গ্লোব - দেবাশীষ সরকার

অসময়ের কিছু-কিছু বেয়াড়া উপহার কিছু-কিছু মানুষের জীবনের গতিপথ বেপথু করে দেয়, বেলাইনও। হাইওয়ে থেকে হঠাৎই পাশের ঢালু জমি বেয়ে নেমে, অবিন্যস্ত  আলপথ ধরে  হাঁটতে থাকে মনপথিক। সব হয়ে যায় বেধাঁচ-বেছাঁচ!

শৈশবের এক জন্মদিনবেলায় এক স্বজন আমায় একটা বড়োসড়ো গ্লোব উপহার দেয়। শক্তপোক্ত পাথুরে পেডেস্টাল-ওয়ালা। তার আগের কোনো-এক বছরে, একই জায়গা থেকে একই উপলক্ষে পাওয়া গিয়েছিল বিশালকায় এক ওয়ার্ল্ড-ম্যাপ, মোটা ক্যানভাসের ওপর সাঁটা। সে-ও তো একরকম গ্লোব-ই। শুধু চেপ্টে, লেপ্টে দেওয়া! ওপরে-নিচে দুটো রুলকাঠ দিয়ে বাঁধানো, মজবুত জিনিস। বাবা ওটা টাঙিয়ে দিয়েছিল বসার ঘরের ফাঁকা দেওয়ালে, সোফার ঠিক ওপরে। আর গ্লোবটা আশ্রয় পেল পড়ার টেবিলে। ওহ হ্যাঁ, দুটোরই নির্মাতা সুবিখ্যাত 'চন্ডীচরণ দাস অ্যান্ড কোম্পানী'।

যাইহোক, সাড়ে তেইশ ডিগ্রি ঘাড়বাঁকা এই ঢাউস গোলাকার পেপারপাল্পের তৈরি জিনিসটা দিনে-দিনে আমার একখানা জবরদস্ত খেলনায় পরিণত হলো। সমুদ্রগুলো সব একরঙা, নীল। আর স্থলভাগের নানা রঙ, দেশ অনুযায়ী। কখনো ধীরে-ধীরে, কখনো জাস্ট বাঁইবাঁই করে ঘোরানো-টা নেশার মতন হয়ে গেল! হঠাৎ ঝুপ্ করে থামিয়ে দিয়ে দেখতাম, কোন দেশে এসে থামলাম। 'এলেম নতুন দেশে' টাইপের ফিলিং হত। বেশ প্রতীকী ব্যাপারস্যাপার, তাই না?

স্কুলের জ্যগ্রাফি স্যার একটা বেত নিয়ে ঢুকতো। বেঁটকুল্লে তিরিক্ষিপানা ঝুলো-গোঁফওয়ালা পিলপিলে চেহারার লোক। কী একটা বুট পরতো, করিডোর থেকে খটখট পিলে-চমকানো আওয়াজ আসতো!  একবার ক্লাস সেভেন না এইটে  ম্যাপ পয়েন্টিং-এ, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সব্বাই প্যাঁদা* খেলো, আমি বাদে! তুরন্ত স্কেল-পেন্সিল দিয়ে ল্যাটিচুড-লঙ্গিচুড টেনে দেখিয়ে দিয়েছিলাম। কোথাকার, মনে নেই! গোটা গ্লোবটা যে আমার হাতবশ তখন! চ্যাপলিনের গ্রেট ডিক্টেটর ছবির অবিস্মরণীয় সেই গ্লোব-সিন... তখনো দেখিনি। নাহ।

লোডশেডিং হতো তখন খুব। কাঁচের সুন্দর বড়ো ল্যাম্প ছিল আমাদের কয়েকটা। জ্বালতো মা সেগুলো। পলতে বেশি বাড়ালে কাঁচ কালচে হয়ে যেত, তাই মধ্যমা তেজ। কাজের লোককে রেশনকার্ড দেওয়া থাকত, সে লাইন দিয়ে সাপ্তাহিক কোটার কেরোসিন তুলে এনে দিত। সেই মায়াময় আধা-আঁধারী আলোয় পড়াশোনার বইপত্র থেকে চোখ উঠে আসত পাশে রাখা গ্লোবে। 'অপরাজিত' ছবিটা এর অনেক পরে, বড়ো হয়ে দেখেছিলাম।

তো, সময়ের নিয়মে অপুর মতোই একদিন বড়ো হয়ে গেলাম। নিয়মমাফিক ফি সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে 'পড়তে বসা'-টা তেমন প্রাসঙ্গিক থাকল না আর। লায়েক হলাম। গ্লোব ঠাঁই নিলো আলমারির মাথায়। তার গায়ে পড়লো সময়ের ঝুল। পৃথিবী ঘুরতে লাগল ঘূর্ণায়মান কালের যাত্রায়, দিয়ে অপরিবর্তন অর্ঘ্য।

একদিন নামিয়েছিলাম! ধুলোটুলো ঝেড়ে, তর্জনী দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলাম। কতো কীই যে ইতিমধ্যে পাল্টেপুল্টে গেছে জগত-টার! একটা ইয়াব্বড় ভূখন্ডের গায়ে লেখা USSR... আরেকটার গায়ে যুগোশ্লাভিয়া... যুগচক্র ঘুরছে। ভেঙে ভেঙে সে-সব দেশ আজ শতধাবিভক্ত। কত রদবদল, কত রঙবদল দেখে ফেললাম! ফেলছি, ফেলবোও।

উল্টো ছবিও, হ্যাঁ, একটাই দেখেছিলাম সেদিন। আমার গ্লোবে, আর বাস্তবের 'গ্লোবে'! দ্বিখণ্ডিত জার্মানি আঁকা আছে দু-রঙে। পূর্ব আর পশ্চিম। আজ দেওয়াল নেই, আছে একীকরণ। ভূখণ্ডের। দু-ধারের মানুষেরাও কী সংযুক্ত হয়েছে একে-অপরের সাথে? রুডিয়ার্ড কিপলিং যে বলেছিলেন Oh, East is East, and West is West, and never the twain shall meet...' কেজানে...

'গ্লোব-ট্রটার'! এখনো স্বপ্ন দেখি, হয়ে ওঠার! 'স্বপন যদি মধুর এমন, হোক সে মিছে কল্পনা...' না বাপু, জাগিয়ো না, আমায় জাগিয়ো না! এই তো বছরকয়েক আগেও বিমল মুখার্জির লেখা 'দু-চাকায় দুনিয়া' বইটা মুখে নিয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলে বুঁদ হয়ে থাকতাম হপ্তাখানেক। মায়ের বকুনি টোটাল অগ্রাহ্য করে! ভদ্রলোক সাইকেল নিয়ে... আহা! জীবন বটে! ভন্ড গ্লোব-ট্রটার মন্দার বোসের গল্পও তো পড়া। গ্লোব... টেনেছে। টানে, এখনো।

জীবনের মানচিত্রও আপন অক্ষপথে বিবর্তিত হতে-হতে যায়... গ্লোবের মতই। গ্লোবের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে হয়তো কতকটা ভাবতে-বুঝতে-শিখতে চেষ্টা করেছি গ্লোবাল ভিশন... মানে বিশ্বদৃষ্টি, অজান্তেই। অজান্তেই তো মানুষ জীবনের বড়ো-বড়ো জিনিসগুলো শেখে!  বিশ্বকবির 'বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো/ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও' এই যোগচেতনার কণিকারূপে মিশে যেতে চাই আমি। আর, আন্তরিক ভাবে চাই, থেকে যাক আমাদের সকলের প্রিয় এই গ্লোব-টা!