রস্টার - শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

আজ শুভময়ের নাইট ডিউটি। এই নিয়ে এই সপ্তাহে তিনদিন নাইট ডিউটি।এমনিতে রাতের বেলায় রোগী কম আসে। তবু ডিউটির সময় তো আর আলসেমির সুযোগ থাকে না। তার ওপর যাঁরা রাতের বেলায় আসেন তাঁরা বেশিরভাগই ক্রিটিক্যাল।শুভময় সার্জেন। রাতে তেমন পেটেব্যথা হলে ওটি খুলিয়ে অ্যানেসথেটিস্ট ডেকে পেট কেটে নাড়ি ছাড়ানোর অভিজ্ঞতাও তার আছে।শুভময়ের সঙ্গে বেশির ভাগ দিন অ্যানেসথেটিস্ট থাকে পীযুষ সরকার। এক কলেজ এক ব্যাচ। তাই সহজেই দুজনের মনের কম্পাঙ্ক মিলে যায়। তাছাড়া পীযুষ হাত পা ঝাড়া। চল্লিশ ছুঁইছুঁই বয়সেও সেই ভুলটা করেনি যা শুভময় করে বসেছে দেড়বছর আগে।বিয়েটা একরকম তড়িঘড়ি করেই হয়ে গেল। হতে না হতেই অপর্ণা পোয়াতি। শুভময়দের হাসপাতালটা যেখানে, সেখানে আপতকালীন ব্যবস্থা তেমন মজবুত নয়। তাই অপর্ণার বাপের বাড়ির কাছেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে হয়েছে তাকে। সাড়ে সাত মাস চলছে ওর। সেই চিন্তায় শুভময় আজকাল হাসপাতালে এলেই খিটখিট করে। জিডি স্টাফদের সঙ্গে বারবার ঝামেলা লেগে যায়। পেশেন্টের বাড়ির লোকরা রেগেমেগে চলে যায়। তার আসল কারণ, শুভময় মনেমনে অপর্ণাকে চোখে হারায়।এদিকে মালদা থেকে চাঁচলের দূরত্ব কম নয়। প্রায় দু আড়াইঘন্টার রাস্তা। তার মনের ভিতরটা দুরদুর করতে থাকে। ফোন এলেই চমকে ওঠে।
জাতীয় সড়কে একটা বড়সড় জ্যাম লেগেছে। সাধারণত এই রাস্তা খালিই পড়ে থাকে।বিশেষত সন্ধ্যাবেলা। শুভময় আজ নিজের গাড়িটা আনেনি। তার নিজস্ব ড্রাইভার ছুটি নিয়েছে। তাছাড়া গাড়ির ক্লাচে একটা আওয়াজ হচ্ছে কয়েকদিন ধরে। শুভময় নিজে গাড়ি চালাতে পারে। সে-ই হঠাৎ আওয়াজটা আবিষ্কার করলো। মাঝপথে গাড়ি বিগড়ানোর অভিজ্ঞতা তার আছে আর সেটা মোটেই সুখকর নয়। আজ তাই সেন্টার থেকে গাড়ি ভাড়া করেই সে যাচ্ছে। ড্রাইভারটি বেশ সাবধানে গাড়ি চালায়।ভদ্র। বয়স ত্রিশ বত্রিশ হবে। চট করে কেউ এতো ভদ্র একজন মানুষকে ড্রাইভার বলে মানতেই চাইবে না।
হঠাৎ অধৈর্য লাগতে শুরু করলো তার। পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে গেল একই জায়গায় ফেঁসে আছে গাড়িটা। একটা ডাম্পার উল্টে গেছে বলছে লোকে।দমকল আসবে। ক্রেন দিয়ে তুলে সরাবে। তারপর রাস্তা খুলবে।অবশ্য হাসপাতালে সে আগেই জানিয়ে দিয়েছে তার আসতে দেরি হবে। তার কলিগ পলাশ চাঁচলেই থাকে। ও হ্যান্ডওভার নিয়ে নিচ্ছে।এমন রস্টার কারা বানায় কে জানে? এক সপ্তাহে তিনটে নাইট!সম্ভব নাকি?তাও কোভিডের সময় হলেও হতো। কোভিডের সঃক্রমণের ভয়ে যখন সকলে ঘরে বন্দি,শুভময়রা তখন টানা বাহাত্তর ঘন্টা ডিউটিও করে দিয়েছে অছিলায়।অপর্ণাকে সেই সময়টা বাপের বাড়ি রেখে এসেছিল শুভময়।টানা বত্রিশ দিন আঠারো ঘন্টা ছত্রিশ মিনিট ঊনচল্লিশ সেকেন্ড তার অপর্ণার সঙ্গে সেই সময়ে দেখা হয়নি। সেই সময়ে শুভময় বুঝতে পারেনি,তার বাইরের শান্তভাবের আড়ালে আসলে উৎকন্ঠাও বাড়ছিল। আর সেই উৎকন্ঠাই এখন অসহিষ্ণুতায় পরিণত হয়েছে। যখন তখন মেজাজ হারায় সে। এই মুহূর্তে যেমন তার মনে হচ্ছে এক্ষুণি গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে হল্লা করে আসে। কিন্তু নিজেকে সংযত করলো সে।মনকে বোঝালো। এটা পরিস্থিতি।ওরা চেষ্টা করছে। একটু সময় লাগবে। ব্যাস।
শুভময়ের উৎকন্ঠার কথা বোধহয় গাড়ির ড্রাইভার ধরে ফেলেছিল। এতক্ষণের নীরবতা ভেঙে এই প্রথম সে বলে উঠলো,"স্যার,যদি কিছু মনে না করেন,আপনার অনুমতি নিয়ে গাড়িটা ঘুরিয়ে নেবো? আমি গ্রামের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা জানি। এই জট কাটতে সময় লাগবে।যাবো?"শুভময় দায়সারাভাবে এর উত্তরে হ্যাঁ বলে দিল।মনে মনে বলল,"জানোই যখন অন্য রাস্তা আছে,এখানে বেকার আটকে রেখেছো কেন বাবা?"
শুভময়ের ড্রাইভার বেশ তৎপরতা দেখিয়ে জট থেকে বের করে আনলো গাড়িটা।গ্রামের মেঠোপথ ধরে কিলোমিটার দশেক ঘুরে শুভময়ের গাড়ি আবার জাতীয় সড়ক ধরে ফেলল।মনের বিষভাব কেটে গেছে অনেকটাই। ড্রাইভারটি এতো স্থিতধি। একটু যেন অপরাধবোধ ঘিরে ধরলো তাকে। সেটুকু ঢাকতেই শুভময় তার সঙ্গে কথোপকথনে মন দিল।
-তোমার বাড়ি কোথায় ভাই?
-রায়গঞ্জ।
-বাড়িতে কে কে থাকে?
-বাবা ছিলেন। তিনমাস আগে করোনা আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন। একাই থাকি।
-বিয়ে থা করোনি তাহলে?
-নাহ। এই রোজগারে নিজেরটুকু কোনও মতে চলে যায়। আরেকজনের দায়িত্ব ...
নাহ। রাধামাধবের কৃপায় শুভময়ের রোজগারপাতি খারাপ হয় না। করোনার দিনগুলোয় একটু ভাঁটা পড়েছিল বটে,কিন্তু তারপর সেটা পুষিয়ে গেছে। ছেলেটার হাতটা বেশ ভালো। পটু।বোধহয় অনেকদিন চালাচ্ছে।অবশ্য এরা তো ছোটবেলা থেকেই চালাতে অভ্যস্ত।এদের রস্টারে পাঁচটা নাইট থাকলেও সামলে দেবে।
-কতোদিন চালাচ্ছো গাড়ি?
-মাস দুয়েক।
শুভময় চমকে ওঠে।মাসদুয়েক! মাত্র!!
-তার আগে কী করতে?
-সেলসে ছিলাম স্যার।একটা কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার।
-তারপর?
-লকডাউনের পর চাকরি চলে গেল আমার। অবশ্য চাকরি চলে গেল বলা ভুল। কোম্পানিটাই তো উঠে গেল।
-তারপর?
-বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না। একা হয়ে গেলাম।বন্ধুরা ছিটকে গেল এদিক ওদিক।নিজের একটা গাড়ি ছিল।আমার গাড়ি চালাবার শখ ছিল। দুমদাম গাড়ি হাঁকিয়ে চলে যেতাম দিনহাটা কালিম্পঙ। সেই গাড়ি বেচে চলল কিছুদিন।তারপর ভাবলাম, গাড়ি চালানোটাকেই পেশা করলে কেমন হয় ! এমনিতেও তখন দৌড়ে দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
-প্রেমিকা ছিল না তোমার?
-ছিল। রেজিস্ট্রি হবার কথা ছিল গতকাল।করোনা আর লকডাউন জীবনটাকেই অন্য চ্যানেলে ফেলে দিল আমার।
-ও ছেড়ে দিল তোমাকে?
-না।আমিই ছেড়ে দিলাম।ভাঙা নৌকায় দুজনে ডোবার থেকে একজন বরং বেঁচে যাক। ও এখন ভালো আছে। বিয়ে করেছে।
-কষ্ট হয় না?
খানিক চুপ থেকে ছেলেটি বলে,"প্রথম প্রথম হতো।মরে যাবার চেষ্টা করেছি দুতিনবার।তারপর ভাবলাম। নিজেকে বোঝালাম।আপনাদের কথা ভাবলাম। এই যে টানা ডিউটি করে চলেছেন।কোনও রাগ নেই বিরক্তি নেই।অভিযোগ নেই অভিমান নেই। কার জন্য?আমাদের জন্যই তো! আপনারা পারলে আমিও ঠিক পারবো।অন্যের জন্য বাঁচার আনন্দই আলাদা । জানেন,এমবিএ করছি যখন,কলেজে মাজলোর পিরামিড পড়িয়েছিল।কী চাই আমরা?আমাদের "নিডস"।আপনারা পেরেছেন সেই পিরামিডের চূড়ায় পৌঁছোতে।যার নাম আত্মোপলব্ধি।আমাকেও পারতেই হবে।

শুভময় এতক্ষণে যেন একটা ঘোরে আটকে রয়েছে।গাড়ি চাঁচোল ঢুকছে।নাইট ডিউটির রস্টারের ক্ষোভ এখন অনেকটাই মিলিয়ে গিয়েছে।গাড়ি পার্কিংএ ঢুকতেই শুভময়ের হঠাৎ মনে হলো,"এই যাহ।এতো কথা হলো।নামটাই তো জানা হলো না।"অবশ্য ভাবতে ভাবতেই "থ্যাংক ইউ স্যার" বলে ছেলেটি চলে গেল।শুভময় হাসপাতালে ঢুকতে ঢুকতে ভাবতে থাকলো।কেন 'থ্যাংক ইউ' বলল ছেলেটা তাকে?সে কী এমন করেছে যাতে এই ছেলেটা তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে পারে? ভাবতে ভাবতেই এমারজেন্সি ব্লকে পৌছে গেল সে।হ্যান্ডওভার নিতে হবে।