোটেপ ছাড়ানোর মত এক হ্যাচকায় ছাড়ালে তো হলো নইলে নয়। প্রথমেই লম্বা লম্বা ডাটিওয়ালা বেগুন ভাজা-এক অদৃশ্য কারণে সে বেগুন ভাজায় নুন দেওয়া হতো না। রাধাবল্লভী-ছোলার ডাল- অবস্থা ভেদে কাটলেট, কখনো কবিরাজি কাটলেট-মিষ্টি মিষ্টি পোলাও -শীতে এঁচোড় - গরমে ফুলকপি. -ছানার ডালনা-মাছের কালিয়া, ট্যাকের জোর থাকলে ইলিশ বা চিংড়ি ও হতো।আর হতো কবজি ডুবিয়ে পাঁঠার মাংস।আইসক্রিম না শেষ পাতে দই ছিলো মক্ষীরানী।মিষ্টির পরে আসতো পান-আহা পান তো নয় গৃহকর্তা র পরান টি যেন আদর আপ্যায়নের রূপালী তবকে মুড়ে হাতে তুলে দিতো।গৃহকর্তা হাতে ধূতির কোচা ধরে প্রতিটি অতিথির সামনে নিজের বাড়ি মনে করে খাবার অনুরোধ - 'সে আর বলতে'- বলে কুড়ি- ত্রিশ টা রসগোল্লা কি এক হাড়ি দই ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার গল্প কিন্তু একটুও গুল্প নয়।নির্জলা সত্যি।পরিবেশন করতো পাড়ার ছেলেরা।গামছা কাঁধে মনা- কেষ্ট-বিশু-পল্টুর দল।সবার চেনা -সবাইকে চেনে।কে খেতে পারে, কাকে তোয়াজ করতে হবে, কে পেটুক কে নিন্দুক সেই মতো পরিবেশন।তার ওপর পাড়ার মেয়েরা কেউ বোন কেউ বোনের মতো, কোথাও হাল্কা ব্যাথা কোথাও প্রাণ যায় যায়।পরিবেশন এ একটু খেয়াল করলেই দুয়ে দুয়ে চার।
এক বিয়ের বাড়িতে যে কতো বিয়ের ফুল ফুটেছে- কতো প্রেমের কুঁড়ি। বিয়ে স্পেশাল প্রেম ও হতো।বরযাত্রী এসে দেখা,দুদিনের চাওয়া -চাওয়ি বৌভাতেই শেষ। না ছিল মোবাইল না ঘরে ঘরে ফোন।আমরা ছোট বলে দুদুভাত, আমরা ছোট বলে আমাদের হাত দিয়ে ই লুকিয়ে চিরকুট, আমরা ছোট বলেই নিরালা ছাদে গেট পাহারা? বেঁচে নাও দুদিন বই তো নয়!!!
আর ছিল ছাদনাতলায় নাপিতের কবিতা।বরকনের নাম দিয়ে শুরু হলেও শেষ হতো সার্বজনীন নবদম্পতি কে দিয়ে।কখনো কখনো সে কবিতা শ্লীলতার লক্ষণরেখা ভেদ করলেও হাসি হুল্লোড়ে- বরপক্ষ কনেপক্ষের সৌখিন তরজায় সব ভেসে যেতো। ঠাকুমা-দিদিমার আশীর্বাদী পুস্তিকা ছিল অল্প শিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত মা মাসীদের কাব্যচর্চার স্বপ্ন পূরণের এক অস্ফুট প্রয়াস।ছড়ায় ছড়ায় ছড়ানো ছিটোনো মেয়ে মহলের শোক সুখের গাঁথা- সব হারিয়ে গেছে।গোটা বিয়ে বাড়িতে সবার হাতে হাতে ঘুরতো,আমাদের তো মুখস্থ হয়ে যেতো।সাহিত্য মূল্য হয়তো খুব কিছু ছিলো না কিন্তু এসবের আড়ালে ই তিরতির করে বয়ে যেত আমাদের সংস্কার,আমাদের পারিবারিক বন্ধন।
কনে বিদায় মানে সে এক প্রলম্বিত -দীর্ঘায়িত কান্নাকাটি।মোবাইল হীন, ঘরে ঘরে টেলিফোন হীন সে যুগে প্রতি মুহূর্তে মেয়ের খবর পাওয়ার জো ছিল না। বিয়ের কদিন আগে থেকেই মেয়ে মহলে চোরাগোপ্তা কান্নাকাটি শুরু হয়ে যেত।সবাই কাজ করছে -খাচ্ছে দাচ্ছে- স্ত্রী আচার পালন হচ্ছে-উলু দিচ্ছে-শাঁখ বাজাচ্ছে - কিন্তু মেয়েকে ঘিরে এক নীরব অশ্রু ধারা সব চোখের আনাচ্ কানাচ্ দিয়ে গড়িয়ে থুতনির কাছে এসে হারিয়ে যাচ্ছে।আর সেই সঙ্গে চলছে অনবরত পরের বাড়িতে মন যোগানোর মুখ বোজানোর শিক্ষা মাসী পিসি জেঠি খুড়ির দলের।
মন খারাপ করলে কাঁদবি না, খিদে পেলে বলবি না, জোরে কথা বলবি না, আওয়াজ করে হাঁটবি না, বেলা করে ঘুম থেকে উঠবি না, সবার সামনে দোর দিবি না, দুপুরে শুবি না,শাশুড়ির আগে খাবি না -না না না না না।এতো কথার কি দরকার বললেই হতো মরার মতো বাঁচবি।মনে পড়ে পিসি দের বৌভাত থেকে ফিরলেই ঠাকুমা ঝাপিয়ে পড়তো- কি কি হলো বল।কি দিয়েছে, কেমন আপ্যায়ন, কি খাওয়ালো সব আলগা প্রশ্নের পর সেই আকুল প্রশ্ন -মেয়ে হাসিখুশি ছিলো? কি দেখলে আর কি বুঝলের মধ্যে কতখানি ফারাক তা যেন চোখের কোণ দিয়ে মেপে নিতে চাইতো।
এখন বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ অনেক বদলে গেছে।আলতার জায়গায় মেহেন্দী, শাড়ির বদলে লেহেঙ্গা, গগন বিদারী বাজি পটকায় আর আলাদা করে বাঙালি বিয়ে চিনে নেবার উপায় নেই।খাওয়ার মেনু থেকে বিদায়ের কান্না সব কিছুর ভাষা বদলে গেছে।একটাই ভরসা বিসমিল্লাহ র সানাই এর বিকল্প এখনো বাঙালি খুঁজে বের করতে পারে নি।